ধেয়ে আসছে সফটওয়্যারের মহাশক্তিঃ আমাদের করণীয়
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২০২৫ সাল নাগাদ এখনকার দিনের ৫০ ভাগেরও বেশি পেশা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, সংশ্লিস্ট কর্মক্ষেত্রগুলোতে সফটওয়্যার ও স্বয়ংক্রীয় যন্ত্রপাতির কারণে!
খবরটা পড়ে ছোট-খাটো একটা ধাক্কা খেলাম। সফটওয়্যার প্রযুক্তির মানুষ বলে মানুষের কাজ যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হওয়াটা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। সফটওয়্যারের মাধ্যমে ১০০০ কর্মঘন্টা ১০ কর্মঘন্টার দক্ষতায় নিয়ে আসার পরও আমাদের সন্তুষ্ট হওয়ার উপায় থাকে না, কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১০০০ কর্মধণ্টার কাজ কয়েক সেকেন্ডে নিয়ে আসা সম্ভব। আমার বিস্ময়ের কারণ সফটওয়্যারের দক্ষতার কারণে এই বিশাল পরিমাণ জনগোষ্ঠি কর্মহীন হয়ে যাবে এই রকম কোন ধারণা ছিল না আমার।
খবরটা পড়ার অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাজ করার কোন স্পৃহা পেলাম না। একধরণের অপরাধবোধ গ্রাস করতে থাকলো। উপার্জনের পাশাপাশি প্রতিটা মানুষ তার পেশা নিয়ে গর্ব করতে চায়, চেতন বা অবচেতন মনে দেখতে চায় তার কাজের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে আরও দশজন। যে ঝালমুড়িওয়ালা স্কুলের বাচ্চাটিকে মুড়ি দিয়ে হাসি ফোটাচ্ছে, কিংবা যে ট্যাক্সি চালক তাড়ায় থাকা রোগীটিকে ডাক্তারের চেম্বারে নামিয়ে দিয়ে আসে - তার তৃপ্তির একটা মহৎ সৌন্দর্য আছে।
এই রকম হাজার মানুষের কর্মহীনতার কারণ হিসেবে নিজের পেশার এইরকম ভিলেনরূপ একধরণের অস্বস্তির কারণ হচ্ছিল। চোখে ভাসতে লাগলো, বাবার কাজ থেকে ফেরার অপেক্ষায় বসে আছে তার সন্তানেরা, আজ হয়তো ঈদের নতুন জামা নিয়ে আসবে। কিন্তু বেচারা বাবা এ মাসের ঘরভাড়াও দিতে পারেনি, তার কারখানায় গণহারে কর্মী ছাটাই হচ্ছে, যে কোন মুহূর্তে কর্মহীন হয়ে যেতে পারে সেও। একই কারণে শহরে কাজ করা সন্তান এ মাস থেকে তার টাকা পাঠাতে পারবে না গ্রামে থাকা বৃদ্ধ বাবা মা-কে।
পছন্দ হোক বা না হোক যতোই দিন যাবে প্রযুক্তির হাতে চলে যাবে অনেক পেশা। কিন্তু একটা জিনিস পরিস্কার করে দেখা ভালো, যে কাজগুলোতে বুদ্ধি বা সৃষ্টিশীলতা খাটানোর প্রয়োজন নেই, উন্নত মানের সফটওয়্যার সমৃদ্ধ কোন রোবট বা যন্ত্র মূলত সে ধরণের কাজগুলো করবে। আরও ভালোভাবে বললে বলতে হবে, যে কাজ গুলোর ধরণ আগে থেকেই অনুমান করা যায়, তার সবই যান্ত্রিকভাবে করানো সম্ভব। দিন দিন আসছে আরো শক্তিশালী প্রযুক্তি, যে কাজগুলোর ধরণ আগে থেকে অনুমান করা যায় না, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির কারণে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার একটা অংশও চলে যাবে যন্ত্রের হাতে।
কেউ যদি মনে করে থাকে শুধু প্রযুক্তি রপ্ত করলেই বাজারে ভালোভাবে টিকে থাকা যাবে, সে ধারণাও ভুল। প্রযুক্তির একটা সৌন্দর্য হলো, নতুন নতুন আসলে সেই প্রযুক্তির ও সেটা জানা মানুষের ভালো কদর থাকলেও কিছু দিনের মধ্যেই সেটা সর্বসাধারণের নাগালের ভেতর চলে আসে। আজ থেকে বিশ বছর আগেও কম্পিউটার সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল, সেই কম্পউটারে গোটা কতক কমান্ড দিতে পারলেই লাখ টাকা বেতন হাঁকানো যেত। এখন তার চাইতেও কয়েক হাজারগুণ শক্তিশালী কম্পিউটার একজন অতি সাধারণ উপার্জনের মানুষের পকেটে থাকে, দু'বছরের শিশুও চালাতে পারে সেই "কম্পিউটার"।
অচির ভবিষ্যতে সবকিছু কম্পিউটারের দখলে চলে যাবে না এটা মোটামুটি পরিস্কার। সত্যি বলতে কী প্রতিটা মানুষ জন্মগতভাবে যে পরিমাণ সৃষ্টিশীলতা ও কম্পনাশক্তি নিয়ে আসে, সে পর্যায়ের মেধাবী যন্ত্র তৈরী হতে আরও কয়েকশ' বছর লেগে যাবে। "ইন্টেলিজেন্ট সফটওয়্যার" বানাতে গিয়ে প্রতিবারই অনুভব করেছি, যন্ত্রের মধ্যে খুব সামান্য বুদ্ধিমত্তা (যেমন নানা ছবি থেকে একই ব্যক্তিকে সনাক্ত করা) সঞ্চালন করতে আমাদের সপ্তাহ পর সপ্তাহ যে পরিমান গলধঘর্ম করতে হয়, সেটা একটা দু'বছরের শিশুও কয়েক সেকেন্ডে করে ফেলতে পারে।
