জুতা কাহিনী
ভাবুনতো জুতা ছাড়া একটি দিনের কথা। নিশ্চিতভাবেই তা ভাবা যায়না। অথচ আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে জুতা ছাড়াই চলতো মানুষ। আজকে আমাদের পায়ে যে বর্ণিল জুতার বাহার, বিবর্তনের পথ ধরেই তা বর্তমান রূপ পেয়েছে। জুতার পেছনের কথা বলতে গেলেই চলে আসে রাজা হবু চন্দ্রের নাম। ইতিহাস হবু চন্দ্রকে জুতার আবিষ্কারকের স্বীকৃতি না দিলেও রাজার মতো বিপাকে পড়েই যে মানুষ জুতা নামক বস্তুটির দ্বারস্থ হয়েছিল তা অনুমান করেই বলা চলে। জুতার আদিমূল খুঁজতে গেলে চমকে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। মানুষের আঁকা প্রথম যে ছবির নিদর্শন পাওয়া গেছে, তাতেই জুতার প্রথম নমুনা পাওয়া যায়। অতএব জুতার এই কলিকালে এসে জুতার বয়স নির্ণয় একেবারেই দুঃসাধ্য।
সভ্যতার নিদর্শনের সবচাইতে পুরনো ইতিহাসে দেখা যায়, মিসরের উচ্চ শ্রেণীর মানুষ খড়ের স্যান্ডেল পড়তো। আন্দাজ করা হয় সময়টা ১২৫০ খিঃপূঃ। তবে ১৬০০-১২০০ খিঃ পূঃ এর মাঝামাঝি বর্তমান ইরান সীমান্তের কাছাকাছি একটি স্থানে নরম পুরো না ঢাকা জুতার প্রচলন হয়েছিল। এসব ঢাকা বলতে জুতো আসলে কেবল চামড়া দিয়ে পা ঢাকা যেতো। এগুলো 'মোকসিন' দিয়ে তৈরি থাকতো। গ্রীক নারীরা সাধারণত খালি পায়ে হাঁটতো অথবা স্যান্ডেল পড়তো। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তারা ঘরে নরম পাতায় ঢাকা জুতে পরতো। হেলেনিষ্টিক পিরিয়ডে অসম্ভব বিলাসী রূপ নিয়েছিল জুতা। এসব জুতার রং ছিলো লাল বা সাদা। খ্রিঃপূঃ ৫ শতকে গ্রীক প্রভাবে নক্সাদার বাঁকা ও উঁচু গোড়ালির জুতার চলন হয়।
এক সময় অলিম্পিকের প্রতিযোগীরা কিন্তু খালি পায়ে খেলায় অংশ নিতেন। জুলিয়াস সিজার বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে পরতেন সোনার সোলের বুট। এসব বুট কোনোভাবেই আধুনিক বুটের মতো ছিলোনা। বুড়ো আঙ্গুল থেকে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঢাকা এবং ফিতা দিয়ে বাধা থাকতো। কিন্তু পায়ের আঙ্গুলগুলো সবই থাকতো দৃশ্যমান। সম্রাট নীরো স্ত্রী প্যাপিয়াসকে লাথি মেরে খুন করেন। সেদিন নাকি তার পায়ে ছিলো সোনার সোলের স্যান্ডেল। আর এক গৃক ধনকুবের হেলিওগ্যাবলাস এক জুতা দ্বিতীয় দিন পরতেন না। তবে সাধারণত রূপার সোলের স্যান্ডেল তার পায়ে শোভা পেতো।
রোমানরাই প্রথম জুতা ব্যবসায়ীদের একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাদের জুতাগুলো হতো সেক্স ও পদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম। দুই পায়ের মাপ এক রকম হয় না। রোমানরা সেই অনুযায়ী জুতা বানাতো। তাদের জুতা সাধারণতঃ চামড়া দিয়ে তৈরি থাকতো। তবে সোনা-রূপাতো থাকতো বটেই। হীরা জহরতও বসানো থাকতো অনেক সময়।
সেনাবাহিনীতে কাঁটা বসানো জুতা পরতো। শুধু জুতার উপর দিকটা নয়। জুতার তলাটাও তাদের কাছে ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনীর পদস্থ্য অফিসারেরা মাটিতে জুতার ছাপ ফেলার অর্থ ছিল তাদের পদচিহ্ন ধরে পিছনের সৈন্যদের এগিয়ে যাওয়া। আর জুতার তলায় প্রিয়জনের ছবি আঁকা হতো অথবা ছাঁচে ধাতু ঢেলে করা হতো। মিসরে আবার শত্রুর ছবি থাকতো জুতার নীচে। অর্থাৎ শত্রুকে পিষে মারার প্রতীক। ফারাওরা যদি কাউকে তার জুতাতে চুমু দিতে অনুমতি দিতেন, তাহলে সেই ব্যক্তি খুবই সম্মানিত বোধ করতেন। সমাজে তার মান বেড়ে যেতো!
