somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

চায়না সীড.........

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চায়না সীড.........

আমার কয়েকটা পোষা পাখি আছে। কাটাবন বার্ডস মার্কেট থেকে সেগুলোর জন্য খাবার কিনি। ঘুঘু, মুনিয়া, লাভ বার্ডের প্রিয় খাবার 'চায়না সীড'। এই চায়না সীডের বিরাট এক সাহিত্য ইতিহাস আছে।

বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আরণ্যক' যারা পড়েছেন তারা জানেন সেই যুগে পূর্ণিয়ার জঙ্গলমহলের প্রজারা কি ভয়াণক গরীব ছিল। "খাবার বলতে ছিল কলাই আর মকাইয়ের (ভূট্টা) ছাতু। সেটাও মিলত বছরের বড় জোর তিন-চার মাস। কালে ভদ্রে তারা ভাত খেতে পেত কোন বড়লোকের বাড়িতে উৎসব উপলক্ষে। তার পর তাদের বেঁচে থাকত হত বুনো কুল, গুঁড়মী ফল আর এক রকম ঘাসের বীজ খেয়ে। এই ঘাসের নাম হল চীনা ঘাস। কোন নিমন্ত্রন বাড়িতে সেই ঘাসের বীজ সেদ্ধ, একটু লবন, বেথুয়া শাক, একটু ভেলি গুড় আর টক দই পেলে মনে করত হাতে স্বর্গ পেয়েছে।" অর্থাৎ ঘুঘু, মুনিয়া, লাভ বার্ডের প্রিয় খাবার 'চায়না সীড' বেঁচে থাকার জন্য মানুষেরও খাদ্য ছিলো।


প্রায় একশ' বছর আগে জঙ্গলমহলে গিয়ে লেখক দেখা পেয়েছিলেন এই সব হতভাগ্য লোকেদের। লেখকের মনে হয়েছিল, "বাংলাদেশের ভিখারিরাও এদের তুলনায় অনেক ধনী- তারা অন্তত ভিক্ষে করে হলেও ভাত খেতে পায়, ঘাসের বীজ খেতে হয় না।"

আরো তিন শতাব্দী আগে দিল্লির সিংহাসনে বসেছেন মোঘল সম্রাট আকবর। সমগ্র ভারতবর্ষ প্রায় তার দখলে চলে এসেছে। তাঁর রাজপুত সেনাপতি মান সিংয়ের দক্ষতায় একের পর এক ছোট রাজ্য বশ্যতা স্বীকার করেছে বা যুদ্ধে হেরে গিয়ে মোঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছে। স্বাধীনচেতা রাজপুত রাজারাও মোঘল সম্রাটের সঙ্গে সন্ধি করেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম মেবারের রানা প্রতাপ সিংহ। মরুভূমির মরীচিকার মতো তিনি তখনো তার রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করে যাচ্ছেন। তিনি কিছুতেই বশ্যতা স্বীকার করবেন না। বাধ্য হয়ে আকবর রাণা প্রতাপের স্বগোত্রীয় মাণ সিংহকে পাঠালেন মেবার দখল করতে।

হলদিঘাটের যুদ্ধে (১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে) বীর বিক্রমে লড়াই করে রাণা প্রতাপ সিংহের সৈন্যদল বিধ্বস্ত হলো মোঘল সৈন্যদের হাতে। কিন্তু রাণা প্রতাপকে মোঘল সেনারা বন্দী করতে পারল না। প্রভুভক্ত ঘোড়া 'চেতক' তাঁকে নিয়ে গেল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ জায়গায়। এটা পলায়ণ নয়, নতুন উদ্যমে আবার যুদ্ধের প্রস্তুতি। তারপর রাণা প্রতাপ স্বপরিবারে আশ্রয় নিলেন জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে কিছু যোদ্ধা নিয়ে গেরিলা লড়াই চালিয়ে যেতে থাকলেন মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে। সে এক অসম কিন্তু চরম বীরত্বের লড়াই, যা গাঁথা হয়ে আছে রাজপুতনার চারণকবিদের গানে।

যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি আমাদের গৃহশিক্ষক বিশ্বেশ্বর মণ্ডল পণ্ডিত মহাশয় ইতিহাসের রাণা প্রতাপের কাহিনী বলছিলেন- জঙ্গলের মধ্যে তাঁকে পরিবার নিয়ে কত কষ্ট করতে হয়েছিল। খাবারের অভাবে ঘাসের বীজ গুড়ো করে রুটি বানিয়ে খেতে দিতেন তাঁর ছেলে-মেয়েকে। এক দিন মেয়ের থালা থেকে একটা কাঠবিড়ালি সেই ঘাসের বীজের রুটি নিয়ে পালিয়েছিল। রাণার ছোট্ট মেয়ে খুব কেঁদেছিল খিদের জ্বালায়। তখন ছোট ছিলাম, মন অনেক নরম ছিল। খুব কষ্ট হয়েছিল এই কাহিনী শুনে। সে দিন রাতে শুয়ে সেই ছোট মেয়েটির কথা ভেবে কান্না পাচ্ছিল।


