জেলখানায় বই পড়া.....
গুম কালীন শারীরিক নির্যাতনের কারণে আমি যখন ভয়ংকর অসুস্থ এবং মৃত্যুন্মুখ তখন মেরে ফেলার দ্বায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে র্যাব গ্রেফতার নাটক করে আমাকে মিরপুর মডেল থানায় হস্তান্তর করে। থানায় সাত দিনের রিমান্ড শেষে যখন জেলে পাঠায় তখনও মারাত্মক অসুস্থ ছিলাম। ৪০ হাজার টাকা খরচ করে কারা হাসপাতালের ৯ নম্বর সেলে যায়গা পাই। কারা হাসপাতালেও জেলখানার নিত্যকার কোনো না কোনো ফাইল ছাড়া বাকীটা সময় আমি ওয়ার্ডেই শুয়ে-বসে থেকেছি টানা তিনদিন।

ওয়ার্ড রাইটার সুদর্শন নাহিদ হাসান(জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের নেতা পুরনো ঢাকার দর্জি শ্রমিক বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যার একমাত্র যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কয়েদি। অন্যসব আসামিরা পালিয়ে গেলেও নাহিদ কোর্টে আত্মসমর্পণ করে নিজের অপরাধ স্বীকার করায় মৃত্যুদণ্ডে পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পায়) আমাকে যথেষ্ট সম্মান করতো এবং আমাকে আংকেল সম্বোধন করতো। ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৬ জন আসামিদের কাছে প্রায়শই ফজরের নামাজ শেষে নিজের অপরাধের জন্য সব সময় অনুতাপ করতো। অদম্য মেধাবী নাহিদ অনার্স-মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস প্রাপ্ত, মাষ্টার্স পরিক্ষায় অংশ নেয় জেলখানায়। প্রচুর বই পড়ে। রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যে নাহিদ জেলখানায় রাজকীয় জীবন যাপন করতো। রাইটার নাহিদ বিভিন্ন রাজনৈতিক বই, মনীষীদের জীবনীগ্রন্থ, দর্শনশাস্ত্র পড়তো- যা তাকে তার স্বজনরা দিতেন। নাহিদ আমাকে পড়তে দেয়- 'The Coffee Bean: A Simple Lesson to Create Positive Change' নামের একটা বই পড়লাম।

“কফি” শব্দটি ১৫৮২ সালে ডাচ শব্দ কফির মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে, উসমানী খিলাফতের সময়ে তুর্কিরা কাহভে শব্দটি এই পানীয়কে বুঝানোর ক্ষেত্রে ব্যাবহার করতো। য়ারা মূলত আরবি কাহওয়াহ শব্দ থেকে কাহভে শব্দের ব্যবহার শুর করে। কফি মূলত ইসলামিক বিশ্বে পানীয় হিসেবে পান করা হতো এবং এই পানীয়টি সরাসরি ধর্মীয় অনুশীলনের সাথে সম্পর্কিত ছিলো। মুসলিমরা পবিত্র রমজান মাসে অনেক বেশি কফি পান করতো যা তাদের দিনের বেলায় রোজা রাখার ক্ষেত্রে এবং রাতে জেগে থাকতে অনেক সাহায্য করে। ১৬ শতাব্দীতে উসমানীরা বিশ্বের সর্বপ্রথম কফিহাউস খুলেছিল যা আজ ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত। লেভানটাইন আরব (পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় আরব) এবং তুর্কিরা কফিহাউস তৈরি করেছিলো যেগুলো ১৬ শতাব্দীর মুসলিম ঐতিহ্যবাহী কফিহাউসের পাণ্ডুলিপি আলোচনা ও সামাজিকীকরণের জন্যও ছিল।
