আসলেই কি গন্তব্য বলে কিছু আছে? অন্তত: আমার বাবাকে দেখে এটুকু বোঝা যায় না। পুরোটা জীবন দেখেছি তার ছুটে চলা। শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। এক শহর থেকে অন্য শহর। কখনো এই দেশ থেকে ঐদেশ।
আর আমি? নিজেকে খুঁজে বেরিয়েছি প্রতিনিয়ত। অনেক খুঁজে দেখা পেয়েছি নিজের ভেতরের যন্ত্র অংশটুকুর। যে অংশটুকু প্রতিনিয়ত হিসাব করতে থাকে। আর মানবীয় অংশটুকু আজো যেন অচেনা থেকে গেলো।
এইটুক পর্যন্ত লেখার পরে গিয়েছিলাম বন্ধুর বাসায়। বেশ জমজমাট আড্ডা। আড্ডা গুলোতে আজকাল একটা বিষয় ঘুরে ফিরে আসে। কে কখন ঢাকায় যাবে। কে কবে গিয়েছিল। এইসব হাবি জাবি। এয়ারলাইন্স গুলো নিয়ে এক একজনের এক এক রকম অভিজ্ঞতা। তবে বিমান কে নিয়ে কমবেশী সবাই হতাশ(আমি নিজেও)। আসলে লন্ডন প্রবাসীদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিক সহযাত্রীদের ব্যাপারে একটা নাকউঁচু স্বভাব দেখা যায়। হয়তো ফ্লাইটে স্মার্ট লন্ডনার রা এইসব শ্রমিকদের নানান কান্ডকলাপে মজা পায় অথবা বিরক্ত হয়। অথচ বাংলাদেশের রেমিট্যান্সে তাদের অবদান কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই।
রাত গভীর হওয়ার আগেই নিজের ডেরায় ফিরে এলাম। আমার একান্ত আপন ঘরটা যেন আমারই জন্যে প্রতিদিন অপেক্ষা করে। সেই প্রথম যেদিন এই শহরে পা রাখি সেদিন থেকেই এই ঘরটা আমার প্রবাস জীবনের অংশ হয়ে গেছে। মাঝখানে কিছুদিন এদিক ওদিক। তারপর আবার এই ঘরটাতে।
ঘরে ঢোকার কিছুক্ষনের মধ্যেই পাওয়ার কাট। পুরো এলাকা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেলো। আমরা বাংলাদেশের মানুষ লোডশেডিং এর সাথে বেশ পরিচিত হলেও এদেশের লোকজন একেবারেই অজ্ঞ। পাশের রুম থেকে ল্যান্ডলেডির মেয়ে ভয় পেয়ে বেরিয়ে এসেছে। আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘরের ভেতর বসে আছি। অনেকদিন পরে যেন বাংলাদেশে চলে এসেছি, এরকম একটা অনুভূতি। মনে পড়ছে বৃষ্টির সন্ধ্যাগুলোতে লোডশেডিং এর কথা। মনে পড়ছে অন্ধকারে ডুবে থাকা ধানমন্ডির রাস্তা গুলো। কারেন্ট আছে নাকি নেই জানতে চাওয়া টেক্সট গুলোর কথা।
আসলে এমনি নাকি হয়। কিছু কিছু ব্যাপার বয়সের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়। যেমন,স্কুল পেরোলে আর কেউ জানতে চায়না, হোমওয়ার্ক করেছি কি না, ইউনিফর্ম শুকিয়েছে কি না। কলেজ পেরোলে আর কেউ প্রশ্ন করে না, টেস্ট পেপার কোনটা কিনেছি।
একটা সময় সবাই জিজ্ঞেস করতে থাকে, ফ্রি আছি কি না। আসলে ভালো থাকার প্রবল প্রতিযোগিতার এই যুগে আমরা আসলে কেউ ফ্রি থাকতে পারি না। আমরা ব্যাস্ত থাকি, যারা ব্যাস্ত থাকতে পারি না তারা ব্যাস্ততার অভিনয় করতে থাকি। আর যারা অভিনয় করতে পারে না, তারা ফ্রি থাকে। তারা উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায় গোটা শহর জুড়ে। তারা এক একজন বোহেমিয়ান। তারা একাকী অষ্টপ্রহর হেঁটে চলে গন্তব্যহীন।
সমুদ্রপারের এই শহরটার রাস্তাগুলোতে আমিও একসময় অনেক হেঁটেছি। একা একা। রাতের পর রাত। হাঁটতে হাঁটতে এখন বেশ ক্লান্ত লাগে। ব্যাস্ত হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। সবকিছু ভুলিয়ে দেয়া প্রবল ব্যাস্ততার জন্যে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করি। কারন অলস সময় গুলোতে খুব বেশী শূন্য লাগে। মনে পড়ে যায়, অনেক বছর আগে সেই ক্লাস টু-তে একবার কেঁদেছিলাম। তারপর থেকে এই কান্নাহীন যাত্রা। ইদানিং কাঁদতে ইচ্ছা করে। শুনেছি কাঁদলে নাকি অনেক হালকা লাগে। কিন্তু আমি যেন ভুলে গেছি কিভাবে কাঁদতে হয়। গলার কাছে উঠে আসা কান্নাকে আমি অপূর্ব দক্ষতায় গিলে ফেলি। আমার আর হালকা হওয়া হয়না। অজস্র বৃষ্টিকনা নিয়ে আকাশে ভেসে বেড়ানো দিকভ্রান্ত মেঘ গুলোর মতো আমিও ঘুরে বেড়াতে থাকি পশ্চিমা শহরের আলো ঝলমল রাস্তায়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


