আরাকান - রোহিঙ্গা - রাখাইন......
(ইতিহাসের পাতা থেকে)
আরাকান বার্মার অংশ না। এটা বার্মা কর্তৃক দখলকৃত। বার্মিজরা আরাকান দখল করেছে ১৭৮৪ সালে আর ১৮২৬ সালে ইংরেজরা আরাকান দখলে নেয়। সুতরাং আরাকানে বর্মী অবস্থান মাত্র ৪২ বছরের। এর আগে আরাকান ছিল একটা স্বাধীন রাষ্ট্র। সুলতানী আমলে কখনো কখনো আরাকান ছিল বাংলার আশ্রিত রাজ্য। আরাকানী রাজারা তখন মুসলিম নাম ব্যবহার করতেন এবং তাদের মুদ্রায় কালিমা অংকিত করতেন, যদিও তারা সরাসরি ইসলাম গ্রহণ করেন নি। ভারতীয়রা [বাঙালীসহ অন্যান্যরা] তখন থেকেই আরাকানে বসবাস করতে থাকে। অনেকে আবার রাখাইন বা মগ জলদস্যু, যাদেরকে চট্টগ্রামের ভাষায় বলা হত হার্মাদ কর্তৃক অপহৃত হয়ে আরাকানে স্থিতু হন। আরাকান রাজসভায় অনেক ভারতীয়রা স্থান পান। মধ্যযুগের বাংলা কবি মাগন ঠাকুর, আলাওল সহ অনেকেই এদের দলভূক্ত। আওরঙ্গজেব আলমগীরের (রহিমাহুল্লাহ) শাসনকালে চাটিগাঁও মুঘলদের অধীনে আসে। এবং এ সময় মগ জলদস্যুদের চট্টগ্রামের উপকূলে লুন্ঠন থেকে বিরত রাখেন সুবেদার শায়েস্তা খান। মগদের সর্বশেষ বড় পরাজয় হয় সন্দ্বীপের যুদ্ধে শায়েস্তা খানের হাতে। সন্দ্বীপের একটা ইউনিয়নের নাম মগধরা। এখানেই তিনি মগদের/রাখাইনদের পরাজিত করেছিলেন।
আরাকান মূলত বার্মা অধিকৃত একটা দেশ। বার্মিজরা এর ইসলামী পরিচিতি মুছে ফেলতে চাচ্ছে। তারা রাজধানী আকিয়াবের নাম পরিবর্তন করে রেখেছে সিট্টোয়ে। রাজ্যের নাম আরাকান থেকে রাখাইন এবং আরো অনেক নাম। আমাদের মনে রাখা দরকার রোহিঙ্গারা হঠাৎ করে ভারতের বাংলা অঞ্চল থেকে গিয়ে সেখানে ইংরেজ আমলে বা তার পরবর্তী কালে বসতি স্থাপন করেনি। বরং রোহিঙ্গারা ৫ শতাধিক বছর আগে থেকেই আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা। তারা ভাষার পরিচয়ে বাঙালী হতে পারে, কিন্তু আরাকানে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী না। অনেকেই আজকাল এটা বুঝানোর চেষ্টা করে থাকে যে রোহিঙ্গারা মূলত বাঙালী অভিবাসী। এই প্রোপাগাণ্ডার বিরুদ্ধেও আমাদের সোচ্চার হতে হবে।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? এখানে রোহিঙ্গা জাতির প্রায় ভুলে যাওয়া ইতিহাসের কিছু তুথ্য তুলে ধরা হলো:
রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোডপায়া এটি দখল করে বার্মার অধীন করদ রাজ্যে পরিণত করেন।
আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রাতে ফার্সি ভাষায় লেখা থাকতো কালেমা।
আরাকান রাজ দরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাংলার সাথে আরাকানের ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
ধারণা করা হয় রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে: ম্রোহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো রোসাং নামে।
১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পলায়ন করেন। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ্ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ্ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে।
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চ্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে।
মোঘল সম্রাট শাজাহানের দ্বিতীয় ছেলে শাহ সুজা ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে ১৬৬০ সালে সড়ক পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ্ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর পর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে।
আরাকানীরা বার্মিজ না; আর রোহিঙ্গারা আরাকানে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাঙালী বসতি স্থাপনকারী না। আর একটা কথা, বাংলাদেশের আদিবাসী এদেশের বাংগালীরাই।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




