প্রথম রোজার কোনো স্মৃতি মনে নাই, তবে ছেলে বেলায় রমজান মাসে রোজা নিয়ে কিছু স্মৃতি মনে করে নিজেকে খুবই হাস্যস্পদ মনে হয়!
আমাদের গ্রামের বাড়িটাকে গ্রাম বলা যাবেনা আবার থানা শহরও বলা যাবেনা, তবে স্বাধীনতা পূর্ব একটা বিখ্যাত গঞ্জ। পৌষ-মাঘ মাসে জমির ফসল ভাগবাটোয়ারা করতে চাচারা সবাই গ্রামের বাড়িতে যায়। সেবার রোজা শুরু হয়েছিল পৌষ-মাঘ মাসে। আমি চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। সবার স্কুল কলেজ ছুটি হয়ে গিয়েছে। সেই সুযোগে এবার গোটা পরিবার রোজা শুরুর কয়েক দিন আগেই গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি। এখন শীত যেমন টেরই পাওয়া যায় না, আমাদের ছেলে বেলায় এমনটা ছিলো না। তখন শীতকালে হাড়কাঁপানো শীত পরতো। গ্রামের বাড়িতে সকাল বেলা পুকুর খালের পানিতে ধুমা(জলীয়বাষ্প) উড়তো।
যেহেতু আমি ছোট এবং গ্রাম/গঞ্জের তেমন কিছুই চিনি-জানিনা, ভালো সাতারও জানিনা তাই আমাদের বাড়ির কেয়ার টেকার চাচার ছেলে মোস্তফা এবং আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেবের ছেলে শহীদকে সব সময় আমার সাথে থাকার জন্য বলে দেওয়া হয়। মোস্তফা এবং শহীদ দুজনের বয়সই ১৩/১৪ বছরের মধ্যে। তখন গ্রামের বেশির ভাগ ছেলেরা মাদরাসায় পড়তো। মোস্তফা, শহীদ দুজনেই মাদরাসায় পড়ে। ফজরের নামাজ আদায় করতে আমি পুকুর ঘাটে অযু করতে যেয়ে দেখি- আমার বয়সী বেশ কিছু মাদ্রাসার ছেলে অযু করছে কিন্তু পা ভেজায় না। এমনকি আমার দুই গাইড মোস্তফা, শহীদও অযু করতে পা ভেজায় না। আমাকেও মাদরাসার পিচ্চি ছেলেরা বললো- 'এই শীতে পা না ভেজালেও অযু হবে- কিন্তু কাউকে বলা যাবে না"! আমিও ওদের দেখাদেখি ফজর এবং এশা নামাজে অযু করার সময় পা ভেজাতাম না। এই পা না ভেজানোর কথা কেউ কারোর বিরুদ্ধে মসজিদের হুজুর কিম্বা পরিবারের কাউকে বলতাম না। কারণ, সবার স্বার্থ একই।
এবার আসি রমাজান মাসের রোজায়।
তখন আমাদের বৃহত্তর যৌথ পরিবার। গ্রামের বাড়িতে আমার তিন চাচা-চাচীর সাথে একদংগল সন্তান সবাই ঢাকা থেকে গিয়েছি। আমাদের চাচাতো ভাই বোনদের নিয়ে প্রায় কুড়ি জন। ভাই বোনদের মধ্যে আমিই বয়সে ছোটো। আমার চারজন চাচাতো ভাই ছিলেন আমার থেকে ৩ বছর থেকে ৬ বছরের বড়ো। দুইজন ৭/৮ বছরের বড়ো এবং সবাই স্কুল কলেজ ছাত্র। এদের প্রায় সবাইকেই জোর করে রোজা করতে বাধ্য করা হতো। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ গোপনে খেয়ে নিত।
কম বয়স বলে আমাকে কেউ রোজা রাখার জন্য বলে না তবুও আমি সোৎসাহে রোজা পালন করি। আমার উপর সবাই খুশী! আরও একটু ছোট সময় রোজা রেখে কখনো খুব ক্লান্ত হয়ে গেলে চাচা চাচী, বুবু বলতেন- "তোমার মতো ছোটরা দুই ভাগে রোজা করতে পারে- সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। দুপুরে খেয়ে আবার ইফতার পর্যন্ত কিছু না খেলেই তোমার রোজা হবে!"
