ফিলিস্তীনী এবং ইহুদী সমন্বিত অভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা (ইসরাতীন)
এর শর্তসমূহ :
১. দেশান্তরিত এবং শরনার্থী উদ্বাস্তু ফিলিস্তীনীরা যেখানেই আছে এবং তারা যেখানেই থাকতে চায় সেখানে ফিরিয়ে আনা। কারণ এটা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না যে, যে ইহুদীরা কিংবা তাদের পূর্বপুরুষরা কখনোই ফিলিস্তীনের অধিবাসী ছিল না তাদেরকে বাহির থেকে এনে ফিলিস্তীনে স্থিত করা হবে এবং ফিলিস্তীনের মূল অধিবাসীদের, যারা নিকট অতীত ১৯৪৮ সালে দেশান্তরিত উদ্বাস্তু হয়েছে এবং বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে জীবন যাপন করছে, তাদের ফিলিস্তীনে ঢুকতে দেওয়া হবে না। বিশেষত যখন ইহুদীরা নিজেরাই দাবি করছে এবং প্রমাণ করতে চাইছে যে তারা ফিলিস্তীনীদের তাড়ায় নি। বরং ফিলিস্তীনীরাই বিভিন্ন মিথ্যে প্রপাগান্ডা বিশ্বাস করে নিজেরাই বাস্তুভিটা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। উদাহরণত: অন্যতম উগ্র জায়োনিস্ট তাত্তি্বক, হায়রোত মুভমেন্ট এবং জাতীয় ইহুদী সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান নেতা এবং প্রথম কানিস্ত এর সদস্য স্যামুঈল কাত্স ব্যাপারটা স্বীকার করেছেন। এই ক্ষেত্রে তিনি জেনারেল কালুব পাশাকে উদ্ধৃত করেছেন, যিনি বলেন : "মূলত ফিলিস্তীনীরা আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং যুদ্ধের সময় কোনো ধরনের হুমকি ছড়াই তারা তাদের বসত-ভিটা ছেড়ে পালিয়ে যায়।"
এই লেখক লিখেছেন : এইভাবেই এই মিথ্যে প্রপাগান্ডা গড়ে ওঠে যে, ইহুদীরা বল প্রয়োগ করে আরবদের তাদের বসতি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন : ১৯৪৮ এর যুদ্ধের ইহুদী বিদ্বেষী রিপোর্টারও নিজেদের বাস্তুভিটা ছেড়ে আরবদের পালিয়ে যাওয়ার কথা লিখেছেন কিন্তু তারা কেউই এটা বলেন নি এই পালায়ন ছিল জোড়পূর্বক। এমনকি তারা এর নু্যনতম ঈঙ্গিতও দেন নি। স্যামুঈল মনে করেন ফিলিস্তীনীদের এই পালায়ন একটি অদ্ভুত ফেনোমেনা। তবে তিনি স্বীকার করেছেন ঘটনাটা ঘটেছে ব্যাপকহারে। তিনি বলেন : 'গণহারে দলে দলে ফিলিস্তীনীরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, অথচ তারা তাদের বসত-ভিটা এবং তে-খামার নিয়ে নিজদের ভূমিতেই থেকে যেত এটাই ছিল স্বাভাবিক। তিনি বলেন : পুরুষরাও বিনা বাধায় তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে, নিজেদের ভিটে রার জন্য তারা নু্যনতম কোনো প্রতিরোধও গড়ে তুলে নি। ফিলিস্তীনীদের এই সংঘবদ্ধ গণপালায়নের একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দাড় করাতে হবে।' এই ক্ষেত্রে তিনি ওমানে নিয়োজিত টাইমসের রিপোর্টাটের কথাও উদ্ধৃত করেছেন : 'সিরিয়া, লেবানন এবং পূর্ব জর্ডান এবং ইরাক ইসরাইল থেকে আগত শরানার্থীতে ভরে যায়। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তারা সবাই কোনো ধরনের লড়াই না করে, প্রতিরোধ গড়ে না তুলে ইসরাইল থেকে পালিয়ে এসেছে।'
স্যামুঈল, জাতিসংঘের রাজনৈতিক কমিটির সামনে ১৭ নভেম্বর ১৯৬০ সালে পেশকৃত সুপরিম এরাব অথারিটির সেক্রেটারী ঈমিল আল-গোরীর বক্তব্যও উদ্ধৃত করেছেন। আল-গোরী বলেন : জায়োনিস্ট গনহত্যা এবং জঙ্গী তৎপরতার ফলেই আরবরা দলে দলে ফিলিস্তীন ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। অথচ এই সব মিথ্যে প্রপাগান্ডাগুলোকে অঙ্কুরেই নিশ্চিহ করে দেওয়া খুবই সম্ভব ছিল।"
এই সব উদ্ধৃতিগুলো আমরা এখানে উল্লেখ করছি দুটি বিষয় প্রমাণ করতে : এক : এটা প্রমাণ করা যে, ফিলিস্তীনীদের দেশ ছেড়ে গণপালায়নের ব্যাপারটা কোনো রটনা নয়, তা বাস্তবেই ঘটেছে। দুই : এবং এই পালায়নের কারণ গণহত্যা সম্পর্কে, বিশেষত বিখ্যাত দির ইয়াসীন গ্রামের গণহত্যার, মিথ্যে প্রপাগান্ডা।
বমান শুভ্রগ্রন্থে এই উদ্ধৃতি ও সাক্ষ্যগুলো আমরা উদ্ধৃত করছি এই সংকটের একটি যুক্তিসজ্ঞক চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছার জন্য।
কারণ এই সব উদ্ধৃতিগুলোতে জায়োনিস্ট নেতা, বুদ্ধিজীবী এবং নিরপে ও গোড়া পর্যবেক নির্বিশেষে সবাই নিজেদের মুখেই যা স্বীকার করলেন তা থেকে প্রমাণিত হয় :
প্রথমত: ১৯৪৮-১৯৬৭ পর্যন্ত এই অঞ্চলে ফিলিস্তীনীরা বসবাস করেছে এবং সেখানে ছিল তাদের বসতবাড়ি তে-খামার।
দ্বিতীয়ত : ১৯৪৮ সালে তারা গণহত্যার ভয়ে (সেটা বাস্তব কি মিথ্যে প্রপাগান্ডা সেটা অন্য বিচার) নিজেদের বসতভিটা এবং তে-খামার ছেড়ে এখান থেকে পালিয়ে যায়।
তৃতীয়ত : প্রধান প্রধান জায়োনিস্ট মুভমেন্টের নেতা-বুদ্ধিজীবীরা, এমনকি যারা ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এমন সামরিক অধিনায়করাও স্বীকার করছেন যে, ইহুদীরা ফিলিস্তীনীদের ফিলিস্তীন কিংবা তাদের বাস্তুভিটা বা তেখামার থেকে তাড়িয়ে দেয় নি। খোদ ফিলিস্তীনীরাই বরং অতংকজনক বিভিন্ন মিথ্যে প্রপাগান্ডায় প্রতারিত হয়ে নিজেরাই ফিলিস্তীন ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
চুতুর্থত : এই দেশান্তর ঘটেছে গণহারে এবং বড় সংখ্যায়।
এই ব্যাপারটা খুবই ইতিবাচক। তা আমাদের এই সংকট নিরসনে অনেক দূর পর্যন্ত সহযোগিতা করতে পারে।
তার মানে ইহুদীরা ফিলিস্তীনীদের অপছন্দ করে না, তারা তাদের ফিলিস্তীনভূমি থেকে বিতাড়িত করতেও চায় না এবং মিডিয়া প্রচারণায় যা শোনা যায় ফিলিস্তীনীদের উপর তারা তেমন কোনো গণহত্যা চালায় নি এমনকি দির ইয়াসীনের ঘটনাও বাস্তব নয়, বরং প্রচার মাধ্যমের তৈরি মিথ্যে গল্প। সেই সময় বরং অফিলিস্তীনী আরবরা এসে ফিলিস্তীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে ছিল।
এই সব বিশ্বাস করে নিয়ে আমরা এই সংকট মুকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তাবিত প্রথম এবং মৌলিক পয়েন্টাতে ফিরে যেতে পারি অর্থাৎ ৪৮-৬৭ সালে দেশান্তরিত ফিলিস্তীনীদের ফিরিয়ে আনা এবং ফিলিস্তীনের ভূমিতে পুনর্বাসনের বিষয়টাতে। কারণ ইহুদীরা নিজেরাই স্বীকার করছে যে, তারা তাদের তাড়ায় নি, তারা বরং নিজেরাই উল্লেখিত কারণে নিজেদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, যারা এই এলাকা জবরদখল করে রেখেছে সেই ইহুদীদেরও, ফিলিস্তীনীরা সেখানে নিজেদের বসত-খামার নিয়ে থাকুক, সেই ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। এভাবে উদ্বাস্তু ফিলিস্তীনীদের পুনর্বাসনের ব্যাপারটার একটা সমাধান হতে পারে এবং এটাই হচ্ছে এই সংকট নিরসনের প্রধান চাবি। এর মাধ্যমে পথচু্যত জলকে আপন ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া যাবে। এবং এর মাধ্যমেই ১৯৪৮ ঘোষিত জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত, যার ১১ অনুচ্ছেদের ফিলিস্তীনী শরনার্থীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টা স্পষ্টত উল্লেখিত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা যাবে। এরপর এই বিষয়ে কোনোভাবেই কারো কোনো ন্যায়সঙ্গত আপত্তি থাকতে পারে না।
এই সংকট নিরসনে আমরা ইতিহাস থেকে শিা নিতে পারি। পবিত্র গ্রন্থের ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ফিলিস্তীনের ইতিহাস থেকে জানা যায় _যেমন আমরা আগেও উল্লেখ করেছি_ যে, এই অঞ্চলে অনেক জাতি সমপ্রদায় বাস করেছে এবং তার নির্দিষ্ট কোনো অংশে নয়, সংঘর্ষ-সংঘাত ছড়িয়ে ছিল তার গোটা এলাকাতেই এবং ফিলিস্তীনীরাই হচ্ছে এর আদি অধিবাসী এবং এই অধিবাসীদের নামেই এই এলাকার ফিলিস্তীন নামকরণ করা হয়েছে।
তা ছাড়া আমরা আগেই দেখিয়েছি বড় বড় জায়োনিস্ট নেতারাও স্বীকার করছেন যে, ১৯৪৮ পর্যন্ত তারা এই অঞ্চলকে ফিলিস্তীন নামেই ডাকত এবং প্রতিটি জায়োনিস্ট মুভমেন্ট, ব্যাংক কিংবা ইহুদী সংগঠনের ফিলিস্তীন নামে নামকরণ করা হয়েছিল এবং সেটা, তাদের স্বীকারোক্তি অনুসারেই, ১৯৪৮ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
সুতরাং এই অঞ্চলের ইতিহাস বিশ্লেষ করলে যেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেটা হচ্ছে ইসরাইলী ফিলীস্তীনী কারো পক্ষেই গোটা ফিলিস্তীনে কিংবা তার নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলে একক মালিকানা কিংবা অধিকার দাবি করা সম্ভব নয়।
দেশ বিভাগ এবং প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনিবার্য ব্যার্থতা :
১. প্রথমত : এ দুটি রাষ্ট্র মূলত কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, ভূগোল এবং নাগরিকদের বিচারে তাকে বরং বলায় যায় আন্তপ্রবিষ্ট রাষ্ট্র।
২. ওয়েষ্ট ব্যাংকে কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ইসরাইলের গভীরতা হবে মাত্র ১৪ কিলোমিটার। তাদের রাষ্ট্রের গভীরতা হবে মাত্র ১৪ কিলোমিটার ইসরাইলীদের পক্ষে কোনোভাবে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
৩. এই ক্ষেত্রে ইসরাইলের সমুদ্রতীরবর্তী শহরগুলো ওয়েস্ট ব্যাংকের সীমান্তের যে কোনো পয়েন্ট থেকে ভূস্থাপিত মাঝারি যে কোনো অস্ত্রের রেঞ্জের মুখে থাকবে।
৪. বক্ষ্যমান গ্রন্থে 'দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভুল এবং বিপদ' শিরোনামে আমরা যে সব বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি সেগুলো বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।