সমস্যা একটাই জন্মগতভাবে মানুষ যে পরিমাণ সৃষ্টিশীলতা ও কম্পনাশক্তি নিয়ে আসে, বড় হতে হতে মোটামুটি সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যায়। এর একটা কারণ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা। তথাকথিত প্রতিযোগিতার জন্যে উপোযোগি করতে শিশুদের মুখস্থ নির্ভর ও অসৃষ্টিশীলভাবে বড় হতে দিলে এই নতুন যুগে এরা সবাই বড় ধরণের সমস্যায় পড়ছে ও পড়বে। যে বিষয়গুলোতে "দক্ষ" হবার জন্যে ওরা প্রাণপণ রপ্ত করে যাচ্ছে মাথা প্রায় না খাটিয়ে, এর প্রায় সবকিছুই দখল করে নিয়েছে ও নেবে নিষ্ঠুর কম্পিউটার। আগামী দিনের পেশায় ভালো করতে হলে নিজেকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যার সাথে "যন্ত্র" প্রতিযোগিতা করতে পারবে না - যার সহজ উত্তর হলো কল্পনা ও চিন্তা করার ক্ষমতা।
এ বিষয়ে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার পরিচিত (পরিচিত'র পরিচিত বলা ভালো) একাধিক ছাত্র সিঙ্গাপুরের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করেও এখানে ভালো চাকুরী জোটাতে পারেনি। কারণ হিসেবে বলেছে ইন্টারভিউতে তাদের যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে তার সবই বুদ্ধিভিত্তিক। এতোদিন ধরে যা কিছু মুখস্থ করে এসেছে, সেইরকম তথ্যভিত্তিক কোন প্রশ্নই করা হয়নি। ফলাফল স্বরূপ এদের প্রত্যেককেই নিজ দেশে ফিরে যেতে হয়েছে।
প্রযুক্তির কারণে আগামী দিন গুলোতে মানুষের বেশিরভাগ মৌলিক সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে আশা করা যায়ঃ উন্নত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা চলে আসবে হাতের নাগালে, যোগাযোগ হয়ে যাবে অকল্পনীয় সহজ, অপরাধীদের জন্যে অসম্ভব হয়ে উঠবে অপরাধ করা। জীবন যাপনের অপ্রয়োজনীয় জটিলতাগুলো যদি প্রযুক্তির হাতে চলে যায়, মানুষ তখন সময় ব্যয় করতে পারবে জীবনের যে বিষয়গুলো তার জন্যে অর্থপূর্ণ সেগুলোতে, সেটা হতে পারে প্রিয়জনের সাথে আরো বেশি সময় কাটানো, কিংবা কোন পেশাগত বা সৌখিন সৃষ্টিশীল মগ্নতায়।
এটা সত্যি যে, সৃষ্টিশীলভাবে বেড়ে ওঠার জন্যে একই রকম পরিবেশ দেয়া হলেও সবাই সমান পর্যায়ের সৃষ্টিশীল নাও হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সৃষ্টশীলতা কোন ইদুঁর দৌড় নয়, নিজস্বতা ও মৌলিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠাটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আজকের মতো কে কত বেতনের চাকুরী করে সেটা কারো সফলতার মাপকাঠি হবে না, কে কত অর্থপূর্ণভাবে তার জীবনযাপন করলো সেটাই হবে মূল। জীবনে সুখী-সফল হওয়ার জন্যে যে খুব বেশী অর্থের প্রয়োজন হয় না, জ্ঞানভিত্তিক নতুন প্রজন্মের কাছে এটা ক্রমেই পরিস্কার হয়ে আসছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতা নয়, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী বদলে, সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে যারা নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাবে - তারাই হবে আজ ও আগামীর সফল মানুষ।
মানুষের মধ্যে যে অপরিমেয় সৃষ্টিশীলতা এতোদিন অব্যবহৃত ছিল, প্রযুক্তি মানুষকে সেটা প্রয়োগে অনুপ্রাণিত করছে, এই বিষয়টা অনুভব করে মনটা ভালো হয়ে গেল।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।
পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন
একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়
সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।
সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?
সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঘুষের ধর্ম নাই
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।
হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।
পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন