চলনবিল.........
"অপার ঐশ্বোর্যের মাধুর্যে ঘেরা
আমাদের চলনবিল,
উত্তাল পানি জোস্নারাতে
করে ঝিলমিল।
ভরা পানির আনন্দে সবাই
করে কোলাহল,
চারেদিকে ছুটে বেড়ায়
মাঝি মাল্লার দল।
চলমান এই পানির মাঝে
নানান মাছে ভরা,
শুকনো হলেই ধু-ধু করে
বিশাল আকৃতির চরা।
শস্য শ্যামলা ফসলে আবার
ভরে যায় তার বুক,
ফসলের উল্লাসে সবার মাঝে
বয়ে আনে সূখ।"- এই কবিতাই যেনো চলনবিলের প্রতিচ্ছবি।
আমাদের একজন প্রতিবেশী, আমাদের পারিবারিক সুহৃদ স্বজন। সিরাজগঞ্জের লোক। একবার তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন চলনবিল।

বর্ষার চলনঃ
বিশাল জলাধার। অসংখ্য মতসজিবীরা মাছ শিকারের ব্যাস্ত। একতারাতে সুর তোলার মতো কোনও বাউল গান গেলে পাল তোলা ছোট ছোট নৌকা চলে যাচ্ছে দূর দুরান্তে। মনে মনে এই সব শব্দে কোনও ভাটিয়ালি সুর লাগাতে লাগাতে ভাবি, এ জন্মে হয়তো হল না। পরের জন্মেই তা হলে দেখব যাব চলনবিল। তুমি আকাশকে বলতে যেও না, আমি তোমার কে, বাতাসকেও বলো না....
ভাবনা কোনও অঙ্ক মেনে হয় না। বর্ষায় গ্রাম বাংলায় সব ভরা নদী। কিন্তু চলনবিল? সে তো অন্য! তার চলনেই জাদু। সে জাদুতে অনেক সৌন্দর্য, গা হিম করা সৌন্দর্য। বিল এখানে নিছক বিল নয়। সমুদ্রের মতো বিস্তার। ঘনঘোর বর্ষায় সমুদ্রের মতোই গর্জন বিলের। এত ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়, এত রোমাঞ্চকর হয়- বাস্তবে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন!

পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর জেলার অংশ নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় বিল এই চলনবিল। শুনেছি চল্লিশটির বেশি ছোট বড়ো নদী ওই বিল ছুঁয়ে গিয়েছে। করতোয়া, আত্রাই, গুড়, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, ভাদাই, চিকনাই, বরোনজা, তেলকুপি- কত সব নাম নদীদের। ভারতের দিনাজপুরের আত্রেয়ী নদী থেকেই এই চলন বিলের সৃষ্টি। ভারতীয়রা বলে আত্রেয়ী নদী, বাংলাদেশে আমরা বলি আত্রাই নদী। সে নদীর নাড়ি কেটে চলনবিলের জন্ম।
সিরাজগঞ্জ থেকে নাটোর পর্যন্ত যে বিশাল রাস্তা রোমান্টিক গতিতে চলে গিয়েছে, তার পাশে পাশে চলে চলনবিল। আর একটা ট্রেন লাইনও চলে গিয়েছে বিলের গা ঘেঁষে। সেখান দিয়ে যে ট্রেন যায়, তার একটা ট্রেনের নাম কাব্যিক, খুব রোমান্টিক- "চিত্রা এক্সপ্রেস"। চিত্রা নক্ষত্রও বোধহয় আকাশ থেকে দেখে চলনবিলের পাশ দিয়ে চিত্রা এক্সপ্রেসের যাত্রা। বিল সাধারণত শান্ত হয়। অথচ এ বিলে ঢেউ লেগেই থাকে। তাই বোধহয় নাম চলন।

আমার অন্যতম প্রিয় শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় ‘আলোর অমল কমলখানি’ রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার স্মৃতি মনে পড়ে। সে গানে কয়েকটা লাইনে ছিল, ‘ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলি তলে/ তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে, কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে।’ দেবব্রত ‘বেড়ায় মেতে’ শব্দটাকে নিয়ে দু’বার খেলা করে আলতো করে ছেড়ে দিতেন তৃতীয়বার। কী চমৎকার সেই শব্দ ছোঁড়ার খেলা!
এ বিলের চলন দেখলে আমার মতো বেসুরো গলায়ও গান গাইতে ইচ্ছে করে। পানির ঢেউয়ের উপরের বাতাস। এ বিলের চলন- দেখলে বুকের মধ্যে কেমন ছলাত ছলাত করে। মেঘ আর আকাশ মিশে গিয়েছে বিলের পানিতে। দূরে, বহু দূরে। এ বিলের মধ্যে অসংখ্য নদীর মতো অনেক বিলও মিশে যায় খুব স্বচ্ছন্দে। গোটা বাইশ বিলের পানিরাশি কোথায় চলে যায় দূরগত পাখির মতো। বর্ষার সময় ১৩ কিলোমিটার একদিকে, অন্য দিকে ২৪ কিলোমিটার।
শুনেছি, প্রথম চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার। তারপর কমতে কমতে কত? সেটাও ঠিক স্পষ্ট নয়। কারও হিসেবে ১৪২৪ বর্গকিলোমিটার। ছেলে বেলায় বইতে পড়ে ছিলাম, ২০৭২ কিলোমিটার। কেউ বলছে, ১১৫০ বর্গ কিলেমিটার। সেটাই বা কী কম?

আষাঢ় থেকে ভাদ্র, বিলের মধ্যে এক একটা গ্রাম হয়ে ওঠে দ্বীপ। বুকের মধ্যে বেজে ওঠে একতারার টুং টাং। চেনা গ্রামীণ ভাটিয়ালির সুর। ডুবে থাকা গ্রামীণ দ্বীপে অজস্র হাঁস ডেকে ওঠে প্যাকপ্যাক করে। আছে পরিযায়ী পাখিরাও। অকুতোভয় কিশোরেরা ওই ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অনেকটা দূরে।
চলনবিলের ওপর মেঘ করে এলে কৃষ্ণকায়া বাংলা যেন বুকের মধ্যে খেলা করতে থাকে। সে রূপের বর্ণনা করি কী করে? করা যায় না। আদিগন্ত পানির উপর বাতাস বেড়ায় মেতে, বেড়ায় মেতে, বেড়ায় মেতে.........। বর্ষার পানি নেমে গেলে সেখানেই ধানের চাষ অজস্র মানুষের। তখন সবুজ ক্ষেত এবং নীল পানি মিলে এক শিল্প হয়ে ওঠে। জানিনা আবার কবে দেখতে যাব চলন বিল।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