৫. ইতিহাসের বাফার জোনগুলো সবসময় বিভিন্ন যুদ্ধ সংঘর্ষের কারণ হয়েছে। এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। ফিলিস্তীন এবং ইসরাইলের মাঝের যে কোনো বাফারজোন উভয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে। মধ্যবর্তী সেই অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উভয় পক্ষ অব্যাহত সংঘর্ষে জাড়িয়ে থাকবে।
৬. ফিলিস্তীনীরা কোনোভাবেই নিরস্ত্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না। তারা অবশ্যই আত্মরা করতে সম স্বশস্ত্র রাষ্ট্র চাইবে। তাদেরও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে তাল রেখে স্বশস্ত্র হওয়ার অধিকার আছে। এটা তাদের ন্যায্য এবং প্রাকৃতিক অধিকার। সে ক্ষেত্রে কারো কোনো আপত্তি অন্যায্য এবং অগ্রহণযোগ্য।
৭. মূলত নদী এবং সমুদ্রের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি দুটি রাষ্ট্রের জন্য কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।
৮. পৃথিবীর নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা শরনার্থীদের বাদ দিলেও শুধু সিরিয়া ও লেবাননে যে ফিলিস্তীনী শরনার্থী আছে, গাজা এবং ওয়েষ্ট ব্যাংকের ভূমি তাদের পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
৯. এই ত্রে দেশান্তরিতদের সংকট অন্যতম প্রধান সংকট। যে সব দেশান্তরিতদের মূল ভূমি গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংক নয় সেই সব ফিলিস্তীনীরা কোথায় যাবে ?
১০. তথাকথিত ইসরাইলে নতুন কোনো ইহুদী হিজরত সম্ভব নয়।
১১. একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসরত দুটি সমপ্রদায়ের মাঝে যেমন ঘটে থাকে ইসরাইলী এবং ফিলিস্তীনীদের মাঝে এখন তেমন সংমিশ্রন ঘটছে। এই বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। এটাই হতে পারে এক অভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান ভিত্তি।
বর্তমানে তথাকথিত ইসরাইলে, ইসরাইলী আত্মপরিচয় নিয়ে বাস করছে প্রায় এক মিলিয়ন ফিলীস্তীনী। তারা ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করছে, তাদের আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ, সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই আরো বাড়বে। অপরদিকে গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে আছে তথাকথিত ইহুদী বসতিগুলো। এই বসতিগুলোয় বাস করছে ল ল ইহুদী। স্বাভাবিকভাবেই এদের সংখ্যাও বাড়বে সময়ের সাথে সাথে।
১৯৪৮ পর থেকে যাকে ইসরাইল রাষ্ট্র বলা হচ্ছে তা এককভাবে ইহুদীদের রাষ্ট্র নয়। তার নাগরিকদের অনেকেই খৃষ্টান, ক্যাথলিক ইহুদী, মুসলমান, দোরোজ মুসলমান, আরব ইসরাইলী... ইত্যাদি।
১২. জীবনের অনেক ক্ষেত্রে উভয় প একে ওপরের উপর নির্ভরশীল। যেমন অধিকাংশ ইসরাইলী মিল-ফ্যক্টরি ফিলিস্তীনীদের উপর নির্ভর করে চলছে। উভয় পরে মাঝে পণ্য এবং শ্রমশক্তির বিনিময় হচ্ছে।
