somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চীন দেশে খুনসুটি

১৭ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বানানা রাইড
আমার জীবনে যতোগুলো ক্রেজিয়েষ্ট অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, তার একটা হলো, সমুদ্রে ব্যানানা রাইড।
এবার চীনের সেনঝেন শহরে বিজনেস ট্রিপে গেছি। সপ্তাহান্তে এক চীনা কলিগ ও তার পরিবার সহ আরেক ইন্ডিয়ান কলিগ নিয়ে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে গেল আমাকে।
মানুষ খাল কেটে কুমির আনে, আমার চীনা কলিগ দু'ঘন্টা ড্রাইভ করে কলা সংক্রান্ত বিপদে সঁপে দিল নিজেকে।
ব্যানানা রাইড দেখতে আহামরী কিছু না।
বাতাস ভরা তিনটা বিশাল আকারের কলা, পাশাপাশি আটকে রাখা হয়েছে, কিছু দূরে একটা সী বাইকের সাথে মোটা দড়ি দিয়ে লাগানো, যেটা টেনে নিয়ে যাবে বায়বীয় কলা গুলোকে।
সমুদ্রের উচ্ছ্বল ঢেউয়ের সাথে বাতাস খেতে খেতে, গায়ে খানিক পানির ঝাপটা লাগাতে লাগাতে, মেঘলা, এলো আকাশ দেখতে দেখতে 'life is good' একটা ভাব আসবে, এই আশা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম 'lets have it!'
ব্যানানা রাইড থেকে যারা যারা নামছে, আট্টহাসিতে ফেটে পড়তে পড়তে বলছে, ওয়াও, ওয়াও!
আমি পাশের কলিগকে পা চাপড়ে বললাম, চলো যাই।
সে কাঁচুমাচু করে বলল, না গেলে হয় না?
আমি মুচকি হেসে বললাম, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
সে ফুঁ দিয়ে বলল, আরে না, পুরুষ মানুষের ভয় কি। তবে একটু রিস্কি। তোমার সেফটি আমার দায়িত্ব।
আমি ওকে বললাম, কিছু হবে না। চলো।
সে সমুদ্রের পারের চেয়ারে আয়েশী ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ে বললো, কাভি নেহি। তোমার কোন সমস্যা হলে আমার চাকুরী নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।
আমি ওকে টানতে টানতে ব্যানানার কাছে নিয়ে গেলাম। ঘোড়াকে পানির কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু পানি খাওয়ানো যায় না।
তবে এক্ষেত্রে সফল হলাম। তাকে ব্যানানায় চড়ালাম।
সাথে ইন্ডিয়ান বাঙ্গালী কলিগও উঠল। গায়ে গতরে কুস্তিগীর টাইপ। সে সাহসী প্রকৃতির। তবে সেফ সাইডে থাকার জন্য বলল, আমাকে মাঝখানের ব্যানানা দিও।
চীনা কলিগ মুখ ফ্যাকাশে করে বলল, আমিতো সাঁতার জানি না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, লাইফ জ্যাকেট আছে না? চিন্তা মাত। সে খুব ভরসা পেল বলে মনে হলো না। মিন মিন করে বলার চেষ্টা করলো, তবু, তোমার সেফটি ইস্যুটা নিয়ে...
