সেদিনের মতো এবারও তুষার পড়ছে। আমি মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছি। বাইরে বেশ অন্ধকার। একটু পরেই আমার ট্রেন ছাড়বে কার্ডিফের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য কার্ডিফ কিন্তু যাত্রা উদ্দেশ্যহীন। রাতের অন্ধকার তখনো কাটেনি। আমি ট্রেনের ভেতর ঢোকার আগে কস্তা থেকে একটা ধোঁয়া ওঠা আমেরিকানো নিলাম। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে। ট্রেন ছাড়লো ঠিক সময়েই। পেরিয়ে যেতে থাকলাম বিভীষিকার শহর লন্ডন। যে শহরের রাস্তা গুলো শুধু মনে করিয়ে দেয় কোন এক মানবীর অশরীরি উপস্থিতি। এ যেন এক ধরনের পালিয়ে যাওয়া। আমার ঝোলার ভেতর ছিল পার্সি ওয়েস্টারম্যানের মিসিং ডিপ্লোম্যাট। কিছুক্ষন পড়ার পরেই বিরক্ত লাগছিলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি চারপাশে শুধু শুভ্র নিরব তুষারপাত। অসহ্য সুন্দর সেই দৃশ্য। এমন তুষারপাত একা দেখা যায় না। কোন এক মানবীর পাশে ল্যাটে হাতে এই তুষারপাত দেখতে হয়। এই প্রবল অথচ অসম্ভব ইচ্ছাটাই আমাকে দুর্বল করে দেয়। আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমার পরাজয়ের গ্লানিভরা গল্পগুলো। যে গল্পে কেউ জয়ী নই, যেটা শুধুই দুজন পরাজিত মানুষের গল্প। যাদের পরাজয় এই সময়ের কাছে, চারপাশের মানুষগুলোর কাছে।
ট্রেন থামলো রিডিং স্টেশনে। সামনের সিটে পুরোদস্তুর দাপ্তরিক এক যাত্রি উঠে বসল। পুরো কামরাতে আমরা চার পাঁচ জন যাত্রি। ট্রেন ছুটে চলল কার্ডিফের দিকে। আমার হেডফোনে বাজতে থাকলো, জন ডেনভারের রকি মাউন্টেন হাই।
কার্ডিফ স্টেশনে এসে খেয়াল করলাম সাইন গুলোতে ইংরেজির নিচে অদ্ভুত কিছু লেখা। বুঝলাম এই হল ওয়েলশ। কয়েকটা ওয়েলশ শব্দ শিখে ফেললাম। এবার নিউপোর্ট রোড থেকে সোজা চলে গেলাম কার্ডিফ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। সংগ্রহ খুবই গরিব। কয়েকটা সিরামিকের সংগ্রহ আর পুরোনো কিছু ছবি।
এরপর শুরু হল আমার সমুদ্র যাত্রা। কার্ডিফ থেকে পেনার্থ। পেনার্থ মেরিনাতে এসে শুরু হলো বৃষ্টি। দুপাশে সমুদ্র রেখে কার্ডিফ ব্যারেজ দিয়ে আমি হাঁটতে থাকলাম। পাহাড়গুলো ঢেকে আছে শুভ্র তুষারে। আমি পেনার্থ থেকে বাসে উঠে আবার রওনা দিলাম কার্ডিফের দিকে। এবার কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি দেখবো।
এরপর সন্ধ্যা নেমে এলো। ভার্সিটির পাশেই ক্রোকারটন,লয়েডস্ এর নাম্বার ওয়ান বার। ক্রিসমাসের জন্যে প্রচন্ড ভিড়। আমি কোনার দিকের একটা টেবিল বেছে নিলাম। বিগ স্ক্রিনে শাকিরার নাচ চলছে। ওয়েলশের হুইস্কি টেস্ট করতে চেয়েছিলাম। তাই পেন্ডেরিনও অর্ডার করলাম। ততোক্ষনে বেশ রাত হয়ে গেছে। ভাবছিলাম ঢাকাতে কয়টা বাজে? কি করছে সে? এই যে হঠাৎ একা হয়ে যাওয়া, এই যে একাকিত্বের প্রবল উদযাপন, এর কি কোন মানে হয়? প্রতিটি জন্মদিন মনে করিয়ে দেয় বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এবারও তার ব্যাতিক্রম নেই। তবে শুধু অপেক্ষা ছিল তার শুভ বার্তার। কিন্তু একসময় যেমন জন্মদিন গুলোতে কেঁপে উঠতো সেলফোন, সেই সেলফোনটা আজ একবারের জন্যেও কেঁপে ওঠেনি। হয়তো ফেসবুকের দেয়াল ভর্তি হয়ে থাকবে শুভ কামনা গুলো। হয়তো কাল দিনের বেলায় কিছু ফোন কল আসবে। কিন্তু যে মানুষটার শুভ কামনার জন্যে আমার ব্যাকুল প্রতীক্ষা সেই মানুষটাই হয়তো সব ভুলে বসে আছে দূরের কোন শহরে অথবা নিরব অভিমানে সেলফোন হাতে তাকিয়ে দেখছে রাতের আকাশ। মেনে নিচ্ছে আমাকে ভুলে যাওয়ার অহংকারের কাছে নিজের প্রচন্ড ইচ্ছার প্রবল পরাজয়। হেডফোনে তখন বাজছিল মাইকেল বোল্টনের হাউ অ্যাম আই সাপোসড টু লিভ উইদাউট ইউ। একটি প্রেমের কবিতা লিখবো বলে আমি যাকে ভালোবেসে ছিলাম সেই মানুষটাকে হারিয়ে ঐ অসম্পূর্ণ কবিতাটাই বুক পকেটে নিয়ে আমাকে হেঁটে যেতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। এক সমুদ্র পিপাসা নিয়ে আমি শূন্য গ্লাসটার পাশে বসে থাকি। শান্ত দিঘির জলের মতো চোখদুটোকে ফরমালিনে ভিজিয়ে পড়ার টেবিলে রেখে দিতে ইচ্ছা হয়।
তবু এইসব জয়-পরাজয় নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। কুশল বিনিময়ের সময় মিথ্যে করে বলা, ভালো আছি। এই আমাদের ভালো থাকা, এই আমাদের বেঁচে থাকা।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