ছেলে বেলা থেকেই আমি নামাজ রোজা করতাম যতটা না সওয়াব প্রাপ্তির আশায় তার থেকে ঢেড় বেশী পড়াশোনা থেকে কিছুটা রিলিফ পাওয়ার আশায়। পরিবারে ছোটরা নামাজ রোজা করলে তাদের প্রতি ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্ত মুরব্বিদের স্নেহ ভালোবাসা বেশী পাওয়া যায়- আমি সেই সুযোগটা নিতাম। কিন্তু দুই গাইড মাদরাসার ছাত্র মোস্তফা ও শহীদ বললো-"দোকানে যেয়ে কিছু খেয়ে অর্ধেক অর্ধেক রোজা রাখার যায়- আমরা এভাবেই রোজা রাখি, কাউকে বললে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে"!
যেহেতু আমার বড়ো কাজীনদের কেউ কেউ রোজা করতে চাইতো না, তাই ওদের প্রায় নিয়মিত ভর্ৎসনা শুনতে হতো। দুই একজন লুকিয়ে ছাপিয়ে ধুমপানেও অভ্যস্ত ছিলো। কিন্তু আমাদের ভাই বোনদের মধ্যেই ক্ষুদে গোয়েন্দারা বাবা, চাচা-চাচীদের কাছে রিপোর্ট করে দিতো। ধরা পরলে শাস্তি ছিলো কঠিন!
এতোসব কঠিন নিয়মের মধ্যে আমি নিয়মিত রোজা রেখে সবার আনুকুল্যে একটা আলাদা পজিশন নিয়ে ঘুরে বেড়াই। আমাকে কোনো কিছুর জন্য আবদার করতে হয়না বরং কিছু চাওয়ার আগেই আমি পেয়ে যাই! আমার প্রতি এমন বাড়তি আনুকুল্যে আমার বড়ো কাজীনদের (যারা রোজা না রাখার জন্য বকা খায়)হিংসা এবং রাগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে.....
রোজা রেখেও আমার শারীরিক তেলতেলে ভাব কমেনা। সারাদিন রোজা রাখার পরেও আমার চেহারায় কোনো ক্লান্তির ছাপ পরেনা! কাজীনদের অভিযোগ, "হিমু রোজা রেখে গোপনে গোপনে নিশ্চই দোকানে/বাজারে যেয়ে কিছু খায়, তা না হলে ও এতো তরতাজা থাকে কি করে"!
আমার বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগ শুনে আমি কান্না করি....
আমি 'খেয়ে রোজা রাখি' এই অভিযোগের কেউ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনা। ছোট চাচা আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, বড়ো চাচা কপালে চুমু দিয়ে দোয়া করেন।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে উল্টো ওরা আরও বকা খায়। বড়ো চাচা সবাইকে ডেকে 'হিমুর মতো আদর্শ ছেলে' হতে উপদেশ দেন।
বাড়িতেই একটা ছোট মসজিদ কাম মক্তব আছে। তারপরও আমি মোস্তফা, শহীদ এবং গ্রামের অন্যান্য ছোট ছেলেদের সাথে কখনও দল বেধে হেটে কিম্বা সাইকেল চালিয়ে জোহরের নামাজের জন্য বড় মসজিদে মসজিদে যাই....।
এভাবেই চলছিলো আমার "ভালো ছেলে" উপাধি পাওয়া সেলিব্রিটি জীবন....
আমি টের পাই - আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে কাজীনরা বকা খেয়েছে ওরা আমার উপর রেগে থাকলেও চাচাদের ভয়ে আমাকে কিছু বলতে পারেনা। তবে আমাকে চোখে চোখে রাখছে.....
পরবিতো পর মালীর ঘাড়ে....
একদিন হাটবারে জোহরের নামাজ শেষে বাজারে আমি মোস্তফা, শহীদ মোস্তফার চাচার হোটেলের পিছনে বসে গরুর গোসত দিয়ে ভাত খাচ্ছি.....খপ করে আমাকে বমাল ধরে ফেলে আমার চাইতে বয়সে ৮ বছরের বড়ো দুই চাচাতো ভাই।
আমাকে হাত ধোয়ারও সময় দেয়নি! একভাই ভাতের প্লেটসহ আমার হাত ধরেছে, আর এক ভাই আমাকে চ্যাং-দোলা করে তুলে নিয়ে সোজা বড়ো চাচার সামনে.....

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


