মৃত্যু
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
মৃত্যু (দ্বিতীয় পর্ব)
মুআম্মার আল-গাদ্দাফী
আমি তো তোমাদের আগেই বলেছি : মৃত্যুও কখনো কখনো পরাজিত হয়, আহত হয়ে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। তবে সে কখনই পরাজয়ের গ্লানি বোধ করে না, হতাশ হয় না। কারণ তার আত্মবিশ্বাস হতাশা থেকে অনেক শক্তিশালী এবং চূড়ান্ত বিজয়ে তার আস্থা সামায়িক পরাজয় থেকে অনেক অনঢ়। তার কারণ মৃত্যু লড়াই করে তার নিজের শক্তিতে, আমেরিকার সাহায্যে নয়।
তিন বছর যেতে না যেতেই মৃত্যু আবার হামলা করল। এবারের রণক্ষেত্র 'কিয়াফা' এবং তা কারযাবিয়ার যুদ্ধ থেকেও ভয়ংকর রূপ নিল। এবার মৃতু্য এল ইটালিয়ানদের মিত্র সানুছী সেনাবাহিনী নিয়ে। মৃতু্যর আশা ছিল এবার সে বাবাকে ফেলে দিতে পারবে। এবারে মৃতু্য ছিল অনেক বেশী বদ্ধপরিকর, লোক ও অস্ত্রশস্ত্রে ভরপুর এবং জয়ের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু বাবা তুলনামূলক অনেক দুর্বল হলেও মৃতু্যর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তাকে তেমন পাত্তাই দিলেন না। মৃত্যুর অট্টহাসিতে চরাচর কেঁপে ওঠল, যখন সে দেখতে পেল মাঠ-ঘাট ছাপিয়ে, মরুর সোনালি বালি কালো করে দিয়ে তার মিত্র সানুছীর কালো উর্দি পরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যরা পঙ্গপালের মত এগিয়ে যাচ্ছে আর অপর দিকে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন গুটি কয়েক নিরস্ত্র 'ভদ্র লোক' নিয়ে। সে দিনটা আসলেই খুব কঠিন ছিল। মৃতু্য হাজির হল তার সম্পন্ন লোকবল অস্ত্র বল সহ। বাবা মাঠে নামলেন তার সাহস ও বীরত্ব সম্বল করে.. মৃতু্যর সাথে তার মিত্র সানুছীর বিশাল বাহিনী.. বার সাথে গুটি কয়েক অনভিজ্ঞ যোদ্ধা। বাবা যখন বুঝতে পারলেন আজকের লড়াই হবে অসম লড়াই এবং আজ জয়ের আশা নিছক দুরাশা মাত্র তখন তিনি যাবতীয় রক্ষণাত্মকতা বাদ দিয়ে আক্রমণাত্মকভাবে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। মৃতু্যকে পাত্তাই দিলেন না, কোনো পরিখা খুড়লেন না.. ঘোষণা দিলেন তারা আজ সরাসরি মুখোমুখি লড়াই করবেন... সে দিন হতাশা ও সাহস মিলে গিয়ে যে রূপ তৈরি হল সেটা খুব সুন্দর ও ভয়ংকর। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে দেখা গেল, কারবাযিয়ার দিনের মতই, মৃতু্যর গুলিগুলো সব লাগছে বাবার সহযোদ্ধদের গায়ে। তার গায়ে একটা গুলিও লাগছে না। তারপর যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, বুকে গুলি লাগা আহত যোদ্ধার মত লাল সূর্যটা যখন দিগন্তের ওপারে ডুবে যেতে লাগল তখন ক্ষোভে, সারা দিন চেষ্টা করার পরও বাবাকে ফেলতে না পারার রাগে মৃতু্য প্রায় উন্মাদ হয়ে গেল। শেষ চেষ্টা হিসেবে মৃতু্য বাবাকে লক্ষ করে রাশিয়ার সম্রাটের কাছ থেকে পাওয়া 'মোছকোভ' তাক করল, তাক করল ঠিক তার কলজে লক্ষ করে। কিন্তু তার গুলিটা কাঙ্খিত লক্ষ ভেদ করতে পারল না। গুলিটা বাবার বাম কাধে একটা বিপদজনক গর্ত করে দিয়ে অপর পাশ দিয়ে বেড়িয়ে গেল।
আমি আগেই বলেছি, মৃত্যুর প্রতিটি গুলিই অব্যর্থ এবং লক্ষভেদী হয় এই ধারণাটা ঠিক না। সে কখনো ব্যর্থ এবং কখনো লক্ষভেদী হয়। এইবারও মৃতু্যর গুলি বাবাকে কবরে শোয়াতে পারল না। তবে তা আজীবনের জন্য তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। বাবা চিরদিনের মত আংশিক পেরালাইসিসে আক্রান্ত হলেন।
