somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাদাইম্যার ভ্রমণকাহিনী

০৬ ই মে, ২০১১ দুপুর ১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্বঃ কেন্দ্রাভিমুখী

ছোট বেলায় পড়াশোনা না করলে পিতা বলতেন, “পড়তে ইচ্ছা না করলে যাও গরু চরাও”- এ কথাটা বছরে তিনবার শোনাটা এক ধরণের রুটিনই ছিল যখন রেজাল্ট কার্ডটা পিতাজানকে স্বাক্ষর করানোর জন্য দিতে হত। সেই সময় শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহাশয়রা প্রায়ই অভিযোগ তুলতেন যে আমাদের পড়ানো আর গরু চরানো সমান। তাই ছোটবেলা থেকেই গরু চরানোকে নিকৃষ্ট বলে গণ্য করতাম। সুতরাং এই বিকল্প ব্যবস্থা যাতে গ্রহণ করতে বাধ্য না হই তাই নূন্যতম পড়াশোনাটুকু করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ষোল বছর ছাত্রজীবনের অসংখ্য ভয়াবহ অভিঙগতার পর আজকে মনে হচ্ছে আমি বোধহয় কোনো ভুল করে ফেলেছি। আমি চাইলে জীবনতা হয়ত অন্য রকম হতে পারত।

কোনো ধরণের এপিফেনি হওয়াটা খুব পীড়াদায়ক- ভুল সংশোধনের চেষ্টা আর এর ব্যর্থতার টানাপোড়নে সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। ঠিক ভুল সংশোধনের জন্য নয়, সাকিবের সাথে সাকিবের বন্য ষাঁড়(HUNK)- টাকে নিয়ে দু’জন মিলে বের হলাম দেশটাকে একটু দেখবো বলে। অন্যটাও ঠিক- সাকিবের তো পড়াশোনার কোনো বালাই নেই আর আমিও একটা খন্ডযুদ্ধ শেষে বিশ্রামরত। প্রথম পরিকল্পনা ছিল জেমস ওয়াট প্রদর্শিত পথে চলা। কিন্তু আমি যখন গ্যাস ফিল্ডে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের পরিকল্পনা করলাম তখন ঝোড়ো বাতাসকে আর বাগে আনা গেলোনা। ফলাফল- কিছুদিনের জন্য রাখাল বনে যাওয়া।

প্রথম এবং একমাত্র বাধা ছিলো বাসা থেকে ম্যানেজ করা। আমাদের দু’জনের কারো মা’ই তাদের সন্তানদের বিশ্বাস করেননা(কলিযুগ!)। শেষে বলা হলো আমরা ষাঁড়টাকে নাটোরে বন্ধুর(আমার মা জানেন বন্ধুটা হল আশিক আর সাকিবের মা জানেন সাজ্জাদ,যে যাকে চেনেন।দু’জনের কেউই নাটোর থাকেনা) বাসায় রেখে বাসে করে ঢাকা যাবো। জানিনা আমাদের মাতাশ্রীরা আমাদের বিশ্বাস করেছেন কিনা, কিন্তু এরপর তারা আর কোনো আপত্তি তোলেননি।

৩০ এপ্রিল ২০১১, ভোর ছয়টা। আগের দিন রাতেই পথদণ্ড(স্ট্রীট মিটার)-টা শুন্যে নামিয়ে আনা হয়েছিলো। লক্ষ্য- কয়েক দিনে কত পথ পাড়ি দিলাম তার একটা হিসাব রাখা। সাকিবের বাসা থেকে বের হলাম কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে। সাকিবের এর আগে ঢাকা-রাজশাহী পথে কয়েকবার রাখাল হবার অভিঙগতা থাকলেও আমার কাছে এটা নতুন। সুতরাং আমি কিঞ্চিত উত্তেজিত, আর বাকিটা ভীত(সাকিবের সাথে যারা এই বন্য পশুর পিঠে চড়েছে তাদের জন্য ভয় পাওয়াটা লজ্জার কিছু না)।

ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে দু’জন মিলে বের হয়ে গেলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হল ষাঁড়টাকে ঢাকা পৌছানোর মত দানাপানি দেয়া হয়নি। খুব একটা দুশ্চিন্তা করলাম না; মহাসড়ক- কোথাও না কোথাও একটা না একটা আস্তাবল পাওয়াই যাবে।

যাত্রা শুরু করার পর থেকে ইতিমধ্যে ২০ কি.মি. অতিক্রম করে এসেছি, কিন্তু কোনো আস্তবলই এত সকালে খুলে পাওয়া যাচ্ছিলোনা। ধীরে ধীরে আমাদের হার্টবিট সিডরের পুর্বমুহূর্তের ব্যারোমিটারের মত বাড়তে শুরু করলো, ধমনীর রক্তগুলো যেন পারদ সমতুল্য- ধীরে ধীরে হৃদপিন্ডের উপর চাপ বৃদ্ধি করছে। কারণ এই বোবা পশুর সঞ্চয়ে যে পরিমাণ শক্তি আছে তা দিয়ে নাটোরও পৌছানো যাবে কিনা সন্দেহ আছে। তাহলে কি যাত্রা শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাবে? কারণ দানাপানির অভাবে ষাঁড়টা যে কোনো মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে পারে। এরপর কিছুদূর পরেই গোদের উপর বিষফোঁড়া- সামনে হাট, মোটামুটি আধা কি.মি. পরযন্ত রাস্তা বন্ধ। হলুদের অনুষ্ঠানের ডালার মত রকমারি বাহন মিষ্টান্নগুলোর মত রাস্তার শোভা বর্ধন করছে। মেজাজ ততক্ষনে দুপুরের সূরযের মত চড়তে শুরু করেছে। এক চিলতে পরিমাণ জায়গা নেই যে আমাদের বাহনটাকে নিয়ে চিপা দিয়ে বের হয়ে যাই। ষাঁড়ের পুণঃ পুণঃ হাম্বা ডাকের পর একটু একটু করে চিপা পেতে থাকলাম। পঁচিশ মিনিটের ক্রমাগত চেষ্টার পুরস্কার হিসেবে অন্য সব বাহন পিছে ফেলে আমরা সেই জগাখিচুড়ী ছেড়ে সামনের দিকে ধাবিত হলাম। বের হয়েই দেখি খোদ ভেলিস আমাদের ষাঁড়ের জন্য দানাপানি নিয়ে বসে আছেন- সামনে আস্তাবল।

