উকিল সাহেব ঘুরে দাঁড়ালেন। চোখের চশমা এঁটে দ্বিতীয় সারিতে বসে থাকা মিসেস সারিকা চৌধুরীর দিকে তাকালেন। যদিও সারিকা চৌধুরী নামের পাশের মিসেস ব্যবহার করছেন না, যেমন কেসের ওপরের বাদী বিবাদীর নামের হিসেবে সারিকা খান ব্যবহার করা হয়েছে।
সাধারনত, ডিভোর্সের জন্য এভাবে আদালতে আসতে হয় না।
কাঠগড়ায় দাঁড়ানো হিমালয় চৌধুরী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন।
একবার সারিকার দিকে তাকালেন।
আর মনে করলেন কিছু দিন আগের ফোনালাপ।
ঃ সারিকা, আমার মনে হয় না আইরিন কে আমার কাছে রাখা উচিত। দুধের বাচ্চা!!
- আমার নাম মুখে নিয়ো না… তুমি কি ভেবেছো? তোমার বাচ্চা গছিয়ে দিয়ে চলে যাবে?
ঃ এখানে গছানোর কিছু আসছে না….তোমার কাছে থাকলে যত্নে থাকবে। আমি ওর পুরো খরচ বা দায়ভার নিতেও সংকোচ করছি না।
- আবার তোমার টাকার গরম দেখাচ্ছো। নিজের কাছেই রাখো তাহলে? আমার একটা নতুন সংসার হবে সেখানে এই বাচ্চা নিয়ে আমি কি করবো?
ঃ নতুন সংসারের কথা ভেবে ফেলেছো?
- তো আর কি? তোমার মত মহান দেবদাসের অপেক্ষায় থাকবো?
ঃ সারিকা, সন্তানটা যে আমার তুমি নিশ্চিত?
- অবশ্যই…
ঃ আমি রেকর্ড করছি না কথা, তুমি চাইলেই বলতে পারো!! আর যাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছো সে ঘর বাঁধার মানুষ না…
- এসব রাখো… কোর্টেই ফয়সালা হয়ে যাবে… আমিই ভূল ছিলাম। কি ভাবো তুমি।
পাশ থেকে লইয়্যার সাহেব ফোন ধরেছিলেন!! ধরে চাতুর্যপূর্ণ হাসি হেসে বলেছিলেনঃ
“আমি জানতাম আপনি এইগুলোই বলবেন। রেকর্ডটা রাখলাম।”
.
লইয়্যার হাসিব মৃধা পাঁকা লোক, পাঁকা লোক বলেই সারিকার মত মেয়ের মাথা খেয়েছিলো।
অথচ সময় হিসেব করলে হিমালয় দেশে ফেরার চারমাস পর আইরিনের জন্ম হয়েছে।
হিমালয় চৌধুরীর পাসপোর্টই তার সাক্ষী।
কিন্তু সারিকা আর উকিল দুজনেই জানে হিমালয় এটা করবে না। সারিকাকে মানুষের সামনে ছোট করার ইচ্ছে নেই তা নয়, সে ক্ষমতাই পায় নি মানুষটা।
.
উকিল এসেই খুব নোংরা একটা টপিক নিয়ে কথা শুরু করলোঃ
- লাস ভেগাস থেকে আসছেন শুনলাম, ভালো জায়গা বটে!! আপনি তো বুদ্ধিমান মানুষ, তাহলে নিজের মেয়ের জন্মের দায় কেন নিবেন না?
ঃ আমি এখনো বাচ্চাকে দেখিই নাই আর আমি এটা আমার নিজের স্বার্থ …
- স্বার্থ নিয়েই যখন বললেন তখন মনে করিয়ে দিচ্ছি, আপনি খরচ দেয়া বাদে আপনার স্ত্রীর কোন ব্যাপারটা দেখতেন?
ঃ মানছি আমি ব্যস্ত থাকতাম….
- বিয়ে মানে লাস ভেগাসের মেয়ে পণ্য না যে টাকা দিলাম আর দায়িত্ব শেষ হয়ে গেলো…।
ঃ আপনি বাড়াবাড়ি করছেন…
- ইয়োর অনার সত্য বললে বাড়াবাড়ি মনে হয় ওনার কাছে…নিজের বাচ্চার দায় ভার যে পুরুষ নিতে চায় না, তাকে কি করা উচিত? এই লোকটা দিনের পর দিন স্ত্রীকে রেপ করেছেন।
.
বলার সাথে সাথে কোর্টরুমে গুঞ্জন উঠেছে। হিমালয় সারিকার দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটার মুখ রক্তহীন সাদা, এই উকিলটা এটাও জানবে না যে, সারিকা এমন সিচুয়েশান হ্যান্ডেল করতে পারে না। মেয়েটার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
আবার দম নিয়ে হাসি মুখে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
- কি চৌধুরী সাহেব ঠিক বললাম তো? ইচ্ছের বিরুদ্ধে সব কিছুই তো রেপ তাই না?