আমি বলেছি, মৃতু্য সবসময় সাহসী যোদ্ধার মত আচরণ করে না, সবসময় বুক চেতিয়ে মুখামুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করে না। মাঝে মাঝে সে বরং খুব ভীরু হয়ে যায় এবং ধূর্ত কাপুরুষের মত পিছন থেকে আঘাত করে। 'মালাহ' 'কারজাবিয়া'র দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মৃতু্য কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এত আয়োজনের পরও বাবাকে হত্যা না করতে পেরে সে কিছুটা হতাশই হল। তবে অভিশপ্ত মৃত্যু কখনোই চূড়ান্ত হতাশ হয় না। সে নিশ্চিত জানে সে যতই পরাজিত হক এবং তার প্রতিপক্ষ যতই জয়ী হোক সেটা সাময়িক, চূড়ান্ত বিজয় মালা তার গলাতেই ওঠবে। তাই মৃতু্য বাবার ব্যাপারে আশা ছাড়ল না। তবে কাপুরুষ মৃতু্য এই বার যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে অন্য রাস্তা ধরল : এবার সে হাজির হল বিষাক্ত মরু সাপের বেশে। এক অন্ধকার রাতে মরু ঝোপের ভেতর থেকে ওঠে এসে মৃতু্য ছোবল মারল বাবার পায়ে।
মহা মহা বীরেরা মৃতু্যর উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে যখন যুদ্ধের ময়দানে নামেন তখন মৃতু্য আসে সাদা ঘোড়ায় চড়ে, নাঙ্গা তরবারি উঁচিয়ে। তবে মৃতু্য যখন কারো ব্যাপারে কিছুটা হতাশ এবং প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যায় তখন ও' আসে কালো ঘোড়ায় চড়ে। সরাসরি যুদ্ধে ব্যর্থ হওয়ার পর বাবার কাছে মৃতু্য এল কালো ঘোড়ায় চড়ে, আত্মগোপন করে, চুপিচুপি। সরাসরি মুখামুখি না হয়ে আঘাত করল পিছন থেকে। যে মৃতু্যর ভয়ে দুনিয়া জুড়ে মানুষ প্রকম্পিত, সে মৃতু্য আমার বাবাকে খুন করতে এল কালো বিষাক্ত মরু সাপ হয়ে। বাবা তার কঠিন পেশল পায়ে সাঁপটাকে প্রায় থেতলে দিয়ে ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে বাবার পায়ে বিষ ঢেলে দিল। এবার মৃতু্য প্রায় নিশ্চিত ছিল। এই নির্জন মরুতে এই বিষ বাবাকে নিশ্চিত ফেলে দিবে। কিন্তু মৃতু্য জানে না বেঁচে থাকার ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা তার যাবতীয় চক্রান্ত বিনাশ করে দিতে পারে, মিথ্যে করে দিতে পারে তার সব আশা-ধারণা। তার জানা ছিল না এক কাপ সাধারণ লাল চা এই মরু সাপের বিষক্রিয়া নষ্ট করে দিতে পারে অতি সহজে। এক কাপ লাল চা পান করে এবং কয়েকবার বমি করার পর বাবা মৃতু্যকে গালি দিতে দিতে আবার ওঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু আমরা তো আগেই জেনেছি মৃত্যু যতই আহত হোক কখনই মরে না, যতবারই হেরে যাক কখনো হতাশ হয় না। বাবা তার কঠিন, চির অনঢ় পায়ে সাঁপটাকে থেতলে দিলে শেষ মুহূর্তে মৃত্যু তার দেহ ছেড়ে বের হয়ে গেল এবং আরেকটা বিষাক্ত সাঁপের গায়ে আশ্রয় নিয়ে বাবার বাড়ি ফেরার পথে উঁত পেতে রইল। ফেরার পথে এক যাত্রা বিরতি কালে আগুন জ্বালানোর জন্য বাবা একটা গাছের ডাল ভাঙ্গার জন্য যেই হাত বাড়ালেন সাথে সাথে উঁত পেতে থাকা মৃতু্য ছোবল মারল তার ডান হাতে। বাবার বিরুদ্ধে মৃতু্যর লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। সে ভাল করেই জানে তার এই প্রতিপক্ষ সহজে ঘায়েল হবার নয়। সে তো জানে এর আগেরবার নির্জন মরুতে একা, তার সহযোদ্ধাদের থেকে অনেক দূরে থাকার পরও বাবা বেঁচে গেছেন। এবার তো তার লোকজন আছে তার সাথে। তার মুকাবেলার জন্য সবাই প্রস্তুত। তাই মৃতু্য এক ছোবল দিয়েই থেমে গেল না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে পরপর কয়েকটা ছোবল মারল। কিন্তু হায়রে বোকা !! বোকা মৃতু্য বুঝতে পারল না তার পরের ছোবলগুলোই তার বিষের বিষনাশক হয়ে বাবার গায়ে ছড়িয়ে পড়ল এবং এই বার কাফেলায় লাল চা' না থাকলেও, খোদ মৃতু্যর দাওয়াইতেই বাবা আবার তার হাত থেকে ফসকে গেলেন। সাঁপের বিষে বাবা খুব দুর্বল হয়ে পড়ে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দফাতেও বাবা বেঁচে গেলেন।
এই পর্যন্ত আমরা এই ড্রামা কাহিনীর যতটুকো জানলাম তাতে দেখছি : তার প্রথম পর্বগুলোতে মৃতু্য ছিল পুরুষ। কিন্তু শেষে সে হাজির হয় নারী হয়ে এবং তখন আমরা কিছুটা ধন্ধে পড়ে যাই। কারণ আমরা দেখছি নারী মৃতু্য হাজির হয়েছে একটা বিষাক্ত নারী সাঁপ হয়ে। এখন .. ! এখন কি তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে নাকি লড়াই করতে হবে ?.. বিষাক্ত সাঁপের কাছে কি ্তযদিও নারী হয়্ত আত্মসমর্পণ করা যায় ? সাঁপকে তো আমরা শত্রু বলেই জানি, তাই না ?.. আমার বাবাও তাই করলেন, নারী সাঁপের কাছে আত্মসমর্পণ না করে তার সাথে লড়ে গেলেন। সে যাই হোক। আমরা আমাদের বিষয়ে ফিরে যাই : এই গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা আসলে মৃতু্যর সেক্স নির্ধারণ করতে চাইছি, দেখতে চাইছি মৃতু্য পুরুষ না নারী এবং আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মৃতু্য যদি পুরুষ হয় তাহলে তার সাথে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে হবে আর যদি ও' নারী হয় তাহলে আখেরী পলক পর্যন্ত তার কাছে আত্মসমর্পণ করে যেতে হবে।
এ নাগাদ আমরা গল্পটার যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছি তাতে দেখা যাচ্ছে বাবা এখনো লড়ে যাচ্ছেন, আত্মসমর্পণ করেন নি, যা থেকে বুঝা যায় মৃতু্য পুরুষ। কিন্তু শেষে গিয়ে আমি নিশ্চিত হলাম মৃতু্য পুরুষ নয় নারী্ত নারীর আদিম ও শাশ্বত যাবতীয় রমণীয়তা নিয়েই নারী এবং আমার বাবা প্রকৃত পুরুষের মতই বিনাদ্বিধায় সেই নারীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। ১৯৮৫ সালের ৮ ই মে বাবা তার কোলে শির সমর্পণ করেই আখেরী পলক ফেলে ছিলেন। বাবা একটু নড়লেনও না, কোনো প্রতিবাদ করলেন না। তার আজীবনের স্বভাব অনুসারে হুংকার দিয়ে তরবারী হাতে লাফিয়ে ওঠলেন না। বরং তিনি তার হাতে বিনাদ্বিধায়, বিনা প্রতিবাদে আত্মসমর্পণ করলেন। বরং আমরা অবাক হয়ে দেখলাম বাবা মৃতু্যর পক্ষ নিয়ে অন্যদের বিরুদ্ধে, যারা মৃতু্যর বিরুদ্ধে লড়তে চাইছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম মৃতু্য নারী, বেশ রমণীয় কিছিমের নারী, যার কাছে আমার বীর পুরুষ বাবা বিনাপ্রতিবাদে আত্মসমর্পণ করছেন। এভাবে বাবা তার চির শত্রু মৃতু্যর রমণী রূপের কাছে আত্মসমর্পণ করে ইতিহাসে আরেকবার প্রমাণ গেলেন নারীর রমণীয়তার সামনে পৃথিবীর কোনো বীরত্বই টিকতে পারে না।
এগিয়ে আসছে মৃতু্যর শোভাযাত্রা, ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠছে তার ঢোলের শব্দ.. হৈচৈ ..। ওই ভয়ংকর ঢল-বাদ্যের শব্দ যতই স্পষ্ট হল বাবা তার সাথে সাথে বিছানায় এলিয়ে পড়তে লাগলেন। তাকে খুব শান্ত ও প্রশান্ত দেখাচ্ছিল। আমাদের দিকে তাকিয়ে তিনি শিশুর মত অর্থহীনভাবে হাসতে লাগলেন। এই দৃশ্য দেখে অদ্ভুতভাবে আমার মনে হল, মৃতু্যর শোভা যাত্রার ঢোল-বাদ্য্ত যা শোনে অসুস্থ মানুষগুলো ভয়ে কেঁপে ওঠ্তে আসলে ভয়ংকর কিছু না। তা বরং উম্মে কুলছুমের গান বা জনপ্রিয় কোনো মিশরী গানের মত সুন্দর, শ্রুতিসুখকর এবং তা বাজিয়েই অসুস্থদের অবশ বা সংজ্ঞাহীন করে ফেলা সম্ভব। অসুস্থদের সংজ্ঞাহীন করার জন্য রাসায়নিক কোনো মেডিসিনের দরকার নেই, জনপ্রিয় কোনো মিশরীয় গানই যথেষ্ট। আমার এই অদ্ভুত প্রস্তাব শোনে ডাক্তার সাহেব হতবাক হয়ে গেলেন, তার এলাকায় নাক গলাচ্ছি বলে বিরক্ত হলেন। আমাকে ব্যখ্যা করে বুঝালেন, কি কারণে এখন বাবাকে সংজ্ঞাহীন করানো উচিৎ, খুবই জরুরী এবং সেটা কোনো গান-ফান দিয়ে হবে না। তাকে দ্রুত ইনজেকশান দিয়ে সংজ্ঞাহীন করতে হবে। তার সেই শাস্ত্রীয় বয়ানের সামনে আমি নেহাত বোকা বনে গেলাম। তাকে শান্ত করার জন্য লজ্জিত হয়ে বললাম : এই বিষয়ে আমি আসলেই গণ্ডমুর্খের পর্যায়ে। আমি আসলে সুস্থ ও অসুস্থের মাঝে গুলিয়ে ফেলেছি এবং মিশরীয় গানের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ধারণা পোষণ করে ফেলেছি। আমি ভেবে ছিলাম মিশরীয় গান অসুস্থদের উপরও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এখন বুঝতে পারছি সেটা ঠিক না। মিশরীয় গান প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, অবশ সংজ্ঞাহীন করে দেয় সুস্থ আরব জনগনকে, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ ১৯৪৮ সাল, যখন তার প্রতিক্রিয়ায় প্রায় এক মিলিয়নের বেশি আরব সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে ছিল। কিন্তু অসুস্থদের সংজ্ঞাহীন করার জন্য এই গান তেমন কার্যকরী কিছু নয়, এটা প্রমাণিত সত্য। ডাক্তাররা বরং শারীরিকভাবে অসুস্থ লোকদের গান না শোনানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন, কারণ তাতে বমি হওয়ার মত বিরূপ কিছু প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কিন্তু শারীরিকভাবে সুস্থ যারা, বা মানসিক অসুস্থদের ব্যাপারে ডাক্তাররা গান শোনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তাতে তারা সাময়ীক প্রশান্তি লাভ করতে পারেন, অরাসয়নিক উপায়ে কিছুক্ষণের জন্য অবশ বোধ করতে পারেন... যাইহোক আমি যখন ডাক্তারকে বললাম : তবে গান কিন্তু সুস্থ অসুস্থ সবার মন ও মানসিকতায় প্রভাব ফেলে, তখন তিনি আরো ক্ষেপে গেলেন। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন : দেখেন মশাই আমি সার্জান ডাক্তার, মন ... আত্মা .. মানসিকতা.. মেজাজ.. এইগুলো আমার কাছে এক রাশ অর্থহীন শব্দ।
বাবা ক্রমশ হেলে পড়ছেন, ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাচ্ছেন। আমরা তার চারদিকে দাঁড়িয়ে কাঁদছি আর তিনি আবেশিত মুখে হাসতে হাসতে হারিয়ে যাচ্ছেন মৃতু্যর রাজ্যে... হায়রে এই কি সেই মৃতু্য, বাবার আজীবনের শত্রু, যার চ্যালঞ্জে সাড়া দিয়ে বাবা 'কারজাবিয়া' 'তালা' 'মালাহ' বিভিন্ন রণাঙ্গনে চরম বীরত্বের সাথে লড়েছেন ? এই কি সেই বিষাক্ত সাপ যা নির্জন মরুতে বাবাকে দংশন করে ছিল ? যদি এই সেই মৃতু্য হয়ে থাকে তাহলে সে খুব চালাক, ধূর্ত এবং সফল প্রতারক। আমার যে বীর যোদ্ধা বাবা রণাঙ্গনে রণাঙ্গনে তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাকে আহত পরাজিত করেছেন সে তিনিই আজ তার প্রতারণার জালে পা দিয়ে বিনাপ্রতিবাদে তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন.. তার মানে মৃতু্য পুরুষ নয়, নারী এবং আখেরী পলক পর্যন্ত তার কাছে আত্মসমর্পণ করে যেতে হবে। আমার বাবা তাই করলেন।
