তৃতীয় নয়ন.....
যে বা যারা আধ্যাত্মিকতাবাদে বিশ্বাসী এবং আধ্যাত্মিকতা চর্চা করেন তাদের সাথে আলাপ চারিতা করার একধরণের আকর্ষণ আছে... সেই আকর্ষনেই অনেকবার গিয়েছি লালনের আস্তানায়। চলতি বছরও গিয়েছিলাম। যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি- বছরে দুইবার লালন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। একবার দোল পূর্নিমার সময় দুই দিনের জন্য। আর ১ কার্তিক লালন সাঁইজির জন্মদিন উপলক্ষে তিন দিনের মেলা।
কালী নদীতীরের বিশাল মাঠের পশ্চিমে শতাধিক বাউলভক্ত-অনুসারী অস্থায়ী তাঁবু গেড়ে আস্তানা তৈরি করেন থাকার জন্য। আর পৃথক পৃথক আস্তানার মধ্যে অবস্থান নেওয়া বাউলেরা একতারা-দোতারাসহ নানা বাদ্যের তালে গেয়ে চলেছেন লালন শাহের গান। মাঠের দক্ষিণে তৈরি করা হয় মঞ্চ এবং উত্তরে বসে বিভিন্ন পণ্যের দোকান। এ ছাড়া লালন শাহের সমাধির পাশের ছাউনির নিচেও বসেছেন দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্ত-অনুসারীরা। এখানেও তাঁরা লালনের ‘অমর বাণী’ গেয়ে চলেছেন আপন মনে।
লালন আখড়াসংলগ্ন সাঁইজির অনেক ভক্তদের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। এবার আলাউদ্দিন সাধুর আস্তানায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাঁর সঙ্গে স্থানীয় ও বহিরাগত অসংখ্য ভক্ত-অনুসারীরাও যোগ দিয়েছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে যখন আমি আলাউদ্দীন সাধুর আখড়ায় পৌছি তখন তিনি চোখ বন্ধ করে দোতরায় সুর তুলে গাইছেন-
"কি খেলা দেখলাম গুরু বাঁকা নদীর পারে ভবে আসতে গুরু যেতেও গুরু...."
গান শেষে চোখ মেলে তাকিয়ে আমাকে ছাড়াও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলেন- দুপুরের খাবার খেয়েছি কিনা? তাঁর আস্তানায়ই তার মেহমানদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা আছে....খুবই সাধারণ মানের খাবার। কিন্তু ভিন্ন স্বাদে অত্যন্ত সুস্বাদু!
লালন সাঁইজির অনুসারীদের পরস্পর পরস্পরকে গুরু/ গুরুজী/ সাঁইজী সম্বোধন করেন এবং কারোর বয়স জানতে চাওয়া লালন সাঁইজির ভক্ত-আশেকরা পছন্দ করেন না। তাই আমি বয়স জিজ্ঞেস করিনা। আলাউদ্দীন সাধুর বয়স আন্দাজ করা কঠিন- তবে আমার ধারণা ৫০ এর মধ্যে হবে। আমি আলাউদ্দিন সাধুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনাকে সবাই গুরুজী সম্বোধন করে কেনো'?
আপনারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে অনেক কিছু জানেন। আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাই। কয়েক দিন ইসকুলে গেছিলাম... ছারে খালি মারে...তাই স্কুল ছাড়ছি, আর কোনো দিন স্কুলে যাই নাই। কিছুই শিখতে পারিনি। যা-কিছু শিখেছি তা গুরু বিদ্যা। গুরু মানে হলো 'ফ্রেন্ড ফিলসফার এন্ড গাইড।' আর 'অথিক গুরু পথিক গুরু গুরু অগনন' যে বলা হয় তা মনে হয় ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলো যাদের দেখে শিখেছি তাদের জন্য বলা.....
দোতারায় কয়েক বার টুংটাং ধ্বনি তুলে তিনি চোখ বন্ধ করে বললেন- " 'গুরু' শব্দটি 'গু' এবং 'রু' এই দুটি সংস্কৃত শব্দ দ্বারা গঠিত। 'গু' শব্দের অর্থ অন্ধকার এবং 'রু' শব্দের অর্থ যা অন্ধকারকে দূরীভূত করে। অর্থাৎ গুরু হলেন যিনি অন্ধকারকে দূর করেন। তবে আমি গুরু হতে পারিনি। আমি সাঁইজির নগন্য একজন ভক্ত। তিনি যদি কোনো দিন দয়া করে আমাকে জ্ঞান দান করেন তাহলে গুরু বলবেন।"
আমি জিজ্ঞেস করি- 'তাহলে গুরু আর শিক্ষকের অর্থ কি এক'?