ষোড়শ শতাব্দীতে ইস্তাম্বুলে কফিহাউসগুলো একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিলো। এমনকি উসমানীয় রাজদরবারগুলোতে সুলতান ও তার অতিথিদের কফি পরিবেশন করা ছিলো আপ্যায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এছাড়াও কফির পাত্রগুলো সুন্দর এবং নিখুঁতভাবে তৈরি করার জন্য সুলতানদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে কফি মেকারদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে কফিকে আরবে "শয়তানের পানীয়" বলে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল! তারপর কেটে গেছে বহু যুগ, বহুকাল! আস্তে আস্তে কফি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে! ইস্তাম্বুলে পৃথিবীর প্রথম কফি শপ নির্মিত হয় ১৪৭০ এ - Kiva Han নাম ছিলো এটির! ইস্ট ইন্ডিয়া ট্রেডিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠার আগেই ভারতবর্ষে কফি পানের প্রচলন ছিলো। বাবা বুদান নামক ভারতীয় একজন সুফি সাধক ১৬৭০ সালে মক্কা থেকে ফেরার সময় কয়েকটি কফি বীজ নিয়ে আসেন। সেগুলো রোপন করেন দক্ষিণ কর্নাটকের চিকমাগালুরে। ব্যাস কফি চাষ শুরু হয়! সম্রাট শাহজাহান কফি ভক্ত ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে চায়ের আগ্রাসনে ধীরে ধীরে কফির জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। তবে কফি হাউজগুলো ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে শিল্প সংস্কৃতি ধর্ম ও রাজনৈতিক আড্ডার অন্যতম কেন্দ্রস্থল।
কফি যে মানুষের জীবনধারা, চিন্তা চেতণাকে বদলে দিতে পারে- তা 'The Coffee Bean: A Simple Lesson to Create Positive Change'- লেখক ডেমন ওয়েস্ট ও জন গর্ডন। বইতে একটা গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। গল্পটা শেয়ার করছিঃ-
অ্যাব্রাহাম নামের কিশোর মার্কিন হাইস্কুলের ছাত্র। খুব ভালো ফুটবল খেলত। ফুটবলের জন্যই স্কুলে সে রীতিমতো তারকা বনে গিয়েছিল। সবাই তাকে পছন্দ করত। পড়ালেখায়ও সে বেশ ভালো। স্কুলে অ্যাব্রাহামের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মিস্টার জ্যাকসন।
জ্যাকসন লক্ষ করলেন, ক্লাসে অ্যাব্রাহামের ইদানীং মন নেই। বিষন্ন মনে কী যেন ভাবে। জ্যাকসন তাঁর প্রিয় ছাত্রকে ক্লাসের পর দেখা করতে বললেন। জানতে চাইলেন, ‘ কী হয়েছে তোমার?’
অ্যাব্রাহাম জানাল, তাঁর বাসায় খুব ঝামেলা চলছে। মা-বাবা প্রতিদিন ঝগড়া করেন। যেকোনো দিন তাঁরা আলাদা হয়ে যাবেন। সামনে পরীক্ষা। আবার খুব গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টও আসছে। সবাই তাকিয়ে আছে অ্যাব্রাহামের দিকে- কিন্তু সে এই চাপ আর নিতে পারছে না।
জ্যাকসন কিন্তু ছাত্রকে একটা অদ্ভুত অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। বললেন, ‘তুমি কাল সকালে একটা পাতিলে পানি আর একটা গাজর নেবে। তারপর পাতিলটা চুলায় বসিয়ে পানি গরম করবে। কী হয়, আমাকে জানাবে।’ অ্যাব্রাহাম বাধ্য ছেলের মতো তা-ই করল। পরদিন স্যারকে জানাল, পানি গরম হওয়ার পর গাজরটা সেদ্ধ হয়ে একদম নরম হয়ে গেছে।
জ্যাকসন এবার আরেকটা অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন,- ‘এবার তুমি গাজরের বদলে পানিতে একটা ডিম রাখবে। কী হয়, আমাকে জানাবে।’
পরদিন অ্যাব্রাহাম জানাল, পানির গরমে ডিমটা সেদ্ধ হয়ে শক্ত হয়ে গেছে।
স্যার বললেন, ‘তুমি এবার পানিতে এক চামচ কফির দানা দেবে। দেখবে কী হয়।’ অ্যাব্রাহাম তা-ই করল। পরদিন জানাল- কফি পানির সঙ্গে মিশে গেছে।
