জীবন মানেই ছুটে চলা। কখনও ধীরে, কখনও দ্রুত। কখনও লক্ষ্য স্থির করে আবার কখনও উদ্ভ্রান্তের মত। জীবন সংগ্রামের কাছ থেকে পালাতে গিয়ে মানুষ ছুটে চলে দুর্বার গতিতে। সব ভয়ংকর স্মৃতিকে পিছনে ফেলে রেখে যেতে চায়। কিন্তু মানুষের ছুটে চলা যে বড় বেশি নিয়মে আবদ্ধ, বড় বেশি জ্যামিতিক। কখনও সে ছুটে চলা হয় বৃত্তাকার পথে। যেখানে না চাইলেও বারবার ফিরে আসে পূর্বের রহস্যময় বিভীষিকা। অনেকে আবার চলতে পারে সরলরৈখিক ভাবে। যেখানে আপাত ভয় নেই দুঃসহ সে স্মৃতির মোকাবেলা করার। তাই বলে কি সে আসলেই একে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে? ভুলে ভরা মানুষের জীবনে হয়ত সে পিছনে ফিরে তাকায়। নিমিষেই তাকে গ্রাস করে সে ভয়াবহ স্মৃতি। তাহলে, জীবনে সফল কে? নিশ্চয়ই তারা, যারা সেই স্মৃতিকে অবলোকন করেও ঘুরে দাঁড়ায়। ছুটে চলে।
Bhag Milkha Vag (2013) হল, সেই ছুটে চলার গল্প। ইতিউতি ঘুরতে থাকা প্রায় পথভ্রষ্ট কারো পথে ফিরে আসার গল্প। অতীতকে পিছনে ফেলে সামনে চলার গল্প। পথের মাঝে হোঁচট খেয়ে ঘুরে দাঁড়াবার গল্প। সব কথার শেষে, এ যেন আমাদের জীবনের গল্প।
মিলখা সিং। দুর্বিনীত এই যোদ্ধার জন্ম ১৯৩৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের গোবিন্দপুর গ্রামে। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড এ তার অবদানের জন্য তাকে ডাকা হয় “The Flying Shikh” (উড়ন্ত শিখ) Bhag Milkha Bhag তারই জীবনকাহিনী, যা সেলুলয়েডে তুলে এনেছেন পরিচালক “রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা”। মিলখা সিং এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন এ সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান “ফারহান আখতার”, এছাড়াও এখানে অভিনয় করেছেন, সোনম কাপুর, মিশা শফি, দেব গিল প্রমুখ। মিলখা সিং এর সংগ্রামী জীবন, প্রেম, কষ্ট সাফল্য, ব্যর্থতা সব কিছু এক এক করে তুলে ধরা হয়েছে মুভিতে।
মুভির কাহিনী শুরু ১৯৬০ সালের রোমে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস দিয়ে। দৌড়ে অংশ নিচ্ছে মিলখা সিং। অনেকের চেয়ে এগিয়ে সে। দৃষ্টি সামনে। পিছন ফিরে দেখার সময় নেই। আচমকা পরিচিত কণ্ঠে ভেসে আসলো “ভাগ মিলখা ভাগ” অলিম্পিকের টানটান উত্তেজনার মাঝেও কে যেন একটানে তাকে তুলে নিয়ে গেলো তার ভয়াল অতীতের কাছে। যে অতীত থেকে পালাতে চাইছে সে প্রতিনিয়ত। আবার সামনে এসে ধরা দিল সেই অতীত। নাহ পরল না এবার অতীতকে জয় করতে; যা আগেও বহুবার করে এসেছে সে। এবারের কাহিনী সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মিলখা সিং কে নিয়ে। যে পাঞ্জাবে বসবাস করছিল তার পরিবারের সাথে একরকম সুখেই। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের সময় অত্যাচারের আর অভিশাপের খড়গ নেমে আসে তার পরিবারের উপরে। “ভাগ মিলখা ভাগ” বাবার মুখে এমন কথা শুনেই প্রাণপণে ছুটে চলা শুরু হয় তার। যে ছুটে চলা শেষ হয়নি আজ অবধি। ছুটে চলতে চলতেই পিছন ফিরে দেখতে পায় তার পরিবারের বাতিগুলোকে একে একে চোখের সামনে নিভে যেতে। তার ছোট্ট কাঁধের উপরে পড়ে এতগুলো লাশের ভার। বইতে না পেরে পালিয়ে আসে সে দিল্লিতে। সেখানে আছেন তার বোন। কিন্তু সৌভাগ্য যার কাছ থেকে ভেগে পালিয়েছে সে কি আর এত সহজেই তার দেখা পায়? সেখানে গিয়ে সে পরিচিত হল আরেক কঠিন বাস্তবের। বুঝতে পারল সে, জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলা ছাড়া গতি নেই। এবার সে মিশে যেতে শুরু করল পরিবেশের সাথে। ভালো থেকে চারপাশ থেকে যে সুবিধা পায়নি সেটা নিমিষেই হাতে এসে ধরা দিতে লাগলো শুধু একটু আঙ্গুল বাঁকা করাতেই। এভাবেই বেড়ে উঠলো সে। এলাকাতেও সে রকম ভাবেই পরিচিত হয়ে উঠলো। কিন্তু যত যাই হোক মানুষ তো, প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা পড়লো সে আবার। একটি কথাও না বলেই তার হৃদয় ছুঁয়ে গেলো এক মেয়ে।
ধীরে ধীরে ভাবের গভীরতা বাড়তে থাকল। তবে তা অতলে পৌঁছাবার আগেই চলে আসলো শর্ত, সেই চিরায়ত “তোমাকে ভালো হয়ে যেতে হবে”; মিলখাও প্রাণপণ দিয়ে চেষ্টা করে চাকুরী পেল সেনাবাহিনীতে। সেখান থেকে লোক নেবে অ্যাথলেটিক্সে, মূলত দৌড়ে। সেখানে সুযোগ পেয়ে গেলো কঠোর পরিশ্রমী মিলখা। নিজের গায়ে জড়াবার অধিকার পেল দেশের প্রতীক খচিত স্যুট। তার বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। এর মাঝে অন্য অনেক স্বপ্নও ভেঙ্গে যায় তার। নিজের অজান্তেই তৈরি হয় অনেক শত্রুর। পদে পদে বাঁধা আসে। কিন্তু কষ্টের অপর নাম যার কাছে জীবন তাকে কি থামানো যায়? সেই বাঁধাকে ডিঙ্গিয়ে সে তৈরি করে রেকর্ড। এরপরে আবার বাঁধা, আবার পরিশ্রম, আবার সাফল্য, আবার বাঁধা, আবার পরিশ্রম, আবার সাফল্য। ততদিনে মিলখা বুঝে গিয়েছে এই চক্র। এই চক্রের মধ্যে আবদ্ধ থেকে যেমন নিতে হয় অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত, ভেঙ্গে ফেলতে হয় পুরানো প্রতিজ্ঞা ঠিক তেমনি আসে সাফল্য, নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয় জীবন। এই বোধ বুঝতে পেরেই সে ঘুরে দাঁড়ায়। অতীতের সেই জীবনকে ছুড়ে দেয় চ্যালেঞ্জ? কিভাবে? যে কাজটা সে ভালো পারে, দৌড়ের মাধ্যমে। মাঝের এত এত ঘটনা এত এত জীবনের বাঁক, সব কিছু পাওয়া যাবে মুভিতেই। বায়োগ্রাফি মুভিতে শেষের অংশ জানাই থাকে। তবুও জীবন কাহিনীটা জানতে একেবারে খারাপ লাগার কথা না।
মুভির দৈর্ঘ্য সচরাচরের চেয়ে একটু বেশি। তিন ঘণ্টার উপরে। অনেকে মনে করতে পারেন প্রথম অর্ধাংশের কিছু দৃশ্য না দেখালে খুব ক্ষতি হত না। তবু বেশ উপভোগ্য ছিল মুভিটি। মুভি দেখতে গিয়ে একঘেয়েমি না আসার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান মনে হয় মুভির স্ক্রিপ্টে। অসাধারণ স্ক্রিপ্টের মাধ্যমে মন ভুলিয়ে রেখেছিলেন “প্রসূন জোশি” একের পর এক স্ক্রিপ্টের সূক্ষ্ম কাজ দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। সেই সাথে উল্লেখ করতে হয় পরিচালকের অ-সরলরৈখিক গল্প বলার ধরন এর সফল প্রয়োগের কথা। তিনি অনেকগুলো সময়কাল একসাথে দেখিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু কোনও কিছু শেষ করে দেননি। তাই আগ্রহ ধরে রাখতে