somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিস্মরনের গল্প।

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই শহরে আমি আসার পরে প্রথম যেদিন তুষারপাত হয়েছিল সেদিনই আমি প্রথম ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। তাই তুষারপাতের সাথে ওর নামটাও বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে আছে। সেদিন ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরেটা সাদা হয়ে আছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্য। গরমের দেশের মানুষের কাছে জীবনের প্রথম তুষারপাত একটুতো স্মরনীয় হবেই।

সেদিনের মতো এবারও তুষার পড়ছে। আমি মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছি। বাইরে বেশ অন্ধকার। একটু পরেই আমার ট্রেন ছাড়বে কার্ডিফের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য কার্ডিফ কিন্তু যাত্রা উদ্দেশ্যহীন। রাতের অন্ধকার তখনো কাটেনি। আমি ট্রেনের ভেতর ঢোকার আগে কস্তা থেকে একটা ধোঁয়া ওঠা আমেরিকানো নিলাম। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে। ট্রেন ছাড়লো ঠিক সময়েই। পেরিয়ে যেতে থাকলাম বিভীষিকার শহর লন্ডন। যে শহরের রাস্তা গুলো শুধু মনে করিয়ে দেয় কোন এক মানবীর অশরীরি উপস্থিতি। এ যেন এক ধরনের পালিয়ে যাওয়া। আমার ঝোলার ভেতর ছিল পার্সি ওয়েস্টারম্যানের মিসিং ডিপ্লোম্যাট। কিছুক্ষন পড়ার পরেই বিরক্ত লাগছিলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি চারপাশে শুধু শুভ্র নিরব তুষারপাত। অসহ্য সুন্দর সেই দৃশ্য। এমন তুষারপাত একা দেখা যায় না। কোন এক মানবীর পাশে ল্যাটে হাতে এই তুষারপাত দেখতে হয়। এই প্রবল অথচ অসম্ভব ইচ্ছাটাই আমাকে দুর্বল করে দেয়। আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমার পরাজয়ের গ্লানিভরা গল্পগুলো। যে গল্পে কেউ জয়ী নই, যেটা শুধুই দুজন পরাজিত মানুষের গল্প। যাদের পরাজয় এই সময়ের কাছে, চারপাশের মানুষগুলোর কাছে।

ট্রেন থামলো রিডিং স্টেশনে। সামনের সিটে পুরোদস্তুর দাপ্তরিক এক যাত্রি উঠে বসল। পুরো কামরাতে আমরা চার পাঁচ জন যাত্রি। ট্রেন ছুটে চলল কার্ডিফের দিকে। আমার হেডফোনে বাজতে থাকলো, জন ডেনভারের রকি মাউন্টেন হাই।

কার্ডিফ স্টেশনে এসে খেয়াল করলাম সাইন গুলোতে ইংরেজির নিচে অদ্ভুত কিছু লেখা। বুঝলাম এই হল ওয়েলশ। কয়েকটা ওয়েলশ শব্দ শিখে ফেললাম। এবার নিউপোর্ট রোড থেকে সোজা চলে গেলাম কার্ডিফ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। সংগ্রহ খুবই গরিব। কয়েকটা সিরামিকের সংগ্রহ আর পুরোনো কিছু ছবি।

এরপর শুরু হল আমার সমুদ্র যাত্রা। কার্ডিফ থেকে পেনার্থ। পেনার্থ মেরিনাতে এসে শুরু হলো বৃষ্টি। দুপাশে সমুদ্র রেখে কার্ডিফ ব্যারেজ দিয়ে আমি হাঁটতে থাকলাম। পাহাড়গুলো ঢেকে আছে শুভ্র তুষারে। আমি পেনার্থ থেকে বাসে উঠে আবার রওনা দিলাম কার্ডিফের দিকে। এবার কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি দেখবো।

এরপর সন্ধ্যা নেমে এলো। ভার্সিটির পাশেই ক্রোকারটন,লয়েডস্ এর নাম্বার ওয়ান বার। ক্রিসমাসের জন্যে প্রচন্ড ভিড়। আমি কোনার দিকের একটা টেবিল বেছে নিলাম। বিগ স্ক্রিনে শাকিরার নাচ চলছে। ওয়েলশের হুইস্কি টেস্ট করতে চেয়েছিলাম। তাই পেন্ডেরিনও অর্ডার করলাম। ততোক্ষনে বেশ রাত হয়ে গেছে। ভাবছিলাম ঢাকাতে কয়টা বাজে? কি করছে সে? এই যে হঠাৎ একা হয়ে যাওয়া, এই যে একাকিত্বের প্রবল উদযাপন, এর কি কোন মানে হয়? প্রতিটি জন্মদিন মনে করিয়ে দেয় বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এবারও তার ব্যাতিক্রম নেই। তবে শুধু অপেক্ষা ছিল তার শুভ বার্তার। কিন্তু একসময় যেমন জন্মদিন গুলোতে কেঁপে উঠতো সেলফোন, সেই সেলফোনটা আজ একবারের জন্যেও কেঁপে ওঠেনি। হয়তো ফেসবুকের দেয়াল ভর্তি হয়ে থাকবে শুভ কামনা গুলো। হয়তো কাল দিনের বেলায় কিছু ফোন কল আসবে। কিন্তু যে মানুষটার শুভ কামনার জন্যে আমার ব্যাকুল প্রতীক্ষা সেই মানুষটাই হয়তো সব ভুলে বসে আছে দূরের কোন শহরে অথবা নিরব অভিমানে সেলফোন হাতে তাকিয়ে দেখছে রাতের আকাশ। মেনে নিচ্ছে আমাকে ভুলে যাওয়ার অহংকারের কাছে নিজের প্রচন্ড ইচ্ছার প্রবল পরাজয়। হেডফোনে তখন বাজছিল মাইকেল বোল্টনের হাউ অ্যাম আই সাপোসড টু লিভ উইদাউট ইউ। একটি প্রেমের কবিতা লিখবো বলে আমি যাকে ভালোবেসে ছিলাম সেই মানুষটাকে হারিয়ে ঐ অসম্পূর্ণ কবিতাটাই বুক পকেটে নিয়ে আমাকে হেঁটে যেতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। এক সমুদ্র পিপাসা নিয়ে আমি শূন্য গ্লাসটার পাশে বসে থাকি। শান্ত দিঘির জলের মতো চোখদুটোকে ফরমালিনে ভিজিয়ে পড়ার টেবিলে রেখে দিতে ইচ্ছা হয়।

তবু এইসব জয়-পরাজয় নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। কুশল বিনিময়ের সময় মিথ্যে করে বলা, ভালো আছি। এই আমাদের ভালো থাকা, এই আমাদের বেঁচে থাকা।




সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:৫৯
২০টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×