স্যার লম্বা দম নিয়ে বললেন, ‘শোনো, তুমি যখন চারপাশ থেকে চাপ অনুভব করবে, তখন চাইলে গাজরের মতো নরম হয়ে যেতে পারো, কিংবা ডিমের মতো শক্ত হতে পারো। মনে মনে বলতে পারো, “তোমরা আমার ওপর চাপ দিচ্ছ? ঠিক আছে, আমিও শক্ত হয়ে থাকব।” তাতে কিন্তু তোমার কষ্টই বাড়বে। তোমাকে যা করতে হবে, সেটা হলো কফির দানার মতো আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। খেয়াল করে দেখো, গাজর বা ডিমের ক্ষেত্রে কিন্তু পানির কোনো পরিবর্তন হয়নি। গাজর নরম হয়ে গেছে, ডিম শক্ত হয়েছে। কিন্তু কফির দানা তার চারপাশ বদলে ফেলেছে। কফির ক্ষেত্রে পানিটা আর শুধু পানি নেই।’
স্যারের গল্প শুনে অ্যাব্রাহাম যে রাতারাতি তার জীবন পাল্টে ফেলেছিল, তা কিন্তু নয়। বিপুল উদ্যমে খেলতে নেমে তার পা ভেঙে গিয়েছিল! তার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি। তবু, সে স্যারের কথা মনে রেখেছে। নিজের স্কুলে ‘কফি বিন ক্লাব’ খুলেছে। ঘুরে ঘুরে সবাইকে এই তত্ত্বের কথা বলেছে।
ডেমন ওয়েস্ট ও জন গর্ডন বলছেন, এই গল্পের শিক্ষা যদি আপনি নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে আপনার জীবনেও আসতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তন। হ্যা, আমিও আমার জীবনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক পরিস্থিতি এবং বর্তমান জেল জীবনে একটা পরিবর্তন খুঁজে পেতে চেষ্টা করবো। কফি নিয়ে এমন একটা বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি।
নাহিদের সংগ্রহে হানিয়া ইয়ানাগিহারার 'আ লিটল লাইফ', জর্জ এলিয়টের 'মিডলমার্চ', চার্লস ডিকেন্সের 'ব্লিক হাউস', মিগুয়েল ডি সার্ভান্তেসের 'ডন কিয়োটে', ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের 'ইনফিনিট জেস্ট', লিও টলস্টয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পিস', স্টিফেন কিং এর 'দ্য স্ট্যান্ড' এর মতো বিশ্ববিখ্যাত বইগুলো দেখে অবাক হয়েছি। যদিও এইসব বই আমি আগেই পড়েছি। রাইটার নাহিদের শিক্ষা এবং রুচিশীলতায় মুগ্ধ হয়েছি।
সুযোগ পেলে আমি সকালে লাইব্রেরীতে যাই- খবরের কাগজ পড়তে। তিনটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত আসামি কয়েদীদের জন্য মুক্ত সময়- তখন আমি জেলখানার ভেতর যতটুকু যায়গায় যাওয়া যায় সেইসব যায়গা ঘুরে দেখি। গোটা জেলখানার ভেতর বাউন্ডারি ওয়ালে দেশ বিদেশের অনেক মনীষীদের অসংখ্য নীতিবাক্য/ বাণী উদ্ধৃত করা- যাদের মধ্যে সব চাইতে বেশী নীতিবাক্য হজরত আলী রাঃ, মহানবী হজরত মুহাম্মদ সঃ আঃ এর। বাদ নাই- নজরুল, কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, ইউরোপ আমেরিকা ছাড়াও বিশ্বের অনেক নোবেল লরিয়েটদের বাণী। এইসব বাণী পড়ে মনে হবে- জেল কতৃপক্ষ সবাই মাহা মানব। আসলে এরা সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত। টাকা ছাড়া এখানে সব মিথ্যা। Money is not everything. But everything needs money.....এটাই জেলখানার আদর্শ বাণী হওয়া উচিত!
আজ "বিশ্ব কফি দিবস" উপলক্ষে লেখাটি শেয়ার করলাম।
(ছবিসূত্রঃ গুগল। ছবিতে হাফ সোয়েটার গায়ে লোকটাই নাহিদ)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