পেরেছিলেন শেষ একেবারে শেষ পর্যন্ত। আরও একটা ভালো দিক ছিল বায়োগ্রাফির শেষ যেহেতু আগে থেকেই মানুষ জানে সেহেতু তাকে কোনও টুইস্ট হিসেবে ব্যবহার না করা। সেটা প্রথমেই দেখিয়ে দিয়ে পরিচালক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। আর এই ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে বলতে গেলে পুরো মুভিটাই ফারহান আখতারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই ক্ষেত্রে সফলতার সাথেই উতরে গিয়েছেন তিনি। রক অন, জিন্দেগী না মিলেগি দোবারার পড়ে এই মুভিতেও তিনি কঠোর পরিশ্রম আর সু-অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন। তার কথা আলাদা করে না বললে হবে না। মুভিতে যদি শুধু একটা জিনিসের নাম করতে হয় যা দেখার মত হয়েছে তাহলেও বলতে হবে ফারহান এর দৌড়। বলিউডের তথাকথিত নায়কদের সাথে ফারহান এর কিছুটা অমিল রয়েছে। তাকে দেখতে যতটা না নায়ক মনে হয়, তার চেয়ে বেশি মনে হয় সাধারণ পাশের বাড়ির ছেলের মত। একারণেই এই ধরনের চরিত্রের সাথে তিনি ভালো খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তার শারীরিক গঠনের পরিবর্তন থেকেই স্পষ্ট যে তিনি কতটা পরিশ্রম করেছে। সেই সাথে পেশাদার অ্যাথলেটদের মত ভঙ্গিও তাকে সাহায্য করেছে চরিত্রে মিশে যেতে।
সোনম কাপুর যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন খুব একটা খারাপ অভিনয় করেননি। তবে তার অভিনয় নিয়ে অনেকের মনেই এখনো যথেষ্ট প্রশ্ন রয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে তার চরিত্র খুব বেশি বড় না হওয়ায় অভিযোগের সুযোগ কমে এসেছে। তবে অভিনয়ের কথা বলতে গেলে আলাদা করে বলতে হবে প্রকাশ রাজ আর পবন মালহোত্রার কথা। তারা দুজনই বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। ছোট চরিত্র করার পরেও তাদের ভালো অভিনয় চোখে পড়েছে।
মুভির পরিচালনায় কিছু অংশে দূরদর্শিতার দেখা মিললেও (যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে) সার্বিকভাবে মুভির পরিচালনা তেমন আহামরি ছিল না। বারবার মনে হয়েছে ফারহান বুঝি এখানে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন পরিচালককে। সেই সাথে বলতে হয় সিনেমাটোগ্রাফির কথা। চোখে লেগে থাকার মত দৃশ্য খুব বেশি ছিল না। পাঞ্জাবে থাকাকালীন সময়ের কিছু দৃশ্য বেশ ভালো ছিল। কিন্তু এরপরে আর সেই গতি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সবদিক বিবেচনায় আনলে এটি অবশ্যই ভালো একটি মুভিই হয়েছে। মানুষের জীবন সংগ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা নিতে আমাদের ভালো লাগে। এবং সেটাই উচিৎ। সেটা হোক বাস্তবে দেখে না সেলুলয়েডের পাতায় দেখে। আর এখানে এমন এক উদাহরণ নিয়ে সেলুলয়েডে দেখানো হয়েছে যিনি আমাদের দৃষ্টির সামনে এখনো উজ্জ্বল ভাবে জ্বলছেন। শিক্ষা নেবার মত যেমন অনেক কিছু রয়েছে এখানে, তেমনি আছে উপভোগ করার মত জিনিসও। তাই “ভাগ মিলখা ভাগ” একই সাথে দুই চাহিদাই পূরণ করতে পেরেছে বলেই মনে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ২:৫৭