সুতরাং, মৃতু্য চির বিজয়ী কোনো যোদ্ধা নয়। মৃতু্য বরং অধিকাংশ সময়ই পরাজিত হয়। মৃতু্য যখন হাজির হয় ঘোড়ার পিঠে চড়ে, অস্ত্র উঁচিয়ে, মুখামুখি মল্ল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তখন মৃতু্য অধিকাংশ সময় হেরে যায়। কারণ মৃতু্যর এই রূপটা তার প্রতিপক্ষের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, তাকে প্রাণপন লড়াই করতে বাধ্য করে... কারণ এই ক্ষেত্রে মৃতু্য হাজির হয় বীর পুরুষের মত, যার সাথে লড়াই করা ছাড়া কোনো উপায় নাই, আর যোদ্ধারা ভাল করেই জানেন প্রাণপন লড়াইয়ের একমাত্র পরিণতির নাম বিজয়। কিন্তু মৃতু্য যখন তার রণকৌশল বদলে, বীর যোদ্ধার পরিবর্তে রমণীয় নারীর বেশে হাজির হয়, তখন সে সবচেয়ে বিপদজনক হয়ে ওঠে, তার কাঙ্খিত বিজয়ে পৌঁছে যায় অতি সহজে। কারণ বীর পুরুষরা কখনই নারীর উপর অস্ত্র তুলেন না। নারীর বিরুদ্ধে লড়া যায় না, নারীর কাছে আত্মসমর্পণ করে যেতে হয় আখেরী পলক পর্যন্ত... আর আত্মসমর্পণের ফলাফল কখনই বিজয় হতে পারে না।
এভাবে মৃত্যু, লড়াই যত দীর্ঘই হোক, শেষ পর্যন্ত তার কাঙ্খিত লক্ষে পেৌছে যায় এবং কখনই তার প্রতিপক্ষের প্রতি দয়া করে না, সে যতই কাকুতি মিনতিই করুক, যত আত্মসমর্পণই করুক।
সুতরাং যদি দীর্ঘ জীবন চাও তাহলে মৃতু্যর মুকাবেলা করে যাও, আমার মহান বাবার মত, যিনি কখনই মৃতু্যর কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি, চরম সাহসিকতার সাথে তার সাথে লড়ে এক শ' বছর বেঁচে ছিলেন, যদিও মৃতু্য ত্রিশ বছর বয়সেই তাকে ফেলে দিতে চেয়ে ছিল। দীর্ঘ জীবন লাভ এবং মৃতু্য থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় তার মুকাবেল করা, অবিরাম তার সাথে লড়ে যাওয়া। পালানো ?... মৃতু্যর হাত থেকে পালানোর চেষ্টা সবসময় ব্যর্থতায় অবসিত হতে বাধ্য। মৃতু্য কাছ থেকে পালানো সম্ভব নয়। কিন্তু মৃতু্য যদি অবলা অস্ত্রহীন নারীর বেশে আমাদের কাছে এসে হাজির হয়, কোমল রমণীয়তা ছড়িয়ে আমাদের ঘরে ঢুকে, ভালবাসা-সোহাগে আমাদের মাতিয়ে দেয়, কাতুকুতু দিয়ে হাসায় ...তাহলে তার সাথে লড়াই করাটা কখনোই প্রকৃত পৌরষত্বের পরিচয় হতে পারে না। তখন বরং কর্তব্য হচ্ছে প্রকৃত পুরুষে মত, আখেরী পলক পর্যন্ত তার কোলে আত্মসমর্পণ করে যাওয়া...
মরণ কালে রমণী মৃত্যুর কোলে আত্মসমর্পণ করে বাবা প্রমাণ করে গেলেন বীর যোদ্ধার সাথে সাথে তিনি প্রকৃত পুরুষও ছিলেন..
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?
যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!
যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন
ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।
কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।
ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।