ঃ এটা কি সারিকা বয়ান দিয়েছে? আমি ওর মুখে একবার চাই… অন্তত এই ব্যাপারটা মিথ্যা, হয়তো আমি সময় কম দিয়েছি।
- ইয়োর অনার আমি সারিকা ম্যামকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে অনুরোধ করছি।
.
সারিকা বেশ এলোমেলো পা ফেলেই দাঁড়ালো, একটা চেয়ার দেয়া হলো বসতে, ক্রমাগত ঘামছে মেয়েটা। হিমালয় নিশ্চল চোখে সারিকাকে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। হিমালয় উকিলের কোন কথাই শুনছে না। সিদ্ধান্তটা বেশ কঠিন।
কেমন জানি নিজেকে আলাদা লাগে। ঘোরের মধ্যে চলে যায়।
খারাপ লাগা আরর প্রতিশোধের আগুন একসাথে খেয়ে ফেলছে। নিজের পক্ষের উকিলকে ইশারা করে বসে থাকতে বললো হিমালয়।
উকিল সাহেব সারিকার অসুস্থতাকে হিমালয়ের অবহেলা আর অত্যাচার বলে ব্যাখ্যা করে প্রমাণ করতে ব্যস্ত।
সারিকা একবার শুধু হিমালয়কে দেখেছে।
আর উকিলের করা প্রশ্নে, হুম, হ্যা, না জবাব দিয়েছে।
.
হিমালয়ের পক্ষের উকিল উঠে দাঁড়াচ্ছিলো
হিমালয় সারিকার অবস্থা দেখে বলেই ফেললোঃ
“আমি বাচ্চার দায়ভার নিবো।
আর হ্যা বাচ্চাটা আমার।
বাচ্চাকে আমার কাছেই রাখার অনুমতি চাচ্ছি।”
.
উকিলের হাসি মুখ দেখা গেলেও, সবচেয়ে অবাক হয়েছে সারিকা। কথাটা বলেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সারিকার দিকে। মেয়েটাও তাকিয়ে আছে।
.
হিমালয়কে আর্থিক জরিমানা করা হলো,
আর ছয় মাস বয়সী আইরিনকে দেয়া হলো হিমালয়ের কাছে। বাড়িতে মা আছেন, মা নিশ্চয়ই ব্যাপারটা দেখবেন।
মাকে এসব ব্যাপারে হিমালয় জড়ায়নি। পর পর কয়েকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললো হিমালয়। মনের ভেতর স্বস্তি কাজ করছে।
.
বাচ্চাকে কোলে দিতেই হিমালয়ের কড়ে আঙ্গুল খামচে ধরে মেয়েটা। হিমালয় বেশ অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখে।
এত সুন্দর একটা মেয়ে?
সারিকা এক নজরে মেয়েটাকে দেখতেই থাকে।
মেয়েটা হয়তো জানেও না, উকিলের সব প্লান শুধু নিজের রেপুটেশন এর জন্যে। সারিকাকে এখন হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাও হয়তো মানুষটার ছিল না।
.
হিমালয়ের পক্ষের উকিল বন্ধু ফয়সালকে টাকাও খাম বাড়িয়ে দেয়।
ফয়সাল টাকা নিতে গিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বলে,
- শালা, আসলেও তুই একটা বোকচোদ, এমন মামলায় কেউ হারে? ( কলেজের ফ্রেন্ড ফয়সাল রাগে প্রায় নিজেকে সামাল দিতে পারে না।)
হিমালয় অন্য একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
উকিল সাহেবকে দিস, লোকটার ফুসফুস হাওয়া পাবে।
- খামে কি আছে?
ঃ প্রমান।
- এখন আর কি?
ঃ আমি যে হেরে যাই নি তার প্রমান।
- মানে কি?
ঃ সিম্পল, ডিএনএ টেস্ট। আমি জানি এটা উকিলে সাহেবের মেয়ে, তুইও জানিস, কিন্তু সারিকাই তো ওর মা, তাই থাকুক মেয়েটা আমার কাছে!!
- এটা কোন পুরুষের কথা হলো? ম্যাচুরিটি আর কমনসেন্সও কি তোর নাই? ওদের পাপ তোর কাঁধে চাপাচ্ছে!! মহাপুরুষ হওয়ার সাধ জাগছে? বাল!!
ঃ বাচ্চার তো পাপ নেই। আমারও প্রথমে তোর মতই রাগ উঠেছিলো। ভেবেছিলাম সব প্রমান দিবো। কিন্তু এতে তো সারিকা ভালো থাকবে, আমি হেরে গিয়েও কিন্তু ওর সন্তানকে কেড়ে নিয়েছি। উকিলের কাছে জয়টাই সব। কিন্তু সারিকার কাছে জয় পরাজয় ভিন্ন এই বাচ্চাটাই কিন্তু….
হিমালয়ের গলা ধরে আসে….
.
মেয়েটার নাম বদলে সে রেখে দেয়ঃ লীলাবতী।
সারিকা যোগাযোগের অনেক চেষ্টাই করেছে কিন্তু মেয়ের মুখ দেখার ভাগ্য তার কপালে জোটে নি। হিমালয় দেশই ছেড়ে দিয়েছে পরে।
.
