হঠাত বিপদে আত্মরক্ষার কিছু কৌশল.....
স্থানঃ মিরপুর রোড, ধানমণ্ডি মাঠের পাসের মেইন রাস্তা। সময় বিকেল ৩টা। আমি নার্সারি থেকে কিছু চারাগাছ, সার এবং মাটি কিনে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। ঈদের ছুটিতে রাস্তাঘাট অনেকটাই নির্জন। আমার পাশ ঘেঁষে ফুটপাত দিয়ে ২১/২২ বছরের এক তরুণী কাঁধে ব্যাগ, ছাতা মাথায় হেটে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। মেইন রাস্তার পূর্ব পাশ থেকে সাদা প্যান্ট, সাদা টিশার্ট, মাথায় হ্যাট পরিহিত একজন সুবেশী সুদর্শন মধ্যবয়সী লোক দ্রুত হেঁটে রাস্তার পশ্চিম পাসে চলে এসেছে...দেখতে অনেকটাই গলফ খেলোয়াড়দের মতো লাগছে.... প্রখর রোদে আমি নার্সারির টং ঘরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মেয়েটির চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি দেড়শো গজ দূরে সেই সুদর্শন পুরুষটি মেয়েটিকে রাস্তায় জড়িয়ে Molest করছে...জাস্ট মিনিটের ব্যাপার। নির্যাতিত মেয়েটি নিজেকে কোনো ভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে হাতের ছাতাটা ফেলেই দৌড়ে রাস্তার অপর পাশে চলে গিয়েছে.... আমি দৌড়ে নির্যাতনকারীর দিকে আগাতেই সে শেখ জামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স এর ভেতরে চলে যায়।
এমন ঘটনার সাথে আমরা প্রায় সবাই কম-বেশি পরিচিত৷পথচারী মেয়েদের নির্যাতনের এসব খবর আমরা পত্রিকাতেও অহরহ পড়ে থাকি। এমনও তো হতে পারে- আপনি, আপনার সন্তান এমন কোনো পরিস্থিতির শিকার হলেন, তখন?
আমার মতে মেয়েদের আত্মরক্ষার ট্রেনিং দরকার। ফিজিক্যাল ফিটনেস বাড়ানো দরকার। ফিজিক্যাল ফিটনেস এর সাথে মানসিক টাফনেস ইমপ্রুভ দরকার। গায়ের জোরের থেকে মানসিক জোর বেশি দরকার। কোনও মেয়ের বুকে হাত দিলে সে দুহাতে বুক না আগলে বিচি কচলে দিক। মেয়েদের মাইন্ডসেট পরিবর্তন করাটা সব থেকে জরুরি। মেয়েদের এই মাইন্ডসেটটা খুব ছোট থেকেই দায়িত্ব নিয়ে তৈরি করে দিতে হবে মেয়ের মা'দের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের।
আমরা আমাদের মেয়েদের আত্মরক্ষার বেসিক ট্রেনিং দিতে পারলে বাসে ট্রেনে বা লোকালয়ে 'ব্যাড টাচ' মোকাবিলা করতে পারবে। মার্শাল আর্টসের এমন কিছু ট্রেনিং আছে যা নির্জন জায়গায় একাই দুই-তিনজনের সাথে লড়ে নিজেকে সেভ করতে পারে। অন্তত নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আটকে রেখে সময় ক্ষেপণ করে বৃহত্তর সাহায্য সহযোগিতার জন্যে লোক জড়ো করতে পারবে।
ক্যারাটে-জুডো শেখার ক্লাসে হয়তো সবার যাওয়ার সময় সুযোগ নেই। কিংবা আপনাকে আগলে রাখার মানুষও হয়তো আপনার সাথে থাকেন না, তখন আপনি কী করবেন? নিশ্চয়ই হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবেন না। এরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে ঠান্ডা মস্তিষ্ক, সদা প্রস্তুত, সজাগ ও কৌশলী মনোভাব জরুরি। কলেজ লাইফে জুডো কারাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলাম....মুক্তি যুদ্ধের সময়ও সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সেই প্রশিক্ষণ থেকেই কিছু ছোট ছোট আত্মরক্ষার কৌশল বলছি, যা আপনাকে এমন আকস্মিক পরিবেশ থেকে রক্ষা করতে পারে।
জুডো কারাতে প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে- "প্রথমেই নিজে আগ বাড়িয়ে কাউকে মারতে যাবেন না। যতক্ষণ পারুন, কথা বলে সব ঠিকঠাক করার চেষ্টা করতে হবে। একমাত্র আত্মরক্ষার জন্যই জুডো কারাতের টেকনিক প্রয়োগ করবেন।"
দুই হাতের কব্জি হোক মুষ্টিবদ্ধ:
যখনই দেখবেন বিপদ আপনার আশেপাশে, সাথে সাথে দুই হাতের চারটি আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ করে, এর উপর বৃদ্ধাঙ্গুল রেখে দিবেন। নিজের দুই পা ছড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়াবেন। আপনার পা ছড়িয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় আপনার শারীরিক ভারসাম্যতা বেড়ে যাবে...
