অটো প্রমোশন....
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত দুই বছর করোনা কালে 'অটো প্রমোশন' শব্দটা ব্যপক ভাবে আলোচিত হয়েছিলো। তখন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, ওই শিক্ষা বর্ষে পিএসসি, জেএসসি পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। সবাইকে 'অটো পাশ' দেখিয়ে ষষ্ঠ /নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হবেইত্যাদি ইত্যাদি.... সরকারের সেই সিদ্ধান্ত আংশিক কার্যকর করা হয়েছিলো যা ইতোমধ্যেই আমরা সবাই জেনেছি।
এই 'অটো পাশ' বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন হলেও এটা নতুন নয়। স্বাধীনতার পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭২ সনেও একবার অটো পাশ' করানো হয়েছিলো। তখন অবশ্য নাম ছিলো 'অটো প্রমোশন'। অর্থাৎ যেসব ছাত্রছাত্রী ক্লাস সিক্সে পড়তো তাদেরকে অটো প্রমোশন দিয়ে ক্লাস সেভেনে, যারা সেভেনে পড়তো তাদেরকে ক্লাস এইটে...এভাবেই নিচের ক্লাস থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত। যারা এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র তাদেরকে দ্বিতীয় বর্ষে...
কিন্তু যারা ক্লাস টেন(বলা হতো ওল্ড টেন) এবং এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিলো তাদেরকে নামকাওয়াস্তে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছিল। একই সাথে তখন নতুন করে যেকাউকে রেজিষ্ট্রেশন করে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেই সুযোগে ফাইভ সিক্স সেভেন এইট পাস করে লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া অনেকেই এমনকি বাড়ির কাজের বুয়া, আবদুল সবাই ফরম ফিলাপ করে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল।
আমার স্পষ্টতই মনে আছে, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তখন বই খুলে এবং পরস্পরের খাতা দেখে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ফলাফল -সবাই পাস! মুরব্বিরা মজা করে বলতেন, "টেবিল চেয়ারও পাস"!
আহাদ ভাই, লালবাগ এলাকায় একটি ঐতিহ্যবাহী ইন্ডাস্ট্রি মালিক পূত্র। অল্প বয়সেই সৎ ন্যায়নিষ্ঠ আদর্শবান ছেলে হিসেবে আজিমপুর, লালবাগ এলাকায় পরিচিত মুখ, তবে অজ্ঞাত কারণে পড়াশোনায় কিছুটা অমনোযোগী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের এসএসসি(তখন যেটাকে ওল্ড টেন বলা হতো)র ছাত্র ছিলেন। স্কুলের সেরা এথলেট। আমলীগোলা জিম ক্লাবের জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন বডি বিল্ডার। তিনি ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এর সহপাঠী। দুজনেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে আখাউড়ায় সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন আহাদ ভাই। ছিলেন সংগীত প্রেমী। পপগুরু আজম খানের সাথে উচ্চারণ ব্যান্ড দলের প্রতিষ্ঠাতা। যুদ্ধ শেষে তিনি আর পড়াশোনা করবেন না বলে ঘোষণা দেন।
বডি বিল্ডার আহাদ ভাই এমনিতেই সহপাঠীদের চাইতে বয়সে অন্তত দুই বছরের বড়ো ছিলেন- যার জন্য তিনি তার সহপাঠীদের সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান লেখাপড়া করবেনা- সেটা পরিবারের কেউ আশা করেনি। শেষ পর্যন্ত পারিবারিক চাপে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। সবাই যখন বই খুলে পরীক্ষা দিচ্ছিলো তখন আহাদ ভাই সবগুলো পরীক্ষার সাদা খাতা জমা দেন। তার বন্ধুরা, এমনকি শিক্ষকগণ পর্যন্ত তার খাতায় উত্তর লিখে দিতে চেয়েছে কিন্তু আহাদ ভাইর এক কথা, "অনৈতিক কিছু করে শিক্ষা সনদ নিতে চাইনা, যদি আবার পড়াশোনা করে পরিক্ষা দিয়ে পাস করতে পারি করবো কিন্তু পরিক্ষার নামে আমি অসদুপায় অবলম্বন করতে পারবো না"!
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হলে তৎকালীন ঢাকা বোর্ডে ৭৮ জন ফেল করা ছাত্রের মধ্যে ঢাকা শহরে একমাত্র আহাদ ভাই ফেল!
আহাদ ভাই ফেল করলে তাকে দেখার জন্য অনেক আত্মীয় স্বজন, এলাকার মানুষ তাদের বাড়িতে ভীড় করেছিলো! আহাদ ভাইও হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলেন....
আহাদ ভাইদের পরিবারও পুরনো ঢাকার বনেদী আদি বাসিন্দাদের মতো উর্দুভাষী ছিলেন। ভাষাগত কারণে একশ্রেণীর বদ লোকের অপপ্রচারণার শিকার হয়েছিলেন...স্বাধীনতার পর দেশজুড়ে অরাজকতা আর পাড়া মহল্লায় বিভিন্ন গ্রুপিংয়ের শিকার হয়ে নিহত হন আহাদ ভাই।
পুনশ্চঃ "অটো পাশ" এর সংবাদটা বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ও প্রিন্টিং মিডিয়ার নিউজে জেনেছিলাম। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, 'সীমিত পরিসরে জেএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে, অটো পাশ এর সিদ্ধান্ত হয়নি'।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




