(ফোটো - গুগুল)
মানুষের মনুষ্যত্ব দিনকে দিন যাচ্ছে কোথায়? বিয়ের অনুষ্ঠানে কেউ কেউ উচ্চ শব্দে গান বাজাবে, আশপাশের মানুষদের অসুবিধা হলে কিছু বলা যাবে না। বলা যাবে না মাইক বা সাউন্ড বক্সের শব্দ কমিয়ে দাও।
ধর্মের নামে রাতভর উচ্চ-শব্দে মাইক বাজবে। ওয়াজ-মাহফিল হবে। হিন্দি গানের সুরে হামদ-নাত গাওয়া হবে। দুরুদ পাঠের নামে, জিকিরের নামে, হরিনাম সংকীর্তনের নামে কিছু মানুষ কণ্ঠের জোর পরখ করবে। আর কিছু মানুষ অনুরাগী হয়ে কণ্ঠ মিলাবে। ধর্মের নামে, হরি-ধ্বনির নামে মাঝরাত অবধি কিছু মানুষের শোরগোলকে আনন্দ উল্লাসের নামে, ধর্মের নামে বৈধতা দিতে হবে। এ নিয়ে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, শালীন ভাবে বলাও যাবে না- মাইকের আওয়াজটা, সাউন্ড বক্সের ভলিউমটা আরো কমিয়ে দাও। কারণ, আমাদের ঘরে রোগী আছে। আমাদের ঘরে শিশু আছে। আমাদের ঘরে পরীক্ষার্থী আছে।
শব্দ দূষণ এক ধরনের অপরাধ। যা আমাদের দেশে হর-হামেশাই ঘটছে। কার ঘাড়ে দুটো মাথা এসবের বিরুদ্ধে কথা বলে? তাই হয়তো এসব নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায় না। ধর্ম বলে কথা। আনন্দ-উল্লাস বলে কথা। যদি বা কেউ এসব নিয়ে কিছু বলে, তো রক্ত দিয়ে, অপমান সয়ে, কখনো বা মৃত্যুকে বরণ করে খেসারত দিতে হচ্ছে। সংবিধান কি এমনটা বলে? নাকি সমাজের কোনো দায় নেই? নেই কোনো দায় রাষ্ট্রেরও?
কেন এসব হচ্ছে? এসবের পেছনে কলকাঠি হাতে আছে পুলিশ বিভাগ। আকাশে যত তারা, পুলিশের তত ধারা। এ প্রবাদটি পুলিশ বিভাগের অহংকার। তারা ইচ্ছে করলে খুনিকে নির্দোষ আর নির্দোষকে খুনি সাব্যস্ত করতে পারে। তার ওপর পুলিশের আত্মীয় হলে তো কথাই নেই। দারোগার শালার নায়ের মাঝির দাপটেও কাত হয়ে পড়তে হয় সেই প্রাচীন কাল থেকেই। বর্তমানে আছে ৫৭ধারা। ভারতে যেমন আছে টাডা আইন নামের এক জুজু। আমাদেরও নতুন জুজু হচ্ছে ৫৭ধারা। যে কারণে পুলিশ ইচ্ছে করলেই টাকার বিনিময়ে খুনের আসামী ছেড়ে দিতে পারে। ছেড়ে দিতে পারে শিশু ধর্ষককেও। ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ধর্ষককে বিয়ে করাচ্ছে ধর্ষিতাকে। এমন যদি হয় সমাজের কোথায় অপরাধ ঘটবে না? খুনের মামলার আপস রফায় পুলিশের ভূমিকার কথাও পত্রিকায় পাওয়া যায়। তাহলে কি আমরা সহমর্মিতা কথাটা ভুলে যাচ্ছি? অথচ পশুদের মাঝে এই সহমর্মিতার ব্যাপারটা এখনো রয়ে গেছে। নাকি পশুদের চেয়ে উত্তম বলেই কি পাশবিকগুণ সহমর্মিতা আমাদের মন থেকে মুছে দিচ্ছি?
তাহলে কি মনুষ্যত্বের চেয়ে স্বার্থটাই দিনকে দিন বড় হয়ে উঠছে আমাদের ভেতর? পুলিশের টাকার দরকার বলেই কি নিরীহ লোকজনদের ধরে নিয়ে নির্যাতন আর কঠিন মামলার আসামী করার ভয় এমন কি ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। সংবাদপত্র সব সংবাদই আমাদের জানায়। আর যেসব সংবাদ তারা সেন্সর করে বা চেপে যায়, সেসব সংবাদ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে খুব সহজেই। তাই গোপনে কিছু করবার দিন হয়তো শেষ হতে চলল। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় মানুষ কি সভ্য হতে হতে অসভ্যতাকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছে, নাকি মানুষ আসলেই জানোয়ার ছিল, উন্নত বুদ্ধির কারণে নিরীহ প্রাণীগুলোকে নাম দিয়েছে জন্তু-জানোয়ার?
বিয়ের অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে গান না বাজালে কি বিয়েটা হয় না? তাদের আনন্দ-উল্লাসের নামে অসভ্যতা করা কি এতটাই জরুরি ছিল যে, অসুস্থ মানুষের আর্তিও তাদের কানে পৌঁছালো না? পরন্তু ডেকে নিয়ে খুন করে ফেলবে? তোমার আনন্দের জায়গার অভাব হলে হাসপাতালের সব রোগীকে মেরে ফেলে কনসার্ট করবে? টাকার প্রয়োজনে তোমার কন্যাগুলোকে বিক্রি করে দেবে পতিতালয়ে? ভালো দাম পাবে বলে তোমার বৃদ্ধ বাবা-মাকে বিক্রি করে দেবে কঙ্কালের বাজারে? এমন সংবাদগুলো হয়তো খুব শীঘ্রই আমরা পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো।
এরই মধ্যে আমরা এমন অনেক সংবাদ পড়ে ফেলেছি, যেখানে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছে সন্তানেরা। একমাত্র সন্তান তার বাবা-মাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। অসুস্থ আর বয়স্কা মায়ের সেবাযত্ন করবার ভয়ে মাকে মেরে ফেলেছে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে। এমন ঘটনার কথা পত্রিকায় পড়েছি খুব বেশিদিন হয়নি। তারপরও কি আমরা মানুষ নাম নিয়ে গর্ব করতে পারি?