নিজ মুখ ঢেকে রাখুন:
আক্রমণকারী যদি সামনে দিয়ে আঘাত করতে আসে, তাহলে দুই হাত দিয়ে মুখের সামনে ঢাল তৈরী করুন। এতে করে আপনার নাক চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।
যদি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন:
যদি প্রথম আক্রমণেই আপনি ভারসাম্য হারিয়ে পরে যান, তাহলে চেষ্টা করুন হামলাকারীর গায়ের উপর পড়ার। আপনার ওজনটাকে নিজের প্লাস পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। হামলাকারীর সংবেদনশীল জায়গায় নিজের হাঁটু ও কনুই দিয়ে আঘাত করুন। সাথে গলা ছেড়ে চিৎকার করুন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে। চিৎকার মানেই শক্তি, চিৎকার মানেই বাড়তি জোশ! যুদ্ধের মাঠে মুসলিম সৈন্যরা যেমন "ইয়া আলী" বলে হুংকার দিয়ে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা যেমন "জয়বাংলা" বলে হানাদার বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পরতাম- তেমনি চিৎকার করে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পরবেন। আপনার চিৎকার শুনে পথচারীরা এগিয়ে আসবে...
সংবেদনশীল জায়গায় আঘাত করুন:
মনে রাখবেন, শত্রুর সাথে খালি হাতে লড়াইয়ের জন্য শারীরিক শক্তির চাইতেও বেশী দরকার বুদ্ধিমত্তার সাথে কৌশলের প্রয়োগ। আমাদের দেহের অন্যতম সংবেদনশীল অঙ্গগুলো হলো- চোখ, কান, নাক, গলার মাঝখান, তলপেট, হাঁটু, দুই উরুর সন্ধিস্থল। এসব অংগে আঘাত করলে যে কেউ অন্তত কিছু সময়ের জন্য ধরাশায়ী হয়ে পড়বে! আঘাত করুন সমস্ত শক্তি দিয়ে....
সামনে যা কিছু পান:
সবসময় আপনার কাছে অস্ত্র নাও থাকতে পারে। তখন আপনার বিপদের বন্ধু হতে পারে আপনার হাতে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগ, মুঠোফোন, চাবি এমনকি স্কার্ফও! স্কার্ফের সাহায্যে আপনি আক্রমণকারীর গলা পেচিয়ে ধরে তার নাক, চোখে আঘাত করতে পারবেন। ভ্যানিটি ব্যাগ ও মুঠোফোন দিয়ে মুখে আঘাত করতে পারবেন; চাবি দিয়ে নাক ও চোখে আঘাত করতে পারবেন। কোনো কিছুকেই অবহেলা করা চলবে না- হাতে যা আছে তা দিয়েই প্রতিরোধ!
হাত যদি শক্ত করে ধরে:
যদি আপনার হাত শক্ত করে চেপে ধরে, তাহলে হাত ধরার সাথে সাথে এক ঝটকায় আক্রমণকারীর বৃদ্ধাঙ্গুল বরাবর ঘুরিয়ে নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে ফেলতে হবে। যত দ্রুত নিজের হাতকে ছাড়িয়ে নিয়ে আক্রমণকারীর হাঁটু, তলপেটে কিম্বা দুই উরুর সন্ধিস্থলে সজোরে লাথি মারুন। নিজের শরীরে যত শক্তি আছে, তা ব্যবহার করে তার গায়ে উঠে চেপে বসবেন। তাহলে সে আর নড়তে পারবে না।
আপনার চুলের মুঠি টেনে ধরলে:
পেছন থেকে কেউ যদি আপনার চুল টেনে ধরে তাহলে সাথে সাথেই হামলাকারীর হাত খপ করে ধরে ফেলুন। কিছুতেই সময় নষ্ট করা চলবে না৷ হাতের পাঁচ আংগুল ছড়িয়ে সরাসরি নাক-মুখ-চোখ বরাবর থাপ্পড় মারুন..... প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক থাপ্পড় খেয়ে ১০/১২ সেকেন্ড চোখে অন্ধকার দেখবে....এই সময়ের মধ্যে নিজেকে পরবর্তী করনীয় নির্ধারনে সহায়ক হবে।
গলা বা ঘাড় চেপে ধরলে:
যদি আপনার ঘাড় বা গলা চেপে ধরে, তাহলে আপনি পা দিয়ে তার হাঁটু বা তলপেটে জোরে আঘাত করুন। আপনার কনুই দিয়ে প্রতিপক্ষের পাঁজরে আঘাত করুন। তাও না পারলে নিজের আঙ্গুল আক্রমণকারীর চোখে সর্বশক্তি দিয়ে ঢুকিয়ে দিন।
যদি থাকেন লিফটে:
