মে দিবস; প্রেক্ষিত বাংলাদেশঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মত অনেক ঘটা করে আমাদের দেশেও পালিত হয় মহান মে দিবস। রাস্ট্র প্রধান, সরকার প্রধান, শিল্প কারখানার মালিকসহ সবাই অনেক আশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতি দেন শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য- যা শুনতে খুব ভালো লাগে।
আমরা জানি- ১৮৮৬ সালে যুক্তরাস্ট্রের হে মার্কেটে ৮ ঘন্টা কর্ম দিবসের দাবীতে আন্দোলন করেছিলেন শ্রমিকেরা। তাদের সেই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন শ্রমিক প্রান হারান। তাদের সেই আত্মত্যাগের ফলেই যুক্তরাস্ট্রের শিল্প মালিকেরা শেষ পর্য্যন্ত শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা শ্রমের দাবী মেনে নিয়েছিলেন। তখন থেকে পুঁজিবাদী বিশ্বে এই দিনটি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য নাহলেও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ঘটা করে পালন করা হয় মহান মে দিবস।যদিও এখন তা অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে। হয়তবা দেশে দেশে এখন শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিত সপুর্ণ ভিন্ন।
দিনে ৮ ঘন্টার বেশী কাজ নাকরার দাবি তাদের জন্যই অর্জিত হয়েছিল- যারা কলে-কারখানায়, অফিস আদালতে কাজ করতেন এবং সপ্তাহান্তে বেতন পেতেন। কিন্তু আমাদের দেশের অগনিত সাধারণ শ্রমিকের কোন লেবার 'ল, অফিস-আদালত, কোন কারখানা নেই। তাদের শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্ত নেই। পরের দিনের কাজের নিশ্চয়তা নেই। তাদের উদায়স্ত পরিশ্রম করতে হয়। তাদের কর্ম ঘন্টা নেই, তাদের দিন-রাত বলে কিছু নেই।
এই যে দুঃসহ গরমে নাকাল গোটা জনপদের মানুষ; তাতে কি দাড়ানোর জো আছে সাধারন শ্রমিকের? যে শ্রমিকেরা ঠেলায় ঠেলে নিয়ে যায় নাগরিকের প্রয়োজনের পণ্য, যে নারী শ্রমিক দুধের শিশুকে তপ্ত বালুতে শুইয়ে রেখে দিনভর ইট ভাংগে সুরম্য ভবন নির্মাণের জন্য, যে শিশু শ্রমিক(মিন্তী)নিউ মার্কেট, কাওরান বাজার কিম্বা সোয়ারি ঘাটে মালিকের পণ্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানন্তর করে- এই দুঃসহ গরমে তার নিত্ত দিনের কাজের কোন নিস্তার নেই। মেস বাড়ি, বাসা বাড়ির ছুটা বুয়ার একদিনের জন্যও ছুটি নেই। জীবিকার তাড়নায় তাদের কোন বাধা ধরা সময়ের নিয়ম নেই, কাজকে অস্বীকার করার কিম্বা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ার কোন সুযোগ নেই। দিনান্তে যা রোজগার তাই দিয়ে টেনেটুনে চলে তাদের সংসার। একদিন রোজগার বন্ধ মানেই- একদিন পরিবারের সকলের উপোষ থাকা।
কিন্তু এই হাড়ভাংগা খাটুনির দিনমজুরেরাই নগরীর স্বাচ্ছন্দের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। গরমের স্বস্তির উপকরণ হয়তবা একদার সস্তার ফল তরমুজ। সেই তরমুজ পাইকারী বাজার থেকে পাড়ায় পাড়ায় বয়ে আনবে সেইসব মুটে মজুর! কিন্তু সুস্বাদু একফালি তরমুজ খেতে পায়না গরিব দিনমজুর। সুয়ারেজ লাইন নস্ট হয়েছে- মেরামত করবে সেইসব মুটে মজুর! তানাহলে নাগরিক জীবনে ঘটেযাবে অনেক অনর্থ। কিন্তু মুটে মজুরের জীবনের, জীবন সংগ্রামের অবর্ণিত করুণ কাহিনী কোনদিন ভদ্রসমাজের কাছে তুলে ধরা হয়না। তাদের দুর্দশায়, অসুখ বিসুখে, তাদের অমানবিক জীবনযাপনের দুর্দশায় সাহায্যের হাত বাড়ায়না বিত্তশালীদের কেউ। ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত তাদের দিন বদলের সনদ নিয়ে হাজির হতো বড়বড় রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র ভোটের সময়। এখন দেশে ভোট প্রথা বলে কিছু নাই তাই আমজনতার কাছে ভোট চাইতে যাওয়ারও প্রয়োজন নাই।
দেশের সব অনিয়ম "ডিজিটাললী" বেড়ে যায়, বড় লোক আরো বড় হয়, পলিটিক্যাল টাউট অসহায় মানুষকে ঠকিয়ে ডিজিটাল স্পীডে টাকার পাহাড় গড়ে। কিন্তু অভাগা দিন মজুরদের ভাগ্যের চাকা বদল হয়না "এনালগ" পদ্ধতিতেও! তাদের জীবনের চাকা বদলে দেবার জন্য না সরকার, না নাগরিক, না কোন ভিন্ন কর্তিপক্ষ আছে। শুধু মাত্র ১ মে আসলেই আমরা পত্রিকার প্রথম পাতায় তাদের লড়াইয়ের ছবি দেখি। প্রচন্ড রোদে খালি গা, ছিন্ন ভিন্ন লুংগী পরা, উত্তপ্ত পীচঢালা পথে খালি পায়ে ঠেলা ঠেলতে ব্যস্ত, রিকশার প্যাডেল মারতে ব্যস্ত- তাদের প্রতিটি লোম কুপের ঘামের ফোঁটার শিল্পীত সব ছবি তোলায় ব্যস্ত আমাদের পেশাদার সাংবাদিক ফটোগ্রাফার বৃন্ধ। সেই সব ছবিগুলোও কখনো কখনো ফটোগ্রাফারের ভাগ্যের চাকা খুলে দেয়; কিন্তু শ্রমজীবি মনুষগুলোর ভাগ্য অপরিবর্তনীয় থেকে যায়।
ঠেলার চাকা ঘোরে, রিকশার চাকা ঘোরে। যে শ্রমিক যানবাহনের চাকা সচল রাখে, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে; কিন্তু সেইসব শ্রমজীবী মানুষের জীবনের চাকা জগদ্দল পাথরের মতো স্থির হয়ে থাকে- যা কিছুতেই সচল হয়না।
সচল হবেনা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