"না!"
"গুরু হলেন তিনি, যিনি আমাদের তৃতীয় নয়ন অর্থাৎ "উপনয়ন" উন্মোচন করেন। আমরা রামকৃষ্ণ দেবের কথায় শুনেছিলাম, তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত মাতৃদর্শন লাভ করেন নি, যতক্ষণ না তাঁর গুরু তোতাপুরি তার তৃতীয় নয়ন উন্মোচন করেছিলেন।"
পৃথিবীর বাকি জীবজগতের সাথে মানুষের পার্থক্যই ঠিক এই জায়গাটিতেই। মানুষই একমাত্র ষড়রীপুকে জয় করে "আমি"কে জানতে সক্ষম। আর "আমি"কে জানা মানেই সৃষ্টিকর্তাকে জানা। বাইরে কোথাও খোঁজা বৃথা।
গুরু আমাদের জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের পথটি দেখান। তিনি শুধু বয়ে যাওয়াটা শেখান। খাতটি শিষ্যকে নিজেকেই তৈরি করতে হয়। যে গুরু অহংবোধে শিষ্যের থেকে সাবমিশন চান, তাঁর গুরু হয়ে ওঠা হয় না। আবার যে শিষ্য সেই সারেন্ডারে দ্বিধাগ্রস্ত হন, সে আদর্শ শিষ্য হতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন হলো, গুরুলাভ না করলেই বা ক্ষতি কি? অসংখ্য বিষয় আছে, ক্ষেত্র আছে, বই আছে নিজেকে উন্নত করার জন্য।
অবশ্যই আছে। একটি উদাহরণের সাহায্যে বলি-
আমি অনেক বই পড়ে (এখানে জানার মাধ্যম হিসাবে বইকে উদাহরণ হিসেবে নিলাম) অনেক কিছু জানলাম। জানার পরেই যে অনুভূতিটি আমার মধ্যে প্রাথমিকভাবে দেখা দিল, আমি যে জানি সেটা তো অপরকে জানাতে হবে। যথারীতি সেই পথেই এগোলাম। দেখলাম আমার পান্ডিত্যে পৃথিবীর নব্বই ভাগ মানুষ বাহ্ বাহ্ করলেন কিন্তু দশভাগ সে ভাবে তো প্রশংসা করলেন না। ঠিক এই জায়গাটা থেকে জন্ম নিল দুঃখ এবং সেই পথেই ক্রোধের সৃষ্টি। ষড়রীপুর একটি মোক্ষম রীপু এই ক্রোধ। সেই পথেই অহংবোধ হুঙ্কার ছাড়তে লাগলো (সশব্দে নাও হতে পারে)। আমার এই এতো জানা-বোঝার নিট রেজাল্ট হলো- BIG ZERO, তার কারণ অহংবোধ এসে আত্মদর্শনে বাধা সৃষ্টি করলো, এই আমিত্বকে অতিক্রম না করলে "আমি" কে দেখা যায় না!
মানুষ-জনের মধ্যে আধ্যাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার কোনরকম মহৎ উদ্দেশ্যে এই লেখা নয়। সকাল থেকে আকাশ, বাতাস, বন্ধু-বান্ধবী সবাই আমার "গুরু" বলে ছেদো বিতর্ক যাঁরা শুরু করেছেন, তাঁদের সশ্রদ্ধভাবে আমার তরফ থেকে এইটুকু জানালাম।
পরিশেষে বলি, লোকজনের তৃতীয় নয়ন উন্মোচন হোক্ না হোক্, মানবিক দৃষ্টি যেন সদা জাগ্রত থাকে। তাহলেই তো লোকজনদের "মানুষ" বলে ডাকতে ভালো লাগবে।"
কিভাবে যে তিনদিন তিনটা রাত চলে গিয়েছে বুঝতে পারছিনা! ভেংগেছে লালন মেলা....আমিও ফিরে আসছি....আর হৃদয়ের গহীনে সুর বাজে....."কি খেলা দেখলাম গুরু বাঁকা নদীর পারে ভবে আসতে গুরু যেতেও গুরু...."

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