কৌতূহল জেগেছিল- কি ঘাসের বীজ দিয়ে কি রকম রুটি হয়?
প্রায় তিন দশক পর যখন প্রথম 'আরণ্যক' পড়লাম, মনে হল- তা ছিল চীনা ঘাসের দানা। এখনো আমি কখনো কখনো 'আরণ্যক' পড়তে পড়তে থমকে যাই সেই পৃষ্ঠায় এসে- "আষাঢ় মাসে পুণ্যাহ উৎসব হবে কাছারীতে। আশে-পাশের সব বস্তির প্রজাদেরকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সে দিন সকাল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি। সবার খাওয়া হয়ে গেছে। বিকেলের দিকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে তিন জন 'দোষাদ' মহিলা দুটো বাচ্চা নিয়ে উঠোনের মধ্যে পাত পেতে ভিজছিল। তাদের পাতে শুধু চীনার দানার খিচুড়ি, বাকি অভ্যাগতদের মতো তাদের কপালে জোটেনি ভেলি গুড় আর টক দই। যার আশায় করুণ নয়নে তারা বসেছিল। অস্পৃশ্য বলে বারান্দায় তাদের ঠাঁই হয়নি, ওদের কেউ ভালো ভাবে পরিবেশন করতে যায় নি।" লেখক যখন ব্যাপারটা জানতে পেরে নিজে হাতে পরিবেশন করতে উদ্যোগ নিলেন, তখন কাছারির লোকেরা এসে খুব বিরক্ত হয়ে বাকি খাবার পরিবেশন করল তাদেরকে।

এই ঘটনার সপ্তাহ খানেক পরে লেখক "দোষাদবস্তির সব মেয়ে-বৌ-বাচ্চাদের কাছারীতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন- লুচি, মাছ, মাংস, ক্ষীর, দই, পায়েস, চাটনি। তৃপ্তির চোখে দেখলেন তাদের পেট ভরে খেতে- জীবনে হয় তো প্রথম এবং শেষ বার।"- এই অংশটুকু পড়তে গেলে এখনো বুকের ভিতর দলা পাকিয়ে কান্না হয়ে গলার কাছে আটকে যায়। পড়া থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি।

ভারতের অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। নিশ্চয়ই এখন আর কেউ শুধুমাত্র চীনা ঘাসের দানা খেয়ে বেঁচে থাকে না। মূলত চীনা ঘাসের দানা এখন পোষা পাখির খাবার হিসাবে বিক্রি হয়। বিশেষ খাদ্য গুণ সমন্বিত সেই চীনা ঘাসের দানা প্রাণী খাদ্য হিসেবে খুব উপকারী। উদ্ভিজ্জ প্রোটিন ও ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড এবং ফাইবারের উৎস। আছে প্রচুর পরিমাণ এন্টি-অক্সিডেন্ট। খেতে সুস্বাদু নয় তাই খিচুরির সাথে মিশিয়ে সেদ্ধ করে খাওয়া যায়। বর্তমানে অনলাইন শপিংয়ে 'চিয়া সিডস' নামে যেটা বিক্রি হচ্ছে সেটা বিদেশ থেকে আমদানীকৃত ঘাস জাতীয় একটা প্রজাতির বীজ। আমরা বিদশি 'ওটস' খেতে শিখেছি, চীনা ঘাসের দানা হতে পারে তার পরিপূরক।
আমাদের চির পরিচিত ধানও হয়তো এক রকম ঘাসের বীজ। কয়েক হাজার বছরের প্রচেষ্টায় সেটার উন্নতি ঘটিয়ে আমাদের প্রধান খাদ্য হয়েছে। ইন্ডিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এখন বানিজ্যিক ভাবে চীনা ঘাসের চাষ হয় এবং পাখি ও পশুখাদ্য হিসেবে বিদেশে রপ্তানী হয়।


(বিদ্রঃ চীন দেশের সঙ্গে চীনা ঘাসের দানার কোন সম্পর্ক নেই)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:১৫
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভোটের পর, আমরা পাকীদের বুটের নীচে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩২



পাকীরা অমানুষ, অপসংস্কৃতির ধারক ও বাহক; ওরা ২টি জাতিকে ঘৃণা করে, ভারতীয় ও বাংগালীদের; ওরা মনে করে যে, বাংগালীদের কারণেই পাকিরা হিন্দুদের কাছে পরাজিত হয়েছে ১৯৭১... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফুড ফর থট!!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৩৫



একটা বিশাল আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত আকার দেয়া খুবই কঠিন, বিশেষ করে আমার জন্যে। তারপরেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাবলাম কিছু কথা বলা উচিত। দেশের আভ্যন্তরীন বা আঞ্চলিক রাজনীতিতে ক্রমাগত বড় বড় ভূমিকম্প... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক রহমান আসবে, বাংলাদেশ হাসবে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৮


আমি যখন স্কুলে পড়তাম, দুপুরের শিফটে ক্লাস ছিল। একদিন স্কুলে যাওয়ার আগে দেখি ছোটো মামা সংসদ টিভিতে অধিবেশন দেখছেন। কৌতূহল হলো, মামা এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছেন। আমিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামে কোনটি মত এবং কোনটি মতভেদ?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৬:৫৪




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে। তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=একটি ডায়াটের গল্প, যেভাবে ওজন কমিয়েছিলাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৮


১৬ ডিসেম্বরের খাবার ছিল। উপরের চায়ের ছবিতে ফেসবুকের দুই গ্রুপে দুটো পুরস্কার পেয়েছি প্রতিযোগিতায় আলহামদুলিল্লাহ।

মোবাইলে পোস্ট, ভুল ত্রুটি থাকিতে পারে, মার্জনীয় দৃষ্টিতে রাখবেন।

জব করি বাংলাদেশ ব্যাংকে। সারাদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×