জুতা প্রয়োজন থেকে ফ্যাশন ওয়্যারে রূপান্তরিত হওয়ার ইতিহাস আজ অনেকটাই ধোয়াচ্ছন্ন। ফ্যাশনওয়্যার হিসেবে জুতা সম্ভবতঃ অস্ট্রিয়ান নাইটরা প্রথম ব্যবহার শুরু করেন। তাদের লোহার জুতার ছুঁচালো অংশটি পরিহার করে সেটাকে আরো বেশি ব্যাবহার যোগ্য করে গড়ে তোলেন। ১৩০৫ সালে রাজা প্রথম অ্যাডওয়ার্ড জুতার মাপ সম্পর্কে ডিক্রি জারি করেন। এর ফলে ১ ইঞ্চি (২৫ সে. মি.) সমান ৩টি শুকনো যবের শীষ ধরা হয়। যতোটি যবের শীষ পায়ের মাপের জন্য লাগতো, সাইজ নম্বর হতো তাই। এই ইংলিশ নিয়ম পরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৪ ও ১৫ শতকে অসম্ভব চোখা ও লম্বা জুতার প্রচলন হয়। এতো লম্বা ও চোখা হতো যে হাঁটাহাটিতে ঝামেলা হতো। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড আইন জারি করেন জুতা তীক্ষ্ণতা ২ ইঞ্চির বেশি হতে পারবে না। রাজা দ্বিতীয় রিচার্ডের সময় এ ধরনের জুতা আবার ফিরে আসে। এর পোষাকী নাম রাখা হয় "ক্রাকোজ"। এর তীক্ষ্ণতা ১৮ ইঞ্চিরও বেশি হতো কখনো কখনো। ১৫ শতকের শেষের দিকে চোখা জুতা গোল হতে শুরু করলো। ১৬ শতকে ছেলেদের ডিজাইনের চ্যাপ্টা মতো হওয়া শুরু করলো। এ সময় ডিজাইনের বাহার বেড়ে যায়। কর্ক বা চামড়ার সোল, উপরটা হতো ভেলভেট, সিল্ক অথবা চামড়ার। জুতার লাইনিং কেমন তা দেখাবার জন্য সেটা সামান্য ছেরা থাকার রেওয়াজ দেখা দেয়। মেয়েদের জুতাও ছিল তার কাছাকাছি। তবে সেগুলো অতটা উন্নত ছিলোনা। পরতের পর পরত সেই জুতা গাউনে ঢাকা থাকতো। দেখার কিছু ছিল না।
১৫৯২ সালে অদ্ভূত এক ধরনের জুতা পরতো অস্ট্রিয়ান মহিলারা। শ্যাপলিন নামের সেই জুতার নীচে থাকতো কাঠের একটা বার লাগানো, যা তাদের মাটির থেকে কমপক্ষে আধা ফুট তুলে রাখতো। ১৭ শতকে পুরুষরা জুতায় সোনার পাপড়ির গোলাপ লাগানোর ফ্যাশন চালু করেছিল। ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুই এই জুতার প্রবর্তন করেন। ১৯ শতকের মাঝামাঝি কোনো পুরুষের যদি জুতা ৫০ জোড়ার কম থাকতো তাহলে তাকে পশ্চাদপদ মানসিকতার ভাবা হতো। আমেরিকার নারী ও পুরুষ সকলেই উঁচু হিল দেওয়া শক্ত চামড়ার জুতা পরা শুরু করে। ইউরোপে ১৭ শতকে বুট পরতেও দেখা গেছে কখনো কখনো। ডিউক অব ওয়েলিংটনের অনুসরণে ওয়েলিংটন বুট এ সময় আত্মপ্রকাশ করে। এই বুট তখন চামড়া দিয়ে তৈরি হতো। ১৭৫০ সালে ফ্রান্সের 'কমতে দ্যখত' নামক এক ব্যক্তি বকলস আবিষ্কার করেন। বকলস জুতায় নতুন মাত্রা এনে দেয়। ইংল্যান্ডে বকলসকে কেন্দ্র করে একটি শিল্প গড়ে উঠে। বার্মিংহামের আশপাশে ৪০ হাজার লোক এ শিল্পের সাথে জড়িত হয়ে যায়। ১৮ শতকে বুটের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে বকলস প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে।