১৪. বিখ্যাত জায়োনিষ্ট বুদ্ধিজীবী মিঈর বাঈল (যার কথা আমরা আগেও কয়েকবার উল্লেখ করেছি) বলেন : ইহুদী ফিলিস্তীনীদের আন্তমিশ্রণ বাড়ছে প্রতি বছরই। একদিক থেকে এই সংমিশ্রণ ঘটছে গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে গড়ে ওঠা ইহুদী বসতিগুলোর মাধ্যমে অপর দিকে আরো বৃহৎ আকাড়ে এই মিশ্রণ ঘটছে ইসরাইলের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা আরব শ্রমশক্তির মধ্য দিয়ে। তার বক্তব্য অনুসারে "ইসরাইলের প্রতিটি ভবন নির্মাণে, ক্ষেত-খামারে, মিল-ফ্যাক্টরিতে, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বন্দর সর্বত্র প্রতিদিন হাজার হাজার ফিলিস্তীনী কাজ করছেন। কাজ করছে ..... এই সব অঞ্চল থেকে আসা ফিলিস্তীনী তরুণরা।
এই যখন অবস্থা তখন ফিলিস্তীন ভেঙ্গে দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা কোনোভাবেই সফল হতে পারে না, বরং কার্যত তা সম্ভবই নয়। যদি ফিলিস্তীন ভাগ করা হয় তাহলে না ইসরাইল না ফিলিস্তীন কোনো রাষ্ট্রই গড়ে ওঠবে না। যারা দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন তারা হয়ত এই অঞ্চলের স্বভাব-প্রকৃতি, ডেমোগ্রেফী সম্পর্কে অজ্ঞ না হয় তারা যে কোনো উপায়ে (ইহুদী ফিলিস্তীনীদের ঘাড়ে তার বোঝা যত ভারিই হোক) নিজেদের ঘাড় থেকে এই দায়িত্ব নামাতে চাইছেন। নিজেদের প্রবোধ দিতে চাইছেন তারা একটি ঐতিহাসিক সংকটের সমাধান করে ফেলেছেন। যদি আমরা এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেই তাহলে দুটি রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর নয়, এর মাধ্যমে আমরা দীর্ঘ মেয়াদী নতুন আরেকটি যুদ্ধের বীজ রোপণ করব।
পিতৃ ভূমি এবং প্রতিশ্রুত ভূমি
ফিলিস্তীনীদের বিশ্বাস, উকা, হাইফা, জাফা... সমুদ্রতীরবর্তী ইত্যাদি শহরগুলো মূলত তাদের শহর, প্রজন্মপরম্পরায় চলে আসা তাদের পিতৃভূমি এবং নিকট অতীতেও তারাই ছিল এই অঞ্চলের মূল অধিবাসী। তার প্রমাণ বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরের ফিলিস্তীনীরা। গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংকের শরনার্থী শিবিরে যারা আছে তারা কোথায় ছিল ? গাজা বা ওয়েস্ট ব্যাংক তাদের আসল ভূমি নয়। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর দেশান্তরিত হয়ে তারা এখানে এসেছে। এই ফিলিস্তীনীরা ৪৮ সালের যুদ্ধের সময় ছেড়ে আসা তাদের পিতৃভূমির দাবি ছাড়তে কোনোভাবেই রাজি নয়। তা ছাড়া লেবানন ও সিরিয়ার শরনার্থী শিবিরে যে সব ফিলিস্তীনী বাস করছে তাদের আসল ভূমিই বা কোথায় ?
অপরদিকে ইহুদীরা বিশ্বাস করে ওয়েস্ট ব্যাংক তাদের পবিত্রভূমি, তা বরং ইহুদী জাতির হৃদপিণ্ড। তারা তাকে ওয়েস্ট ব্যাংক বলে না, বলে ছামিরা ও ইয়াহুদা।
সুতারাং আমরা বলতে পারি যে সিদ্ধান্ত একটি জাতিকে তাদের পিতৃভূমি থেকে এবং আরেকটি জাতিকে তাদের পবিত্রভূমি থেকে বঞ্চিত করে তা কোনোভাবেই এর বৈধ সমাধান হতে পারে না।
অন্যতম জায়োনিস্ট বুদ্ধিজীবী অষড়া ঐধৎধনরহ বলেন : এই ক্ষেত্রে প্রধান সংকটটা হচ্ছে ভিন্ন দুটি জাতি একই ভূমিতে তাদের অধিকার ও মালিকানা দাবি করছে।" এই ক্ষেত্রে ঈযধরস ডবরুসধহহ ত্রিশের দশকের বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন : "এই ক্ষেত্রে মূল সমস্যাটা হচ্ছে উভয় পরে দাবিই ন্যায্য।"
