আমার হাত.........
মিশনারী স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ক্লাস থ্রী বা ফোরে, ঠিক মনে নেই, পাদ্রী মিজ এর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম- শরীরের সেরা অঙ্গ হাত। ক্লাস মিজ এবং সহপাঠী বন্ধুরা হইহই করে উঠলো! মিজ অন্য সহপাঠীদের কাছে করে জানতে চাইলেন- শরিরের সেরা অংগ কি?
মস্তিস্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, চোখ এমনকি মুখ- পেটের নাম উঠে এলো।
হাতের পক্ষে কেউ নাই! যুক্তি দেখালাম, "হাতকে যা বলি তাই করে, সুতরাং হাতই সেরা।" সেদিন মিজ কিম্বা বন্ধুরা একমত নাহলেও আমার আজও বিশ্বাস- হাতের ধারে কাছে কেউ নেই।
আমার হাত নিয়ে আমার অহংকার একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। দেখতে নয়, কাজের জন্য। দেখনদারি হাত নয় বলে আমার যে কষ্ট আছে বা ছিল এমনও নয়। বরং ছোট থেকেই আমার এই সাধারণ হাতকেই আমি অসাধারণ ভাবতাম। আমাদের ছেলে বেলা পাঞ্জা লড়ার খেলাটা খুব বেশী প্রচলিত ছিলো। আমি আমার সব বন্ধুদের পাঞ্জায় হারিয়ে দিতাম!
অংকে আমি খুব দুর্বল ছিলাম। মাঝেমধ্যে কঠিন অঙ্ক পারলে হাতে চুমু খেতাম লুকিয়ে লুকিয়ে, "পেরেছিস অঙ্কটা" বলে.....মার্বেল খেলায়, ক্যারম খেলায় জিতে হাতে চুমু খেতাম হেরে যাওয়া বন্ধুদের চোখের সামনে!
কল্পনাবিলাসী আমি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে খাতার পিছনে সহস্র অবাস্তব কল্পনা করতাম আর তাদের সত্যি করতে শুরু করলো হাত। হাবিজাবি ছবিতে আঙ্গুলগুলো মায়া জগতের মায়াজাল বুনতো আর আমি ভাসতাম, সেই রোমান্টিকতায়।
রোমান্টিকতা!
অবাস্তব?
আমার অবাস্তব জগতে স্বচ্ছন্দ বিচরণের সেই শুরু। তারপর সারাজীবন কতজনই বলেছেন, "সব মিথ্যে, তুমি মিথ্যের অলীক জগতে থাকো, কিস্যু হবে না, কিস্যু পাবে না জীবনে।"
সত্যিই জীবনে অনেক কিছুই পাইনি। অনেক কিছুই পাব না। দরকার নেই পাবার- সবাই কি সব পায়!
যাক হাত নিয়ে বলছিলাম।
একটু বড় হয়ে আমার হাত আমায় আদর করতে শুরু করলো। সে এক অদ্ভুত গোপন, আবছা ভয় আর রোমাঞ্চে ভরা। জীবনে প্রথম মনে রাখার মত রোমাঞ্চ এনেছিল হাত......।
সেই কিশোর বয়সে এই হাত বন্দুক তুলে নিয়েছিলো দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য। এই হাত বংগবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের হাত ছুঁয়েছিলো। জিয়াউর রহমানের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করলো। আমার স্কুল কলেজ এর এডজুটেন্ট থেকে এডজুটেন্ট জেনারেল, প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলরের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করলো।
তখনও এই হাত কবিতা লিখতে শুরু করেনি। শুরু হলো যখন ভয়ে ভয়ে প্রথমবার এক কিশোরী প্রেমিকার হাত ছুঁয়েছিলো। আমি বুঝলাম নারীর হাতের স্পর্শ ছাড়া কবিতার জন্ম হয় না। কিশোরীর হাতের স্পর্শে আমার হাত কবিতা লিখতে শুরু করলো। শুধু কবিতা লেখেনি, কতদিন কতবার এই হাত মানুষের রক্ত ছুয়েছে। মনে পড়ে ১৯৮৯ সনে ১৫ই জানুয়ারী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফেরার পথে টংগীর মাজুখান নামক একটা যায়গায় মুখোমুখী দুই ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৫০ যাত্রীর প্রাণহানী এবং চার শতাধিক যাত্রী আহত হবার কথা। আমিও ছিলাম সেই ট্রেনের যাত্রী। সৌভাগ্যবশত আমি লাশ হইনি বরং অসংখ্য রক্তাক্ত মানুষের সেবা শুশ্রুষা করেছে আমার হাত। ছিটকে পড়া ৫/৬ বছরের একটি রক্তাক্ত বাচ্চাকে কোলে নিয়ে খুঁজে পেয়েছিলাম ওর মৃত মায়ের লাশ। দুই হাতদিয়ে পাগলের মত বাচ্চাটির বাবার জীবন খুজছিল রক্তাক্ত মুখগুলোতে হাত বুলিয়ে।
সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ আমার হাত কবিতা লিখেছিলো, আমার প্রথম প্রেমিকার শরীরে। শুধু কাগজে নয়, তার পিঠ জুড়ে আমি আঁকি প্রতিস্পর্দ্ধি এক ছবি। আমার এই হাত নারীদের উপত্যকা জুড়ে লেখে কবিতার ছত্র।
এই হাত ছবি আঁকে তোমার কপালে, তোমার চোখের পাতায়, কপোলে, ঠোঁটে, থুতনিতে, বুকের গভীর গভীরতর দুঃখে।
এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আঁকা হয়ে যায় তোমায় আশ্লেষে আদরের ছবি!
আমার মুষ্টিবদ্ধ হাত শাসন করে দুঃশাসনকে, আমার আঙ্গুল গলা নামাতে বাধ্য করে অকারণ স্পর্দ্ধাকে।
আমার হাত অন্যায়কে বাধা দেয়। আমার দুই হাত সুন্দরকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়।
আমার হাত সন্তানের মাথায় হাত রেখে বলে, "ভালো মানুষ হও।"
তবে স্বীকার করতে বাঁধা নাই- হাতের সব কাজই মস্তিস্ক প্রসূত।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




