কাদের মোল্লা প্রদত্ত রায়ের প্রতিক্রিয়ায় যেভাবে গণমাধ্যমের সামনে বিজয়োল্লাসে আঙ্গুল প্রদর্শণ করেছিলেন সেই অসংযত গর্হিত আচরণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছিলো, তারা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর এমন ঔদ্ধত্বে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। একাত্তরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যগণ ন্যায়বিচারের জন্য দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করেছেন, বিশ্বাস করেছেন কোনো না কোনো দিন তাদের উপরে ঘটে যাওয়া বর্বরতার ন্যায়বিচার তারা পাবেন, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল তাদের সেই আশা পুরণের একটা মঞ্চ হিসেবে উঠে এসেছিলো, সেখানে বিচারাধীন প্রতিটি অভিযুক্ত ১৯৭১ এ কোনো না কোনো ভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দোসর ছিলো এবং তাদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে না আসাতে পারার অক্ষমতা মূলত আমাদের রাষ্ট্রকেই অপরাধী করে রেখেছিলো।
কাদের মোল্লার ঔদ্ধত্ব এইসব বিচারপ্রত্যাশী মানুষের ভেতরে এক ধরণের প্রতিশোধ বাসনা উস্কে দিয়েছিলো, তারা সাধারণ অরাজনৈতিক বিচারের রায়ে ক্ষুব্ধ মানুষের সাথে এক কাতারে রাস্তায় নেমেছে, তারা তারুণ্যের স্বরে স্বর মিলিয়ে শ্লোগান দিয়েছে " ফাঁসী ফাঁসী ফাঁসী চাই, কাদের মোল্লার ফাঁসী চাই।"
এভাবে প্রকাশ্যে রাজপথ অবরোধ করে ফাঁসীর দাবী উত্থাপন করার কোনো আইনী ভিত্তি নেই, মনে মনে তারা জানতো কিন্তু বিচারের রায় এবং অভিযুক্তের ঔদ্ধত্ব তাদের এই বিবেচনাবোধকে সাময়িক আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। তারা রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের সমালোচনা করে নি, তারা ট্রাইব্যুনালকে অভিযুক্ত করে নি, তারা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করেছে, সরকার যখন ঘোষণা দিয়েছে তারা পুনরায় বিচারের রায় পরিবর্তনের আপীল করবে কিছু মানুষ আশ্বস্ত হয়ে ঘরে ফিরে গেছে।
দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসীর রায় প্রদানের পর মানুষের প্রতিশোধ স্পৃহা সাময়িক স্থগিত হয়েছে, তারা তৃপ্ত, তারা এক ধরণের বিজয়ের আস্বাদ পেয়েছে কিন্তু একই সময়ে মাহমুদুর রহমান এবং আমার দেশ - নয়া দিগন্ত খুব পরিকল্পিত ভাবেই শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে বিতর্কিত করে ফেলতে পেরেছে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ অরাজনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষ একটি গণজমায়েত ছিলো কিন্তু "থাবা বাবা" এবং ব্লগারদের একই ব্যাকেটে আবদ্ধ করে সবাইকে নাস্তিক ও ধর্মবিদ্বেষী হিসেবে উপস্থাপন করার পালটা প্রতিক্রিয়ায় তারা নিজেদের ধর্মীয় অনুভুতিহীন প্রতারিত জনগোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করার সাথে সাথে নিজেদের আস্তিক প্রমাণেও ব্যস্ত হয়েছে। ফলে সম্পূর্ণ সিজদারত না হলেও গণজাগরণ মঞ্চ আস্তিকতা প্রশ্নে রুকুতে চলে যাওয়া অবস্থায় বিরাজ করছিলো।
যুদ্ধাপরাধী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করার দাবী উত্থাপিত হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে, বিএনপি ও চার দলীয় জোটের অন্যতম শরীক দল জামায়াতে ইসলামী স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিলো, বিএনপির সামনে বার বার সুযোগ আসার পরও বিএনপি কোনো না কোনো বিবেচনায় জামায়াতের সাথে ঐক্যের ভাবনা থেকে সরে আসে নি। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে স্পষ্ট বলা না হলেও আশেপাশের শ্লোগান এবং অন লাইন প্রচারণায় বিএনপিকে সরাসরি জামায়াত তোষণ ও জামায়াতকে রাজনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় বিএনপি বাধ্য হয়েই চার দলীয় জোট বিষয়ে আরও কঠোর অবস্থানে পৌঁছেছে।
একই কারণে দেশের বেশ বড় একটা ভোটার ও সাধারণ মানুষের একাংশের কাছে গণজাগরণ মঞ্চকে আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে ধরে নেওয়ার একটা ভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। গণ জাগরণ মঞ্চ ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির প্রতিপক্ষ নয় কিন্তু আজকে খালেদা জিয়া প্রেস কনফারেন্সে এবং মুক্তিযোদ্ধা ইনাম আহমদ চৌধুরি একাত্তর টিভিতে যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করলেন তাতে স্পষ্ট মনে হতে পারে গণজাগরণ মঞ্চ কোনো না কোনো ভাবে বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভুমিকায় নেমে পরেছে।
খালেদা জিয়া যেভাবে গণজাগরণ মঞ্চকে উপস্থাপন করলেন তার প্রেস কনফারেন্সে" শাহবাগ ও দেশের অন্যান্য স্থানে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ" এর বিরুদ্ধে অন্যায় কুৎসা রটনা করলেন সেটা অনভিপ্রেত।
গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বিএনপি ও তার অঙ্গ ছাত্র সংগঠন ও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনকে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে জানানো উচিত
গণজাগরণ মঞ্চের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। তারা স্পষ্টতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সংগঠন যারা বিশ্বাস করে একাত্তরের পাপ ধুয়ে মুছেই শুধুমাত্র একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী শোষণ ও বৈষম্যহীন সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ নির্মাণ করা সম্ভব।