সুতরাং এই ক্ষেত্রে অদলবদল কোনো সামাধান হতে পারে না। তা অসম্ভব এবং অবৈধ সিদ্ধান্ত। কারণ ইহুদীরা- বিশেষত ধার্মিক ইহুদীরা- তাদের বিশ্বাসের পবিত্র ভূমি ছাড়া অন্য কোনো ভূমি গ্রহণ করতে রাজি নয়। অন্যদিকে ফিলিস্তীনীরা- বিশেষত রণশীল ফিলিস্তীনীরা কোনোভাবেই তাদের পিতৃভূমির দাবি ছাড়তে রাজি নয়।
এই অবস্থায় যদি ইসরাইল এবং ফিলিস্তীন নামে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে এই দুটি রাষ্ট্র, কেউ তাদের পিতৃভূমি রার জন্য, কেউ প্রতিশ্রুত ভূমির দখল নেওয়ার জন্য পরস্পর অব্যাহত সংঘাতে জড়িয়ে থাকবে।
সুতরাং ইতিহাস এবং বাস্তবোচিত সমাধান, ইহুদী ও ফিলিস্তীনীদের সমন্বয়ে অভিন্ন এক রাষ্ট্র (ইসরাতীন) প্রতিষ্ঠা করা, যে রাষ্ট্রে ইসারাইলী এবং ফিলিস্তীনী যেখানে খুশী বাস করবে, যেখানে ইচ্ছে অবাধে যাতায়াত করবে। এই রাষ্ট্রের যে নাগরিক ওয়েস্ট ব্যাংককে তাদের ধর্মীয় পবিত্রভূমি বলে বিশ্বাস করে সে চাইলে সেখানে বাস করতে পারবে, স্থায়ীভাবে বাস না করতে পারলেও যখন খুশী সেখানে যেতে পারবে। সে যদি তাকে ছামিরা বা ইয়াহুদা নামে ডাকতে চায় তাহলে ডাকুক..তাতে কেউ বাধ সাধবে না। আর ফিলিস্তীনীরা যদি উকা, হাইফা বা জাফায় বাস করতে চায় তাহলেও তাকে কেউ বাধা দিবে না। সে অবাধে তার পিতৃভূমিতে বিচরণ করতে পারবে... এইভাবে জল তার নিজস্ব ধারায় ফিরে আসতে পারে এবং উভয় পরে বঞ্চনার অভিযোগের অবসান ঘটতে পারে।
আমরা আগেও দেখিয়েছি মূলত আরব আর ইহুদীদের মাঝে মৌলিক বা ঐতিহাসিক কোনো শত্রুতা নেই। ইহুদীদের সাথে প্রাচীন কালে শত্রুতা ছিল রোমানদের এবং আধুনিক কালে ইউরোপীয়ানদের। এবং রোমান ও ইংরেজ রাজাদের অত্যাচার থেকে আরবরাই তাদের উদ্ধার করেছে, স্পেন থেকে বিতারিত হওয়ার পর আরবরাই তো ইহুদীদের আশ্রয় দিয়েছিল।
জায়োনিস্ট গবেষক আলুফ হারাবান আরো লিখেছেন : "ফিলিস্তীনীরা বলে : ইউরোপের ইহুদী নির্যাতনের মূল্য আমাদেরকে কেন দিতে হবে?"। তার মানে ফিলিস্তীনীরা ইহুদী নির্যাতনের সাথে জড়িত নয়। আর ইহুদীরা বলে : আমরা ফিলিস্তীনীদের তাড়াই নি। তারা বলেন : অফিলিস্তীনী আরবরা এসে আমাদের উপর হামলা করে ১৯৪৮ এর যুদ্ধ বাধিয়েছে।
এই মন্তব্যগুলো খুবই ইতিবাচক। তা দুই পরে সমন্বয়ে অভিন্ন এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমাধানের সম্ভাবনা এবং সাফল্য নিশ্চিত করে।
তিনি আরোও লিখেছেন : "ফিলিস্তীনী এবং ইসরাইলীদের মিলন মানে এমন দুটি জাতির মিলন যারা অন্যদের হাতে দীর্ঘকাল শোকাবহভাবে নির্যাতিত হয়েছে।" ইউরোপে অবজ্ঞাত ইহুদীরা ফিলিস্তীনে ঢুকতে চাইলে ফিলিস্তীনারা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে । ফিলিস্তীদের সেই সিদ্ধান্তের নিন্দের পর তিনি লিখেছেন : "ফিলিস্তীনীদের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে অবশ্যই যুক্তি আছে। কারণ কোনো জাতি অন্য কোনো জাতির সামনে তাদের জন্মভূমির সব দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে, অন্য কোনো জাতিকে তাদের নিজস্ব অবকাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়ে তাদের নিজেদের ভূমি সংকুচিত করেছ্তেইতিহাসে এমনটা কখনো ঘটে নি।"