ততোক্ষণে সী বাইক ছেড়ে দিয়েছে।
সামনে মোটা দড়ির আংটা ধরে ঝুঁকে থাকতে হবে, ঘোড়ার পিঠে চড়ার মতো।
প্রথম কয়েক সেকেন্ড স্পীড উঠার সময়টা মৃদুমন্দ বাতাস আর পানির হালকা ঝাপটা রোমাঞ্চ জাগাতে শুরু করে।
সেই হালকা আমেজের ব্যানানা কয়েক সেকেন্ডের মাথায় পুরোপুরি পাগলা হয়ে গেল। ঢেউয়ের সাথে প্রচন্ড ঝাঁকুনি একবার পুরো শরীর উপরে ছুঁড়ে মারছে, আরেকবার নীচে আছড়াচ্ছে কাপড় কাঁচার মতো।
আমার গলা শুকিয়ে গেল। প্রচন্ড জোরে আংটা ধরে রেখেছি, কিন্তু এই দানবীয় আছাড় পাছাড়ে বেশীক্ষণ ধরে রাখার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না।
এর মধ্যে ব্যানানা পঁচাত্তর ডিগ্রী কাত হয়ে গেছে। হাতে ধরা হুক ছেড়ে দিলে গাছের পাতা যেমন ভাসতে ভাসতে মাটিতে পড়ে, আমাদের সেভাবে পড়া লাগবে।
আমি দোয়া দুরুত পড়া শুরু করেছি।
আমার নাসারা কলিগেরা কি পড়েছে কে জানে, তবে জীবন দিয়ে কলা জড়িয়ে লেগে রয়েছে।
মানুষের মনস্তত্ব বোঝা মুশকিল।
প্রাথমিক আতংক কাটার পর আমরা জোরে জোরে হাসতে লাগলাম, সিলি 'এফ' ওয়ার্ড বলে অট্টহাসিতে খান খান হয়ে গেলাম।
এতে নার্ভাসনেস কাটল, 'বাহুত মাজা আয়েগি'।
তবে যাই হোক, হুক ধরে ঝুলতে হাত অবশ হয়ে গেছে। এর মধ্যে প্যান্টের হুক টুক খুলে গেল কিনা, এই আতংকে একবার হাতে ধরা বেনানার হুক ছুটে যাবার মতো অবস্থা হলো।
আমার চীনা কলিগরে বললাম, ওরে আস্তে চালাতে বলো। কাজের সময় আমাদের নানা বিষয়ে মতভেদ হয়। এই বিষয়ে, তাৎক্ষণিকভাবে সায় দিয়ে জোর গলায় বাইক ওয়ালাকে চিং পং করে কি যেন বলল। বাইক ওয়ালা স্লো করে আমাদের পাশে এসে কি যেন শুনল।
তারপর ব্যানানার কিছু সামনে গিয়ে আগের চেয়ে বেশী স্পীডে চালানো শুরু করল। সেই তীব্র গতিতে তিন খানা ব্যানানা রকেটের মতো পুরো নব্বুই ডিগ্রী এংগেলে আমাদের ছেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকল।
Azab at it's best!
সবকিছুর শেষ আছে।
অনন্তকাল পর এই আযাবের শেষ হয়ে আসল।
সমুদ্র তটের যতো কাছে আসি, হুক ধরে থাকা আঙ্গুলের ব্যাথা আর ব্যাথা মনে হয় না।
সমস্যা একটাই আমার নাক চুলকাচ্ছে প্রচন্ডভাবে। তবে তীরে এসে ব্যানানা সমাধির কোন মানে হয় না। শক্ত করে হুক ধরে থাকলাম।
তীরে নেমে, পরম আনন্দে নাক চুলকাতে চুলকাতে চীনা কলিগরে বললাম, what a nice ride!
চীনাদেরা মৌখিক গড়নের কারণে, তারা হাসে না কাঁদে বোঝা যায় না। সে বিশাল একটা শ্বাস ফেলে বলল, আরেকটু হলে তো গেছিলাম!

সাড়ে তিনতলা
চীনারা চার সংখ্যাটাকে খুব ভয় পায়।
এ জন্যে অনেক দালানের লিফটে চার নম্বর ফ্লোরের বদলে দেখা যায়, সাড়ে তিন!
আবার আট ওদের সৌভাগ্যের নাম্বার। আমরা যে অফিসে কাজ করতাম, সেটা একটা বিজনেজ পার্ক এরিয়ায়। দালানের নাম্বার আট। আমার সহকর্মী জানালেন, এই জন্য ওদের আবার বেশী ভাড়া গুনতে হয়।
ফিরে আসার দিন, নীচে নামার সময়, বলা নেই, কওয়া নেই, সেই 'লাকী' লিফট মাঝ পথে বন্ধ হয়ে গেল!