১৭৬০ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে জুতা কারখানা স্থাপিত হয়। তখনো জুতা সেলাই ও কাটিং মেশিন আবিষ্কৃত হয়নি। ১৭৯০ সালে প্যাটেন্ট লেদারের উদ্ভব হয়। নির্মাতারা একে লুফে নেয়। টমাস জেফারসন ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে রাজা চতুর্দশ লুই ও রাণী মারি আতোয়ানেতের খরচের বহর দেখে আতংকিত হয়ে গিয়েছিলেন। রাজা ও রাণী পোশাক ও জুতা খাতে বিপুল পরিমাণ খরচ করতেন। জুতা অসম্ভব পছন্দ করতেন রাজা লুই। তিনি ছিলেন বেঁটে। উচ্চতায় সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো। আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি হিলের জুতা পরতেন তিনি। লাল রঙ তখন রাজবর্ণের মর্যাদা পেতো। রাজার জুতার হিল লাল ভেলভেটে মোড়া থাকতো। রাণীর জুতা ছিল কয়েক হাজার জোড়া। কোন জামার সাথে কোন জুতা মানানসই তার ক্যাটালগ করেছিলেন বলে জানা যায়। সেই আমলে ছেলেদের জুতার হিল এমন উচ্চতায় ঠেকেছিল যে লাঠির সাহায্য ছাড়া সেগুলো পরে হাঁটা ছিল একপ্রকার অসম্ভব।
ফরাসি বিপ্লবের পর জুতা আস্তে আস্তে মাটি ছুঁতে শুরু করে। লন্ডনে সে সময় নারী-পুরুষরা হালকা জুতা পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। এতে আবার রোজ বার্নিশ করতে হতো। ১৮ শতকের মধ্য ভাগে হিল জুতা আবার ফিরে এসেছিল।১৯ শতকে ভিক্টোরিয়া যুগে মেয়েদের জুতার উন্নতি চোখে পড়তে থাকে। এর আগে মেয়েদের জুতা তৈরি হতো সাটিন বা ব্রোকেড দিয়ে। এসব জুতা পড়ে বাইরে বেরোনোর উপায় ছিল না। ১৮৩৮ সালে ফরাসী কাউন্টেনসে মেয়েদের পাম্পসু ডিজাইন করেন। এ শতকের মাঝামাঝিতে ছেলেদের বুটে হিল যুক্ত হয়। সেই জুতা ঘোড়ায় চড়ার উপযোগী বলে জনপ্রিয়তা পায়। ১৮৩৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়ার নিজস্ব জুতা নির্মাতাও ডিজাইনার ইলাস্টিক দেওয়া জুতা তৈরি করেন। তারও আগে তিনি প্রিন্স অ্যালবার্টের জন্য লেস লাগানো জুতা ডিজাইন করেছিলেন। তবে সেই আমলেও জুতা নিয়ে বিড়ম্বনার কোন কমতি ছিল না। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে জুতার বিজ্ঞাপনে আশ্বাস দেওয়া হতো জুতা পায়ের কোন ক্ষতি করবে না। চীনের মেয়েদের লোহার জুতা পড়িয়ে রাখা হতো তাদের জৈবিক আকাঙ্খাকে নিবৃত্ত করার জন্য। চোখা জুতার আমলে ঐ ধরনের জুতা নিয়ে গির্জায় ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। চোখা জুতা বিকৃতকামীদের প্রিয় ছিল বলেই ধারণা করা হয়।
জুতা বললেই চলে আসে মুচির আর চর্মকারদের কথা।
চর্মকার বৃত্তিধারীদের পেশাকে এক সময় দারুণ মর্যাদা দেয়া হতো। সেই সময় মুচি হতে চাইলে ৭ বছর ওস্তাদ মুচির শাগরেদ হয়ে থাকতে হতো। মধ্যযুগে তারা প্রথম সংঘবদ্ধ রূপ লাভ করে। জুতা নির্মাণ করে বিশেষ ডিজাইনার হওয়াটা ১৮৫৮ সাল থেকে শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। এ সময় চার্লস ফ্রেডবিক ওয়র্থ প্যারিসের রু দ্য লা পে-তে কোচর হাউজ খোলেন। ১৮৫৫ সালে প্যারিসেই দোকান খোলেন পিনে। তার জুতা এতোটাই চাহিদার শীর্ষে ছিল যে, মহিলারা একেকটি জোড়ার জন্য ১ হাজার ডলার দিতেও কবুল ছিল। ১৮৯০ সালে জোসেফ উইলিয়াম ফস্টার প্রথম স্পোর্টস স্যু তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে তার নাতি কারখানার নাম রাখেন রিবক। বিশ শতকে এসে জুতা পুরোপুরি মেয়েদের মর্জিমতো তৈরি হতে থাকে। এই শতকের বিশের দশকে পাম্প স্যু'র বদলে অ্যাঙ্কেল হাই জুতার জোয়ার আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা ইউরোপ অর্থনৈতিক দুর্যোগে পড়ে। তখন "কগ" নামে এক ধরনের কাঠের জুতার প্রচলন হয়। বিশ শতকের গোড়া থেকেই ডিজাইনার স্যু'র চল শুরু হয়। প্রায় সবগুলো বড় কোম্পানিই তাদের ব্র্যান্ডর জুতা বাজারে ছাড়ে। আজকে বাঘা বাঘা সব জুতা তখনই সকলের সামনে আসে। প্রথমেই আসে বাটা ব্র্যান্ডের নাম। স্পোর্টস স্যু ব্র্যান্ডের মধ্যে নাইকি, এডিডাস, রিবকও এই সময়েই প্রতিষ্ঠা পায়।
আমরা চাই বা না চাই আমাদের দৃষ্টিটা একসময় গিয়ে পড়ে জুতার উপর। আর আপনার এই জুতাখানা যদি তেমন "দর্শনধারী" না হয় তবে কিন্তু হাল ফ্যাশনের শার্ট-প্যান্ট গায়ে চড়িয়েও আপনি গোল্লা পাবেন। তাই জুতার ব্যপারে আপনাকে হতে হবে একদম সিরিয়াস। উপযুক্ত যত্ন-আত্তির অভাবে দামী জুতাও অকাল বৈধব্য বরণ করতে পারে। কাজেই আপনার প্রিয় জুতার জুতার যত্ন নিতে ভুলবেননা।
তথ্য সুত্রঃ উইকেপিডিয়া, হিস্টরী অব সুজ(ইন্টারনেট)।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