যে সন্তান বাপ-মা, ভাই-বোনদের ভরণ-পোষণের বিনিময়ে বলতে পারে, আমি টাকা-পয়সা দিয়ে তোমাদের সংসার না চালালে যে সম্পদ আছে তার সবই এতদিনে বিক্রি করে দিতে। সুতরাং তোমাদের সমূদয় সম্পদ এখন আমার নামে লিখে দাও। ভরণ-পোষণের নামে বাবা-মায়ের সম্পদ হাতিয়ে নেবার মতলবকে আমরা কী বলতে পারি?
যেই মা নিজেই নষ্ট হয়ে গেছে। যেই মায়ের কন্যাদেরও নষ্টদের খাতায় নিজের হাতে তুলে দিয়েছে, সেই মা যদি অন্যের সতীত্বের সনদ সন্ধান করে, তাহলে বুঝতে হবে সে মায়ের চেয়ে একজন পতিতার মর্যাদা অনেক বেশি।
স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও আরেকটি বিয়ে করে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা মানুষ অন্যের বিয়ের বৈধতা নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা রাখে কিনা আমার জানা নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী যখন প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুতে সংসারে মাথা উঁচু করে প্রবেশের উল্লাসে মত্ত হয়, সেই দৃশ্য কার কাছে কেমন লাগবে তা আশা করি ব্যাখ্যা করতে হবে না। কিন্তু অতটা নীচতা জঙ্গলের পশুদের মাঝেও দেখা যায় কিনা সন্দেহ।
সহমর্মিতার উদাহরণ মানুষের চেয়ে নিম্ন-শ্রেণির পশুদের মাঝেও অনেক বেশি দেখা যায়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের মাঝে এমন ব্যাপারটা মোটেও দেখা যায় না। সহমর্মিতার উদাহরণ তুলনামূলক ভাবে মানুষদের চেয়ে আজকাল পশুদের মাঝেই বেশি দেখা যায়। তাহলে সেসব মানুষ কেন নিজেদের মানুষ বলে দাবি করছে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের যা শিখালো, তা হয়তো তাদের মানুষ হবার পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। আসলে সভ্য কেবল পোষাকেই, শিক্ষায় নয়।
বলছিলাম শব্দ দূষণ নিয়ে। কীসের মাঝে কি, পান্তাভাতে ঘি-এর মতো কখন যে ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে আরম্ভ করেছি বুঝতে পারলাম না। যাই হোক, দিনকে দিন ধর্মের নামে, নানা উৎসব-অনুষ্ঠানের নামে, কখনো বা রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে দিন বা রাতের অনেকটা সময় মাইক বা সাউন্ড-বক্সের অত্যাচার আমাদের সইতে হচ্ছে। আমরা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করতে পারছি না। গুটি কয়েক মানুষকে বোঝাতে পারছি না। সভ্যতা নামের জাপানি মূলা কি আমাদের মেরুদণ্ড ক্ষয় করে দিচ্ছে? নাকি অপকর্ম করবার মানুষরা শক্তিশালী বেশি?
এখনও সময় হয়তো চলে যায়নি এসব অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার। সরকারী তত্ত্বাবধানে এসব নিয়ন্ত্রণ জরুরি। মাইক বা সাউন্ড-বক্সের শব্দ যেন অনুষ্ঠান-চত্বর পার হতে না পারে তেমন একটা নিয়ম থাকা প্রয়োজন। শব্দ-দূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি সুনির্দিষ্ট আইন অথবা নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। শব্দ মাত্রা যাতে অন্যের জীবনে সমস্যা হয়ে না ওঠে, সে বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।
হুজুর যখন ওয়াজ করেন- তাকে ভাবতে হবে যে, আশপাশে অনেক অমুসলিমও থাকতে পারে। ঠাকুর মশাই যখন হরি-ধ্বনি দেন বা কীর্তনের ধূয়া তোলেন, তখন তাকেও ভাবতে হবে যে, মন্দিরের আশপাশে অনেক অহিন্দুও বাস করে। মোটকথা ধর্ম বা অনুষ্ঠানের নামে মাইক বা সাউন্ড-বক্স বাজিয়ে অন্যের বিরক্তি উৎপাদনের অধিকার কারো নেই।
ফেসবুকেই হয়তো কারো স্ট্যাটাসে ছিল (হুবহু মনে নেই), পশ্চাদ্দেশ ঢাকলেই যদি সভ্য হওয়া যায়, তাহলে লেজওয়ালা প্রাণীরাও সভ্য। কাপড়ে শরীর মুড়ে রাখার নাম যদি হয় সভ্যতা, তাহলে গায়ে পালক আছে এমন সব প্রাণীও সভ্য।
কাজেই, আগে মনুষ্যত্বের মানদণ্ড ঠিক করি, তারপর না হয় সভ্যতার বড়াই করা যাবে।
জগতের সকল জীব সুখী হোক।
(*** লেখাটা কেমন অগোছালো রয়ে গেল। তবু সান্ত্বনা যে, কথাগুলো প্রকাশ করতে পেরে আরাম পাচ্ছি। )
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:০৮