ইমার্জেন্সি অবস্থা বলে, লিফটের এসি বন্ধ হয়ে গেছে। লিফট ভর্তি লোকজন, প্রচন্ড গরমে কুল কুল করে ঘামছি। প্যানিক এটাক হবার মতো অবস্থা।
সাথের চীনা লোকজন খুব একটা ঘাবড়ালো বলে মনে হলো না। লিফটের হেলপলাইন স্পিকারে কল দিল শান্তভাবে।
সময়টা দুপুর। লাঞ্চ টাইম শেষের আশে পাশে।
একটা ব্যাপার নিয়ে চীনাদের কোন আপোষ নেই, আর তা হলো দুপুরের ঘুম। খাওয়ার পর চেয়ারে বসে আকাশের দিকে মুখ করে পাওয়ার ন্যাপ নেয়া এখানকার সাধারণ অভ্যাস।
পাওয়ার ন্যাপে প্রোডাক্টিভিটি বাড়ে বলে, প্রতিষ্ঠানগুলোও না করে না।
লিফটের একজন চ্যাং ব্যাং করে কি যেন বলল, ওপারের হেল্পলাইনের জন সম্ভবত দুপুরের পাওয়ার ন্যাপ নিচ্ছিল, ঝিমাতে ঝিমাতে কি জানি বলল।
সম্ভাব্য পাওয়ার ন্যাপ নেওয়া ইমার্জেন্সি হেল্পলাইনওয়ালার উপর তেমন ভরসা না করে একজন হাত দিতে লিফটের দরজা খুলে ফেলল। দেখা গেল, আমরা দুই ফ্লোরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় আটকে আছি। সেই ফাঁক দিয়ে টপাটপ সবাই বের হয়ে গেল।
লিফটের ইমার্জেন্সি নির্দেশনায়, নিজে দরজা খোলার ব্যাপারে কড়াকড়ি নিষেধ আছে। এভাবে সবাই বের হওয়া শুরু করলে আমি আর বেশী ভরসা করতে পারলাম না, লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
অত্যধিক উত্তেজনায় খেয়াল করলাম না, আটকে পড়া ফ্লোর সাড়ে তিন তলা ছিল কিনা।
ফেরার দিন বলে, আর দু'এক বারই সেই লিফটে ওঠা লেগেছে।
তিন সাড়ে তিনের ফক্করে না পড়ে দশ থেকে উলটো গোনার চেষ্টা করলাম।
এতে নাকি মাথা ঠান্ডা থাকে!

চীনের নতুন সিলিকন ভ্যালি
সেনঝেন শহরকে এখন চীনের নতুন সিলিকন ভ্যালি বলা হয়।
চীনের অন্যান্য উন্নত শহর বেইজীং বা সাংহাইয়ের মতো এতো উন্নত অবস্থা ছিল না সেনঝেনের, কিন্তু
মাত্র দু'চার দশকের ভেতরেই পুরো শহরটিকে খুব পরিকল্পিতভাবে তৈরী করা হয়েছে।
মানুষ দিন-রাতের যে কোন সময়েই এখানে নিরাপদে চলাফেরা করছে। আইন-শৃঙখলার উন্নত পরিস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
শহরে তেমন কোন ট্রাফিক জ্যাম চোখে পড়লো না, ব্যস্ত রাস্তাগুলোয় একাধিক লেন দিয়ে সুশৃঙখলভাবে গাড়ি যাচ্ছে।
এছাড়াও পুরো শহরে জালের মতো বিছিয়ে আছে এমআরটি ট্রেনের নেটোওয়ার্ক।
এমআরটির ভেতরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আবার এককাঠি সরেস। বিমান বন্দরের মতো ব্যাগ-ব্যাগেজ স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে হয়। ট্রেনের টিকেট হিসেবে প্লাস্টিকের কয়েন কিনতে হয়, ছোট একটা গর্তে স্ক্যান করা লাগে।
মূল শহরে আকাশছোঁয়া চোখ জুড়ানো দালান চোখে পড়বে।
একেবারে গোড়া থেকে পরিকল্পিতভাবে শহরটিকে তৈরী করার কারণে চীনের বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আলীবাবা, টেন্সেন্টসহ ছোটবড় দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে নিশ্চিন্তে বিস্তৃত হচ্ছে।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করে, এমন একাধিক মানুষের সাথে কথা বলে জানলাম, ওরা ভালো বেতন পায়। বাংলাদেশী টাকায় মাসে আড়াই লাখ টাকা মাসিক বেতন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কোন কোন প্রতিষ্ঠান এর চাইতেও অনেক বেশী দেয় দক্ষ সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের।