উপসংহার :
১. এই অঞ্চল খুবই সংকীর্ণ, ভিন্ন ভিন্ন দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।
২. দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তারা উভয়ে অব্যাহত সংঘর্ষে জাড়িয়ে থাকবে। কারণ তারা উভয়ে মনে করে তার ভূমি অন্য রাষ্ট্রটি জবর দখল করে রেখেছে। ফলে উভয় রাষ্ট্র সর্বণ অপর রাষ্ট্রের হুমকির মুখে থাকবে।
৩. ইসরাইল রাষ্ট্র ইহুদী মুহাজিরদের এবং ফিলিস্তীন রাষ্ট্র ফিলিস্তীনী শরনার্থীদের সংকুলানের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
৪. উভয় রাষ্ট্রের নাগরিকদের মাঝে সংমিশ্রণ ঘটছে। কমপ েএক মিলিয়ন ফিলিস্তীনী তথাকথিত ইসরাইল রাষ্ট্রে বাস করছে এবং প্রায় অর্ধ মিলিয়ন ইহুদী বাস করছে গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংকের ইহুদী বসতিগুলোয়। এ ছাড়াও আছে দারোজী, ক্যাথলিক খৃষ্টান ইত্যাদি অন্যান্য সমপ্রদায়। এই সংমিশ্রণ অভিন্ন কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই সম্ভব।
৫. ইসরাইলী ফ্যক্টরীগুলোতে অসংখ্য ফিলিস্তীনী শ্রমিক কাজ করছে।
৬. পণ্য এবং শ্রমশক্তির আদান-প্রদানে রাষ্ট্র দুটি একে অপরের উপর নির্ভরশীল বা পরস্পর পরিপূরক।
চূড়ান্ত সমাধান :
১. শরনার্থী এবং দেশান্তরিত ফিলিস্তীনীদের তাদের ঘরবাড়িতে ফিরিয়ে আনা।
২. লেবাননের মত একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
৩. স্বাধীন নির্বাচন ব্যাবস্থা প্রনয়ণ করা। প্রথম এবং দ্বিতীয় নির্বাচনটি হবে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে।
৪. এই নতুন রাষ্ট্র এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে বিধ্বংসী মরণাস্ত্র থেকে মু্ক্ত করা
৫. এই পথেই মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। এবং লেবাননের মত ইসরাতীন রাষ্ট্রও স্বীকৃত এবং আরব লিগের অন্তর্ভূক্ত রাষ্ট্র হয়ে ওঠতে পারে।
এই নতুন রাষ্ট্রের নাম নিয়ে বিতর্ক ওঠতে পারে, সেই বিতর্ক খুবই স্থূল, অনর্থক এবং তিকর। যারা এই বিতর্ক তুলেন তারা যুক্তিহীন আবেগতাড়িত। ইহুদীদের নিরাপত্তা ও ফিলিস্তীনীদের সাথে মিশে থেকে শান্তিমূলক বসবাস এবং নিছক একটি নামের জন্য একটা জাতির নিরাপত্তা বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা বলি দেওয়া- আমাদেরকে এই দুটি বিষয় তুলনা করে ভাবতে হবে। আমাদের পুরোনো প্রহরীর হৈচৈ শোনা যাবে না কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাইকোলজির অনুসরণ করা যাবে না। আমাদের শুনতে হবে তরুণদের.. বিশ্বায়নের প্রজন্মের.. ভবিষ্যত প্রজন্মের আহ্বান।
পুরোনো রণশীল মনভাবই আমাদের এই শোকাবহ বর্তানের জন্য দায়ী। সেটা ভুলে গেলে চলবে না।
একক কোনো ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মুসলিম-আরব বিশ্বের জন্য নিরাপদ নয়। কিন্তু যদি মুসলিম ইহুদী এবং ফিলিস্তীনীদের সমন্বয়ে কোনো রাষ্ট্র গড়ে ওঠে তাহলে সেই রাষ্ট্র কোনো মুসলমান বা আরবের উপর হামলা করতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ১:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