অপরিচিত যায়গায় চেষ্টা করবেন লিফটে একা ওঠা এড়িয়ে চলতে৷ কিংবা সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে তার সাথে লিফটে ওঠা থেকে বিরত থাকুন। কেউ যদি উঠেও থাকে, তাহলে সাথে সাথে লিফট থেকে নেমে যান। লিফটে উঠে যদি কোনো বিপদের আঁচ পান, তাহলে লিফটের বাটনগুলো যেখানে আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ুন ও সবগুলো বাটন চেপে দিন। যাতে দরকার পরলে দ্রুত লিফট থেকে নেমে যেতে পারেন।
গাড়িতে বা বাইরে থাকলে:
গাড়িতে চলাচল করলে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পরিচিত কাউকে যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার ঠিকানা, গাড়ির রঙ ও নম্বর দিয়ে রাখুন। আর চালকের রুটের সাথে আপনার রুট মিল আছে কি-না, সেদিকেও খেয়াল রাখুন৷
মনে রাখবেন, ফিল্মি স্টাইলে মারামারি না করে, নিজের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ট্রাকিয়া (পুরুষদের Adam’s apple) এ জোরে চাপ(মুচড়ে) দিন। ব্যাথার যন্ত্রণায় সে আর উঠতে পারবে না।
বিপদ কখন কোনদিক থেকে আসবে তা বলা যায় না৷ তাই সবসময় সবরকম পরিবেশের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। উপরে যা বলেছি তার সারসংক্ষেপঃ-
** রাস্তায় চলার সময় নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখুন। যাতে বিপদ আসার সাথে সাথেই যেন হামলাকারীদের উপর ঘুষি বসিয়ে দিতে পারেন!
** যত দ্রুত, জোরে ও বেশি সম্ভব আক্রমণকারীর চোখে ও নাকে আঘাত করুন এবং যত দ্রুত সম্ভব সেখান থেকে পালিয়ে কারো সাহায্য চান। সবসময় জোরে দৌড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
** প্রতিপক্ষ বুকের সাথে চেপে ধরলে নিজের কপাল দিয়ে আক্রমণকারীর নাকে সজোরে আঘাত করুন।
** নিজের পায়ের গোড়ালি বা জুতোর হিল দিয়ে হামলাকারীর পায়ে আঘাত করুন।
** হাঁটুতে জোরে আঘাত করলে যে কেউ বেশ কিছুক্ষণের জন্য উঠে দাঁড়াতেই পারবে না।
** ১২-১৬ পাউন্ড প্রেশার দিয়ে যদি কাউকে লাথি মারা হয়, তাহলে সে আর উঠে দাঁড়াতেই পারবে না! কারণ এই প্রেশারে লাথি মারলে হাঁটু ভেঙ্গে যাবে।
** কেউ যদি আপনাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, তবে সবার আগে তার হাত নিজের কলার বোন থেকে সরিয়ে কনুই দিয়ে পাঁজরে আঘাত করুন।
** পেছন থেকে আঘাত করলে চটজলদি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ুন। আপনার এই স্টেপে সে কিছু সময়ের জন্য হলেও ভড়কে যাবে। তখন আপনি নেক্সট স্টেপ ভাবার জন্য এক্সট্রা সময়ও পেয়ে যাবেন।
** আপনার অর্থের চেয়ে আপনার জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। তাই কোনো উপায় না থাকলে নিজের ব্যাগ বা ওয়ালেটটা ছুঁড়ে দ্রুত পালিয়ে যান।
মনে রাখবেন, আপনি অনেক গুলো সুযোগ পাবেন না। হয়তো একটা দুটো সুযোগ পাবেন, সেই সুযোগ সর্বশক্তি দিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। এমনই কিছু ছোট ছোট কৌশল আপনাকে অসংখ্য বড় বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। শুধু প্রয়োজন একটু সতর্ক থাকা। যদি আপনার কখনো সময়-সুযোগ হয়, তাহলে মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নিবেন।
আর হ্যা, সিক্রেট সাইন তৈরি করে আপনার সেলফোনে সেভ করে রাখুন- “I’m in danger.” অর্থাৎ আপনি বিপদগ্রস্ত, আপনার সাহায্যের দরকার। এমন কাউকে টেক্সট পাঠান, যে আপনার বার্তার গুরুত্ব বুঝতে পারবে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