শুধু ওয়েব এপ্লিকেশন বানানোই নয়, রোবোটিক্স, আইওটি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স - কোনটাতেই না নেই ওদের।
প্রযুক্তিবিদদের অনেকেই নিজেদের টাকায় লোন নিয়ে সুন্দর মডেলের গাড়ি, বিলাসী ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে।
সব কিছু ঠিক আছে, কিন্তু সমস্যা একটা থেকেই যায়, ইংরেজীতে খুব দুর্বল ওরা। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে ট্রেনার এসে সে অভাবও পূরণ করার চেষ্টা চলছে।
এখানে ইংরেজী শিক্ষা দেন, এমন এক আমেরিকান বললেন, শুধু ইংরজী শিখিয়েই নিজের দেশের চেয়ে ভালো উপার্জন করছেন উনি। উপরন্তু নতুন একটা দেশে নতুন অভিজ্ঞতা ভালোই অর্জন করছেন।
প্রযুক্তিকেন্দ্রিক পেশাগুলোতে ভালো আয়-রোজগারের কারণে স্থানীয় অর্থনীতিও চাঙ্গা। হরেক রকম মার্কেট, বিনোদনকেন্দ্র, উন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রসার হয়েছে, সাধারণ মানুষের কাজের অভাব নেই।
চীনে যাওয়ার একটা বিপদ হলো, সেখানে গুগল, ফেসবুক কিছুই কাজ করে না (ভিপিএন দিয়ে যদিও ব্যবহারের চোরাই উপায় আছে, তবে খুব দরকার না হলে পর্যটকরা ও পথে যান না।)।
গুগল, ফেসবুক ব্যবহার না করা গেলেও ওদের নিজেদের সেরকম প্রযুক্তি আছে। সাধারণের জীবনেও প্রযুক্তি মিলেমিশে আছে।
একদিন অফিসে এক কলিগ বলছিল, এখানে ফ্রেশ ফ্রুট পাওয়া যায়। অফিসে সেই ফ্রেশফ্রুট আসতে কতোক্ষণ লাগবে, এটা ভাবতে ভাবতেই দশ বারো পদের কাটা ফল হাজির। এটা সম্ভব হয়েছে, আলাদীনের চ্যারাগ চীনে মোবাইল এপের কারণে।
আরেকদিন লাঞ্চ শেষে ফ্রেশ জুস খাবো ভাবছি, এক কলিগ নিয়ে গেল অরেঞ্জ জুসের ভেন্ডিং মেশিনে। পেমেন্ট দেবার পর, পাঁচ পাঁচ খানা সরস কমলা চিপে এক গ্লাস ঠান্ডা রস বের হলো। টিভি এডের মতো চুমুকেই যেন অনাবিল শান্তি!
সেখানকার ডিজেআই প্রতিষ্ঠান ড্রোন বানিয়ে হুলুস্থূল অবস্থা করে ফেলেছে। ক্ষুদে আকার থেকে শুরু করে বিশালাকৃতির ড্রোন শোভা পাচ্ছে শহরজুড়ে থাকা বহু শোরুমে। অবস্থা দেখে ড্রোনে মানুষ উড়িয়ে নেবার দৃশ্য দেখতে খুব বেশী অপেক্ষা করা লাগবে না!
স্থানীয় আলীবাবার সফলতা এখন বিশ্বজুড়ে কে না জানে। আলীবাবার অন্যতম বড় অফিস এই সেনঝেনে।
ওদের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন বাইডু চীনাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটা অংশ।
চীনের টেন্সেন্ট কোম্পানীর 'wechat' সেখানে তুমুল জনপ্রিয়। শুধু মোবাইলে চ্যাট করার জন্যই নয়, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটোয়ার্কের কাজও দিব্যি চলে ওটা দিয়ে।
চীনে প্রায় সব ধরণের লেনদেন হয় উইচ্যাট দিয়ে। যদিও ভিক্ষুক চোখে পড়েনি, তবে আমার ধারণা, ভিক্ষুক থাকলেও উইচ্যাট দিয়ে টাকা নিতো!

