সেতুবন্ধন....
আমার ছেলে বেলার প্রমত্ত হলতা নদী। নদীর দুই তীরে দুই জেলা সীমানা। পূর্বে পটুয়াখালী জেলার বামনা থানা এবং পশ্চিমে বরিশাল জেলার মঠবাড়ীয়া থানা। বর্তমানে পটুয়াখালী জেলা ভাগ হয়ে বামনা উপজেলা পরেছে বরগুনা জেলায় এবং বরিশাল জেলা ভাগ হয়ে মঠবাড়ীয়া উপজেলা পরেছে পিরোজপুর জেলায়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এই এলাকার যোগাযোগ ব্যাবস্থা অত্যন্ত দূর্গম ছিলো। যাতায়াতের ভরসা ছিলো ধানক্ষেতের আইল ধরে পায়ে হাটা কিম্বা ছোট ছোট নৌকা। তবে জেলা-মহাকুমা ও থানা প্রশাসনের স্পীড বোট ও ছোট ছোট লঞ্চ চলাচল করলেও যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। এই এলাকা স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময়কাল পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল সেই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে সর্ববৃহৎ মুক্তাঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারণ্য ছিলো। আমাদের বৃহত্তর যৌথ পরিবারের স্বজনদের একাধিক স্মল আর্মস/গান(পিস্তল, পয়েন্ট ২২ রাইফেল এবং বন্দুক) নিয়ে এই অঞ্চলে মুক্তি যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।
পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের নয় নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টার ছিলো বামনা থানার বুকাবুনিয়া, সিংরাবুনিয়া এবং চালতা বুনিয়া নামক তিনটি ইউনিয়ন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই দুই থানা জুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড়ো Strategic Hub ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের জন্য ইন্ডিয়া থেকে আসা ছোট ছোট অস্রগুলো এখান থেকেই দুই জেলার বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প তথা মুক্তি যোদ্ধাদের ইউনিটে সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারদের নির্দেশে আমি নিজেও বিভিন্ন থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নৌকায় করে অস্র পৌঁছে দিয়েছি।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সাত মাস সময়কাল আমি অনেক বিখ্যাত মুক্তি যোদ্ধাদের ফুট-ফরমায়েশ খাটার সৌভাগ্যের অধিকারী একজন কিশোর। এই ক্যাম্পেই আমি দেখেছি- বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন/মেজর শাজাহান ওমর (বীর উত্তম), লেঃ / মেজর জিয়াউদ্দিন (বীর উত্তম), ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম (বীর প্রতীক) ছাড়াও অনেক বিখ্যাত মুক্তি যোদ্ধাদের। একদিন হঠাত করেই কিছু সময়ের জন্য এসেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল।
আমার যতদূর মনে আছে, অক্টোবর ১৯৭১ এর শেষ দিকে একটি পাকিস্তানি গানবোট বামনা-পাথরঘাটা এলাকার নদীর চরে আটকে গিয়েছিল। গানবোটে ২০/২৫ জন পাক সেনাদের সাথে রাজাকার ছিলো ১১০ জন। ততকালীন দুই জেলার হাজার কয়েক মুক্তি যোদ্ধা নদীর দুই তীর এবং অসংখ্য নৌকা যোগে গানবোট ঘিরে আক্রমণ চালায়.... গানবোট সেনাদের খাবার ছিলো না। দুইদিন অবরুদ্ধ থাকার পর অভুক্ত সেনারা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তি বাহিনী প্রচুর পরিমাণ উন্নত মানের আর্মস এম্যুনেশন হস্তগত করে- যা এতোদিন মুক্তিযোদ্ধারা দেখেওনি। বন্দী পাক সেনাদের ইন স্পট মেরে ফেলে এবং রাজাকারদের দড়ি বেঁধে লাইন করে বুকাবুনিয়ায় নিয়ে এসে স্কুলের মাঠে উপুর করে রাখে। সন্ধ্যা নাগাদ স্পীড বোটে ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমর এবং ক্যাপ্টেন মেহেদী ঈমাম এসে রাজাকারদের গুলি খরচ না করে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন। আমার মনে আছে, হাত-পা বাঁধা দুইজন/চারজন রাজাকার একত্র করে বেঁধে হলতা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল.... প্রবল স্রোত ওদের বিষখালী নদীতে টেনে নিয়ে যায়। এর মধ্যে দুইজন যুথবদ্ধ রাজাকার কিছু দূর ভেসে নদীর চরে আটকে গিয়েছিল.... স্থানীয় লোকেরা ওদের ধরে বেদম মার মেরে বুকাবুনিয়া মুক্তি যোদ্ধাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে.... তারপর আবারও.....
এই এলাকার সাথে আমার একটা পারিবারিক যোগসূত্র রয়েছে। তাহলো- এই এলাকায় আমার দাদার বেশকিছু ভূসম্পত্তি আছে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমিও কিছু জমির মালিকানা অর্জন করেছি...স্বাধীনতার পর এই নিয়ে চারবার আমি এই এলাকায় এলাম। এলাকার তেমন কোনো দৃশ্যমান উন্নতি এখনো হয়নি। এরশাদ আমলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেব সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রী থাকাকালীন রিকশা চলাচল উপযোগী কিছু রাস্তা তৈরী হয়েছিল। সেইসব রাস্তায় এখন জোরজবরি ব্যাটারি চালিত রিকশা, অটো চলছে। ভাংগা সড়কে আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস আছে। এলাকার আগের প্রভাবশালী বনেদী পরিবারগুলো এখন আর গ্রামে বাস করে না। সব চাইতে বেশী পরিবর্তন হয়েছে কিশোর যুবকদের মধ্যে। গ্রামের কিশোর তরুণদের সেই নিস্পাপ আলাভোলা চেহারা আর মানষিকতার মানুষগুলো এখন রূঢ় মাস্তান চরিত্র প্রকাশের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

ফিরে যাচ্ছি আমার স্মৃতিময় হলতা নদীতে....

একদার প্রমত্তা হলতা নদী এখন একটা মরা খাল। কয়েক কিলোমিটার নদী(খাল) শুকিয়ে দুই জেলা/থানার সীমানা প্রাচীর মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। যেখানে একদা বহমান নদী ছিলো সেখানে এখন হোগলা বন, ছৈলা গাছের বাগান। যেখানে খাল হয়ে নদী নাম ধারণ করে আছে তার কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমড় কিম্বা বুক সমান পানি.....তবুও নাম তার হলতা নদী।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