উকিল সাহেব একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেছেন শুনেছে হিমালয়। আর সারিকা তার বাবার ইস্কাটনের বাড়িতেই থাকে। সব খবরই রাখে হিমালয়।
হিমালয় দেশ ছেড়েছিলো বাচ্চাকে নিয়ে।
লীলাবতীর প্রথম চার বছর কেটেছে হিমালয়ের মায়ের কোলেই।
মা মারা গেলেও কষ্ট করে লীলাবতীর সব খেয়াল রেখেছে হিমালয়।
অফিসে যাওয়ার সময় বাড়ির কাজের লোকদের কাছে রেখে না যেতে হয় বলে রিনু খালাকে দেশ থেকে এনে রেখেছে।
আর অফিসের বাইরে যেটুকু সময় পায় মেয়েটাকে নিয়েই কাটে। ঘুরতে যায়, লং ড্রাইভে যায়। এমনকি মেয়েটার ক্লাসিক্লাল ড্যান্স ক্লাসে অন্য সবার মায়ের পাশের সীটে বসে মুগ্ধ নয়নে মেয়েটাকে দেখে।
মেয়েটা ভালো স্কেটিং শিখেছে।
সুন্দর ছবি আঁকে।
.
প্যারেন্টস ডে তে সব বাচ্চারা বাবা মায়ের ছবি এঁকেছে।
লীলাবতী এঁকেছে শুধু সারিকার ছবি।
শুধু মায়ের ছবি।
হিমালয় মেয়ের ভেতর ঘৃণা ভরেনি।
বলেছে তার মা হারিয়ে গেছে।
খুঁজেছে, পায়নি।
মেয়েটা হয়তো ফার্স্ট প্রাইজ পায় নি।
কিন্তু, বাবা আর মেয়ে দুজনকে জড়িয়ে অনেক কেঁদেছে।
একজন মানুষের অনুপস্থিতির কান্নাও দুজন কাঁদে দুই কারনে। হিমালয় অপরাধবোধে ভোগে আর মেয়েটা মা না থাকার কষ্টে।
.
তিনদিন আগে লীলাবতীর বয়স পনেরো তে পড়েছে।
লীলাবতীর ইচ্ছায় দুজন প্যারিসে ঘুরে এসেছে।
সারিকার মত লম্বা চুল হয়েছে লীলাবতীর ।
পেছন থেকে দেখলে লীলাবতীর কলেজের সেই দিনগুলোর কথা মনে হয়।
মেয়েটা খালার কাছে শাড়ি পরাও শিখে ফেলেছে।
.
মেয়েটার বয়স সতের হলেই হিমালয়ের একটা প্লান আছে….
সারিকার ইস্কাটনের বাড়িতে লীলাবতীকে নিয়ে যাবে।
সতেরই কেন?
সতের বছরের দুরন্ত সেকেন্ড ইয়ারেই মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো হিমালয়।
আচ্ছা তখন সারিকার কি সব চুল পেঁকে যাবে?
ব্যাপারটা অনেক বেশি ড্রামাটিক।
কিন্তু হিমালয় নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে।
.
ভালোবাসার মানুষের কষ্টে, নিজেরই কষ্ট হয়।
এই কষ্ট না পেলে সারিকা জানতেই পারতো না যে উকিল সাহেব ধোঁকা দিবেন।
হিমালয় কখনোই মহাপুরুষ হতে চায় নি।
তবু নিজের জন্য প্রকৃতি গল্প সাজায়, সে গল্পের রানী হারালেও, সামনে থাকা বড়েই আবার রানীকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
জীবনটা দাবার মত না।
তবু,
জীবনে একবার মহাপুরুষ এর মতঃ
লীলাবতী মা বলে সারিকাকে জড়িয়ে ধরছে এমন দৃশ্যে দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে ইচ্ছে করে।
.
আচ্ছা মহাপুরুষরা কি কাঁদে, হয়তোবা না, তবু সারিকার ছবি দেখলে হিমালয়ের কষ্ট হয়, চোখে পানি আসে, তখন কোথা থেকে যেন মেয়েটা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে রাখে চুপ করে, কোন কথাই বলে না, বাবার চোখে কান্না সে সহ্য করতে পারে না। হারিয়ে যাওয়া মাকে খুঁজতে ইচ্ছে করে মেয়েটার।
লীলাবতীকে সময় দিয়েছে হিমালয়, সারিকার প্রতি সত্যি অবিচার করেছিলো হিমালয়। ব্যবসা আর টাকার পিছনে পাগলের মত ছুটেছে। মেয়েটার অপরাধে ক্ষমা করেছে কবেই।
যদি সারিকার হাত ধরে ক্ষমা চায়,
সারিকা কি ক্ষমা করবে?
মেয়েটাকে দেখেও কি করবে না?
উত্তরটা হিমালয়ের জানা নেই।
.
.
_রিফাত চৌধুরী।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:২২