ভাষার বিড়ম্বনা
আমার প্রথম চীন যাত্রার আগে সবাই সাবধান করে দিয়েছিল, ওদের ইংরেজী জ্ঞান সম্পর্কে।
কাজেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম।
সিঙ্গাপুর থেকে একাই সিল্ক এয়ারে চীনের সেনঝেন শহরে সহি সালামতে পৌঁছুলাম। সৌভাগ্যবশত কোম্পানী আমার জন্য ড্রাইভারসহ গাড়ি পাঠিয়েছে। ড্রাইভার সাহেব আমার নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি তার সামনে গিয়ে তাকে চমকে দিয়ে বললাম, নি হাও মা (চায়না ভাষায় যার অর্থ কেমন আছ?)।
ড্রাইভার সাহেব আমার চীনা ভাষায় দক্ষতা দেখে বিমোহিত ও বিগলিত হয়ে গেল। কিন্তু এটা যে আমার স্টকে একমাত্র চীনা বাক্য সেটা আর পরিষ্কার করে বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
হোটেল পর্যন্ত পৌঁছাতে তেমন বেগ পেতে হলো না।
তবে যতদিন চীনে ছিলাম, চীনা কলিগদের কেউ না কেউ বডি গার্ডের মতো ভাষা গার্ড হয়ে ছিল।
এমন কি কোথাও দাম টাম বেশী চাইলেও চীনা ভাষায় চ্যাং ব্যাং বলে ঝাড়ি দিয়ে সুলভ ও প্রকৃত মূল্যে কিনতে সাহায্য করেছে।
কিন্তু মাঝে মাঝে মানুষ প্রকৃতই একা এই মহান সত্য আবিষ্কার করতে হয়েছে, এবং সেটা ভালো অভিজ্ঞতা ছিল না।
একবার অফিস শেষে ক্লান্ত লাগছিল বলে আগেই হোটেলে ফিরেছি। রাতে ঘুমানোর আগে ভাবলাম আশ পাশে কোথাও খেতে যাই।
সব রেষ্টুরেন্টে মেন্যু চাইনীজ ভাষায় লেখা। ছবি দেখেও খুব ভরসা করার কারণ নেই।
এ নিয়ে একটা গল্প আছে। এক বাংলাদেশী চীনে এক রেষ্টুরেন্টে ছবি দেখে মাটন বা খাসির মাংস অর্ডার করলো। খাবার সার্ভ করার পর সেটা খেতে খেতে তার কিছুটা সন্দেহ হলে, ওয়েটারকে খাবারের দিকে 'ব্যা ব্যা' করে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, এটা কি খাসি?
ওয়েটার দাঁত বের করে, ইশারায় মাথা নেড়ে উত্তর দিল, 'ঘেউ ঘেউ'!
এই গল্প মনে পড়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল।
বহুকষ্টে 'সী ফুড' টাইপ একটা রেষ্টুরেন্ট বের করলাম।
সীফুড স্যুপের অর্ডার দিলাম।
সার্ভ করা স্যুপ বেজায় ঠান্ডা।
তবু সৌভাগ্যবশত রেষ্টুরেন্টের লোকজনের ইংরেজীর দখল ভালো।
প্রায় দশ মিনিট লাগলো বোঝাতে, এটা গরম করে দিতে।
খাবার শেষে যখন বিল দিতে গিয়ে ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে আরো দশ মিনিট লাগলো বোঝাতে মানি রিসিট দিতে। কারণ এটা অফিসে জমা দিতে হবে রিফান্ডের জন্য।
তারা আরো পনেরো মিনিট ব্যয় করে, তাদের নিজস্ব চিংলিশে (চায়না + ইংলিশ) বোঝালো ওদের ক্যাশিয়ার প্রিন্টারে কাগজ শেষ।
আমি কিছুটা হতাশ দৃষ্টিতে তাকাতে তারা দয়া পরবশ হয়ে, আরো বিশ মিনিট ব্যয় করে বোঝালো, আমি চাইলে তারা পাশের দোকান থেকে অন্য রিসিপ্ট এনে দিতে পারে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।
রাত গভীর হতে শুরু করেছে। হোটেলে নিরাপদে পৌঁছলাম। লবি পর্যন্ত যেতে যেতে ছোট বাথরুম পেয়েছে। রিসেপশনে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম, ওয়াশরুম কোন দিকে।
প্রবল বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম, ওয়াশরুম মানে কি রিসেপিশনিষ্ট বুঝতে পারছে না।
এই হোটেল চীনের সবচেয়ে দামী ফাইভ স্টার হোটেলের একটা, সেই হোটেলের রিসেপশনে ওয়াশরুম কি বোঝানো যাচ্ছে না।
পরে টয়লেট ইত্যাদি সমার্থক শব্দ বলেও যখন কাজ হচ্ছে না, তখন ওকে ওর মাথার উপর হাত দিয়ে ইশারায় বুঝালাম ওর ম্যানেজারকে ডাকতে।
এদিকে আমার ইমার্জেন্সি অবস্থা। লবি থেকে আমার রুম সুদূর বহুদূর।
প্রায় তৎক্ষণাত ম্যানেজার হাজির। ওয়াশরুম দেখিয়ে কাঁচুমাচু করে বলল, স্টাফদের আরো ভালো ইংলিশ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করবে।
ম্যানেজারের পুরো বিনয় বাক্য শেষ হবার আগেই আমি ওয়াশরুমের দিকে দ্রুতপদে রওনা দিলাম।
প্রায়োরিটি ম্যাটারস!