গণজাগরণ মঞ্চ স্পষ্টতই দেশের বর্তমান নিয়ে উদ্বিগ্ন তরুণদের প্রতিনিধি যারা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়। তারা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যারা বিশ্বাস করতো নাগরিক নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে একটি স্বাধীন ভূখন্ডে। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের একটি স্বাধীন ভূখন্ড দিয়েছেন কিন্তু গত ৪০ বছরের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমরা আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারি নি। আমাদের সামনে অর্জন করার অনেক কিছুই রয়ে গেছে, আমাদের লড়াই সুন্দর আগামী নির্মাণের।
সুন্দর আগামী নির্মাণে আমাদের প্রধান অন্তরায় ১৯৭১ এ যুদ্ধাপরাধীগণ, তাদের যেভাবে বিচারবিভাগীয় সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিলো এবং যেভাবে বিভিন্ন সামরিক সরকার নিজেদের অজনপ্রিয়তা ও অগ্রহনযোগ্যতা ঢাকতে আরও বেশী সুযোগ সুবিধা দিয়েছে তাতে এরা সংগঠিত হয়ে আমাদের সমাজ সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উপরে আঘাত হানতেও দ্বিধাবোধ করে নি। আমাদের জাতীয় স্মারক ও আমাদের শ্রদ্ধানিবেদনের প্রক্রিয়াকেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তারা এসব আচরণকে বেদাতি ও হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি উদ্ভুত আচরণ বলতেও দ্বিধা করে নি। তরুণদের লড়াইটা এই অপসংস্কৃতি কিংবা রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি প্রচারের বিরুদ্ধে।
ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির সাথে জামায়াতের জোটবদ্ধতা এক ধরণের দু:খজনক বাস্তবতা কিন্তু এই দলটির উপদেষ্টা পরিষদে যারা আছেন তাদের অনেকেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের এই গৌরবোজ্জল ভূমিকার কারণে সাধারণ তরুণদের একাংশের প্রতিনিধি হিসেবে জামায়াতের মতো যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের সাথে বিএনপির রাজনৈতিক মৈত্রিত্ব বিষয়ে বিএনপি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের উদাসীনতায় আমরা মর্মাহত।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই বিএনপিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তারা বিশ্বাস করে ভোটের রাজনীতি বিবেচনা করে বিএনপি যেভাবে জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী এই অবস্থান বিএনপি উপলব্ধি করবে এবং জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধতা ভেঙে তারা তরুণদের কাছে গ্রহনযোগ্য একটি উৎকৃষ্ট রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করবে।
দেশের বিভিন্ন ধরণের অনিয়ম বিদ্যমান কিন্তু সব অনিয়মের সূচনা মূলত আমাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেই শুরু হয়েছে, আমরা একাত্তরের অপরাধের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে সামনে দিকে এগিয়ে যেতে চাই, আমরা সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা চাই, আমরা চাই বাংলাদেশে রাজনীতি করবে শুধুমাত্র সেসব রাজনৈতিক দল যারা একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী ।
গণজাগরণ মঞ্চ সম্পৃক্ততার আহ্বান জানাতে পারে ছাত্রদলকেও, চার দলীয় জোটের রাজনীতির সবচেয়ে নির্মম শিকার আসলে ছাত্র দল, তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ধ্বংস হয়েছে চার দলীয় ঐক্যজোটের রাজনীতিতে, তারা নিজেরাও তরুণদের ঐক্যে বিশ্বাস করে এবং দলীয় ব্যানারে না হলেও তারা নিয়মিত গণজাগরণ মঞ্চে উপস্থিত থেকেছে।
আমরা তরুণেরা সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ নির্মাণে আগ্রহী এবং আমরা সেসব তরুণ ও যুবকদের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী যারা একাত্তরের চেতনা নিজের ভেতরে ধারণ করে। রাজনৈতিক আনুগত্যে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যেকোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হলেও এই তারুণ্যের মিলনমেলায় তারা আমন্ত্রিত। আমাদের সামনে লড়াই স্পষ্ট, আমাদের প্রতিপক্ষ চিহ্নিত, আমরা জানি গত ৪২ বছরেও যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের সহযোগী অঙ্গ সংগঠনগুলো এখনও একাত্তরের অসাম্প্রদায়িকতার চেতনায় আস্থা স্থাপন করে নি, তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করে না, তারা একাত্তরের মতো এখনও ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যার বৈধ্যতা দিতে আগ্রহী।
বিএনপি আজকে যে ভাষায় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে আক্রমণ করলো যেভাবে তারা এই মঞ্চকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হিসেবে তুলে ধরলে সে ভ্রান্তি কাটিয়ে বিএনপি নিজের ভুল স্বীকার করে জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধতার প্রতিশ্রুতি ভেঙে দিয়ে এই মঞ্চ ফিরে আসতে চাইলে এই গণজাগরণ মঞ্চ তাদের সাগ্রহে টেনে নিবে, গণজাগরণ মঞ্চ বিশ্বাস করে একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী সকল মানুষের অংশগ্রহণেই সুন্দর বাংলাদেশ নির্মাণ করা সম্ভব।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:২১