পল এলুয়ার....
পল এলুয়ার সম্পর্কে আমি যতসামান্য জানতাম তাও ভুলে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে ঢাকা ফিরছিলাম। আমার সহযাত্রী ছিলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র মাইনুল। দিই অসমবয়সী সহযাত্রী অল্পক্ষণেই পারস্পরিক স্নেহ আর সম্মানে আপাপ জমে ওঠে। যেহেতু মাইনুল ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র তাই তার ঝোক ওইদিকেথাকাই স্বাভাবিক। মাইনুলের হাতে একটা বই, নাম- :পল এলুয়ার'। বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ হলো। খুব সুন্দর করে পল এলুয়ারে লেখা এবং জীববোধ নিয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়েছে- আমার ভালো লেগেছে। মাইনুল ঘুমিয়ে পড়লে আমি বইটা পড়া ধুরু করি এবং টানা চারঘন্টায় শেষ করি।
ফরাসি কবি পল এলুয়ার হচ্ছেন প্রেম ও দ্রোহের কবি। বিশ শতকের শুরুতে নারী চরিত্র অনেকটা গৌণ হয়ে যায়। লেখকরা রোমান্টিক গল্পের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে থাকেন সমাজের শেকড় সন্ধানের দিকে। রক্তাক্ত যুদ্ধের পটভূমিতে অস্পষ্ট হয়ে যায় নারীর মুখ। সাহিত্যের জগতে শুরু হয় অনেক ভাঙ্গাগড়া। দাদাইজম, সুরিয়লিজ, কিউবিজমসহ বিভিন্ন আন্দোলনের ফলে শিল্পকর্ম ও কবিতার বিষয়বস্তু বদলে যায়। এ-সব আন্দোলনের সঙ্গে পল এলুয়ারও যুক্ত হন।
রোমান্টিক যুগে নারী ছিল সৃষ্টির প্রাণ। কিন্তু আধুনিক যুগে নারী হয়ে পড়ে অবহেলিত। কাফকা, কাম্যু কিংবা হেনরি মিলারের লেখায় সেই নারীকে আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। মালার্মে কিংবা ভ্যালেরির কবিতায় নারীর এই চেহারা খুঁজতে গেলে হতাশই হতে হয়। এই সময় পল এলুয়ার তার কবিতায় নিয়ে আসেন রোমান্টিক প্রেমের চেহারা। কিন্তু কবিতা থেকে মোটেই বিদ্রোহ ও বিপ্লবকে ছেঁটে ফেলেননি।
ফ্রান্স যখন জার্মানির দখলে চলে যায়, তখনই তিনি লেখেন দি লিবার্টি কবিতা। কবিতাটি খুব দ্রুত বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে যায়। পাঠকদের কাছে পল এলুয়ার হয়ে ওঠেন গণমানুষের কবি। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ভীষণ অসুখী। তার জীবন প্রেম, বিচ্ছেদ ও হতাশায় পরিপূর্ণ।
চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য যান সুইজারল্যান্ডে। সেখানে তিনি এক রুশ কিশোরীর প্রেমে পড়েন। তার ডাক নাম গালা। তার সেবা-যত্নে এলুয়ার সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং দেশে ফিরে আসেন। গালা ফিরে যান নিজের দেশ রাশিয়ায়। এরপর গালা পল এলুয়ারের সঙ্গে ফ্রান্সে এলে এলুয়ার তাকে বিয়ে করেন।
তার কবিতা লেখার প্রধান প্রেরণা হয়ে ওঠেন গালা। দীর্ঘ সময় ধরে তারা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের বিয়ে টিকেনি। গালা স্পেনিশ শিল্পী সালভাদার দালির সঙ্গে পরকিয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন এবং তাকেই বিয়ে করেন।তিনি সারাজীবন তার সঙ্গেই কাটিয়েছেন। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই কঠিন দু;সময় মোকাবেলা করেই পল এলুয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম মারিয়া বেঞ্জ। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। তিনি মারা গেলে পল এলুয়ার তৃতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন ১৯৫১ সালে। তার নাম ডোমিনিক লেমোর্ট। একই বছর পল এলুয়ার মারা গেলে লেমোর্ট বিধবা হন। এলুয়ারের মৃত্যুর পর ফরাসি সরকার তার প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে, শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করতে রাজ হয়নি। তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কমিউনিস্ট পার্টি। তাতে জনতার ঢল নামে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:৪৪