তবে চীন থেকে বিদায় প্রাক্কালে একা একা যে বিপদে পড়েছিলাম, সে তুলনায় এই ওয়াশরুম বিড়ম্বনা ছিল নস্যি।
ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হলেও কোম্পানীর দেয়া গাড়িতে ভালোয় ভালোয় এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম।
লাগেজ চেক ইন করে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে ফ্লাইটের সময় কাছাকাছি আসতেই ইমিগ্রেশন কাউন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
সমস্যা হলো, ইমিগ্রেশন কাউন্টার কি জিনিস, এটা ইংরেজিতে কেউ বলতে পারছে না।
খুব ভরসা করে একটা এয়ারলাইনের কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
আমার প্রশ্ন শুনে ছোট চোখের চৈনিক সুন্দরী পিট পিট করে তাকালো। বিব্রত গলায় বোঝালো, আমি কি বলছি সে বুঝতে পারছে না।
এয়ার লাইনে ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করছে, এমন কেউ ইমিগ্রেশন কাউন্টার কি বুঝতে পারছে না, এটা ভাবিনি।
আমার মাথায় বাজ পড়লো। এদিকে ফ্লাইটের সময় কাছাকাছি চলে এসেছে।
আমার মরিয়া দৃষ্টি দেখে ছোট চোখের চৈনিক সুন্দরীর মন গলল। সে তার বসকে ডাক দিল।
বসও অবশ্য ইমেগ্রেশন কাউন্টার কি বুঝতে পারছেনা। তবে মাথা ঠান্ডা রাখলো। কাগজে ইংরেজি শব্দটা লিখে দিতে বলল আমাকে। সেটা নিয়ে নিজের মোবাইলে ট্রান্সলেটরে বসালো।
বেশ কতোক্ষণ পর বসও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দু'দিকে মাথা নাড়িয়ে অপারগতা প্রকাশ করলো।
সময় দ্রুত যাচ্ছে। আমি ঘামাচ্ছি।
ডুবন্ত লোক যেমন খড়কুটো ধরে টিকে থাকার চেষ্টা করে, আমি জলজ্যান্ত আরেকজন চাইনীজকে ধরলাম। দেবদূতের মতো সেই চাইনীজ পথ দেখিয়ে দিল।
মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে একাধিক চেকপোষ্ট পেরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন প্লেনে উঠলাম, আবিষ্কার করলাম, প্লেনে আমিই সবার আগে উঠেছি।
দ্বিতীয় যাত্রী আমার পাশ দিতে যেতে যেতে পরিষ্কার ইংরেজীতে হেসে হেসে বলল, চিন্তা মাত। চেক ইন যখন করেছ, তোমাকে না নিয়ে প্লেন ছাড়তো না।
আমি লম্বা দম ছেড়ে, ঘাম মুছতে মুছতে, জানলা দিয়ে সকালের আলোয় ঝলমলে সেনঝেন এয়ারপোর্টের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বললাম, সিসিয়া চায়না (চায়না ভাষায় সিসিয়া শব্দের অর্থ ধন্যবাদ!)।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১২:১৯
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×