যখন পিচ্চি ছিলাম স্কুলে পরীক্ষায় “একটি বর্ষণমুখর রাত” শিরোনামে একটা রচনা আসতো। আপন মনের মাধুরী মিশায়া কত কিছু যে লিখছিলাম। ধুম করে দরজা জানালা বাড়ি খাইছে, মোম নিভে গেছে বাতাসে, গ্লাস ভেঙ্গে গেছে, দানব যেন ধেয়ে আসছে, আহা!!
মার্চেন্ট মেরিনার হয়ে জাহাজে যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মাথায় বুঝলাম ঝড় কি জিনিস। এখন কেউ তো আর লিখতে বলবে না। তাই নিজেই লিখতে বসলাম।
ছোট কালে দা নিউ এডভেঞ্চার সিন্দাবাদের একটা দৃশ্য মনে পড়তেছে। তুমুল ঝড়। সিন্দাবাদের কাঠের জাহাজ প্রবল ঢেউতে রোলিং করতেছে আর সিন্দাবাদ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গান গাইতেছে, “তুমি কাণ্ডারি সবচেয়ে বড় ও আমার খোদা।”
১৭ মে। আমাদের জাহাজ তখন চীনে। উত্তর চীনের একটি বন্দর কফেইডিয়ান। ওখানে কার্গো ডিসচার্জ করে পোর্টের থেকে বের হয়েছে জাহাজ। খুব সুন্দর ঝকঝকে আকাশ, টলটলে নীল পানি। কিন্তু কেন জানি চীনের পোর্ট কন্ট্রোল খারাপ আবহাওয়ার একটা মেসেজ পাঠিয়ে বসে আছে বিকেলের দিকে। কর্মব্যস্ত দিন শেষে সবাই যার যার কেবিনে রেস্টে। আমি ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম। হঠাৎ রাত বারোটায় প্রচণ্ড শব্দে আর জাহাজের একটানা দুলুনির চোটে ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার কেবিনে থাকা পানির বোতল, সফট ড্রিংকস এর ক্যান, টুকটাক জিনিসপাতি সব এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খাট থেকে উঠে দাঁড়াতেই দুলুনির ধাক্কায় সোফায় গিয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম ঘটনা সেইরকম। মাথার উপরের কেবিনে নিশ্চই আরও খারাপ অবস্থা। ধুমধাম একটার পর একটা জিনিস পড়ছে। একটু পর ই দরজায় ধাক্কা। CALL OF DUTY. চীফ অফিসার সব ডেকহ্যান্ড কে বের হতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের জাহাজের ফানেলের কাছে একটা লাইনার (ওজন প্রায় ৩ টন, পাইপের মত গোল শেপ) বাঁধা ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড ধাক্কায় তা আলগা হয়ে গেছে। যার ফলে এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি খাচ্ছে আর আশেপাশে ব্যাপক ভাংচুর করছে। এটাকে বাঁধতে হবে। টলতে টলতে বাইরে বের হলাম একের পর এক হাত ধরাধরি করে। বের হতেই মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। বাইরে তুষারপাত। সারা গায়ে ভারি জ্যাকেট থাকলেও মুখ তো খোলা। পিনের মত বিঁধছিল যেন। ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ করে কোনমতে লাইনার টাকে বাঁধা হল। দুপাশের লাইফ বোট যেকোনো সময়ে ধাক্কার চোটে পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ওখানেও এক্সট্রা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হল। ডেকের উপর দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে পানি যাচ্ছে। কার্গো না থাকায় জাহাজের ডেক পানির লেভেল থেকে অনেক উপরে কিন্তু তাও এই অবস্থা।
এদিকে ব্রিজে ক্যাপ্টেন আর ডিউটি অফিসার। জাহাজ তার কোর্স এ রাখাই দুষ্কর হয়ে গেছে। ১০/১২ মিটারের একেক ঢেউ এসে হিট করছে আর আমাদের প্রায় ২০০ মিটার আর প্রায় ৮০০০ টনের লোহার জাহাজ টা কাগজের নৌকার মত ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রকৃতির কাছে যে মানুষ কতটা অসহায় তা আসলে এমন পরিস্থিতিতে না পড়লে কেউ বুঝবে না।
পুরো ৬ ঘণ্টা এই তাণ্ডব চলল। সকাল নাগাদ কিছুটা ঠিক হল। দুলুনির চোটে আমার প্রচণ্ড মাথা ঘুরছিল। কয়েকজন বমি করল। জাহাজের অফিস রুমে দেখার মত দৃশ্য। ফাইল পত্র ছড়ায়া ছিটায়া পড়ে আছে। চেয়ার সব উলতে পালটে একটার উপর একটা। কম্পিউটারের মনিটর সিপিইউ সিকিউর করাই ছিল কিন্তু তাও কিভাবে যে খুলে পড়ে গেছে বুঝলাম না। ক্লাইনোমিটার রেকর্ড করলো যে গত কয় ঘণ্টায় আমরা সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি রোলিং ফেস করেছি। এক যা তা অবস্থা।
অনেকে জিজ্ঞাসা করে আমাকে, ঝড়ের কবলে পড়লে তোমাদের ভয় লাগে না?? তখন ই খালি ভাবি। আসলেই তো। ভয় করেনাই কেন তখন? আসলে প্রতি মুহূর্তে যদি ভয় নিয়ে থাকি তাইলে হয়ত সারভাইভ করতে পারবো না। তাই প্রকৃতি তখন ভয় সরিয়ে যুদ্ধ করতে বলে। সব জাহাজিরা যদি এই ভয় নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিত তবে পৃথিবীর অর্থনীতি অনেক এলোমেলো হয়ে যেত ।
ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া। ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ৮:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