আবার কেন্দ্রের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। পরিচিত রাস্তা, দেখার তেমন কিছু নেই। তবে সদ্য জন্ম নেয়া গাছগুলোকে যদি নবজাতক মানব শিশুর সাথে তুলনা করা চলে তাহলে হ্যাঁ, প্রাকৃতিক হাসপাতালের শিশু বিভাগের মধ্যে দিয়ে আমাদের রাস্তা যাচ্ছিলো। পৌণে এক ঘন্টা সিস্টেম-লসের জন্য ৪০ মিনিটের রাস্তা সোয়া এক ঘন্টায় শেষ করলাম করে নাটোরে পৌছালাম। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি ছিলো- ষাঁড়ের গিরাগুলোতে তেল (ইঞ্জিন অয়েল) দিতে হবে। যাত্রা শুরু করার আগে চারদিন সময় পেয়েছিলাম কাজগুলো করার জন্য, কিন্তু অধিকাংশটাই কাজে লেগেছে পোস্টারিং-এর জন্য। সুতরাং ষাঁড়ের জন্য কিছু করার সময় আমাদের হাতে ছিলোনা। যাই হোক, নাটোর ষ্টেশনের বাইরে এক জায়গায় ষাঁড়টির হাঁটুগুলো তেল দিয়ে মালিশ করে দিলাম। এরপর নাটোর শহরে এক কাপ চীনদেশীয় পানীয়ের সাথে তামাক সেবন করে আবার রাস্তায়।

বনপাড়া- বাংলাদেশের প্রশস্ততম মহাসড়ক। সাকিবের মুখের হাসি দুই কোনায় গিয়ে ঠেকে গেলো। হেলমেটটাকে কাউবয় হ্যাটের মত করে টোঁকা মেরে জুতো দিয়ে ষাঁড়ের কোমরে একটা গুতাঁ মেরে মুহুর্তের মধ্যে শোয়েব আক্তারকে ছাড়িয়ে গেলো। আমার মত অনেকেই ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখলোনা। সাকিব যখন প্রায় উড়তে শুরু করলো ঠিক তখনই আসমানী দেবতা ইয়ু-হুয়াং-সাং-তি শালিকের রুপ ধরে সাকিবের উত্তর-হস্তে আঘাত করলেন। আসমানী বাণী অগ্রাহ্য করা উচিত না- তাই সাকিব আবার আগের গতিতে ফিরে এলো।

যমুনা সেতু। সব সময় এই সেতু পার হয়েছি বাসে বা ট্রেনে করে। বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুগুলোর তালিকায় এগারোতে থাকা এই সেতু পার করে আসলাম যমুনা ক্যান্টনমেন্ট। ঠিক যাত্রা-বিরতি না, কারণ সেতুর আগেই এক রেস্টুরেন্টে তা নিয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য হলো এখানে কর্তব্যরত বন্ধু শাহাদতের গায়ে হিংসার বিছুটি লেপন করা। কতটা সফল হয়েছি তা বলতে পারবোনা, শাহাদাত কোনোভাবেই তা প্রকাশ করেনি, যা করেছে তা হল উদার অতিথিপরায়নতা। পথের খুঁটি-নাটি বিপদ-আপদ সম্পর্কে ও আমাদেরকে সাবধান করে দিলো। কিন্তু আমরা “জেনে-শুনে বিষ করেছি পান”। শাহাদাতের ওখান থেকে বের হয়ে শুরু করলাম এই পর্বের কালো দিকের যাত্রা।

আগেই বলেছি রাখাল হওয়া প্রথমে আমাদের পরিকল্পনায় ছিলোনা। সুতরাং সেভাবে কোনো ধরণের ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। পরে মোটামুটি সব ব্যবস্থাই করা হয়েছে, একটা তখনো বাদ ছিলো যেটা করার জন্য ঢাকা যাওয়া আবশ্যক- হেলমেট একটাই ছিলো, ঢাকা যাওয়ার আগে পরযন্ত আমার কোনো হেলমেট ছিলনা। সেজন্য পথের সব ধুলোবালি আপন করে নেয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলোনা। ততক্ষণে হেলিওস-ও তার রথ নিয়ে মধ্য আকাশে। দ্বিমুখী আক্রমণে হাল ছেড়ে বসে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলোনা। হেলিওস-এর চোখ রাংগানি আর সুঁইয়ের মত বালির কণার কল্যাণে আমার চাঁদপানা মুখটা মলিন হয়ে গেছে, জানিনা বাসায় ফেরার পর আমার মা তার সন্তানকে চিনতে পারবেন কিনা।

ইচ্ছা ছিলো আশুলিয়া দিয়ে ঢাকা প্রবেশ করার। কিন্তু রাস্তা যে কোন দিক দিয়ে ভাগ হয়ে গেছে তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, শুধু মনে ছিলো বাইপাইল থেকে বাম দিকে। ইপিজেড পৌছানোর পর হাল্কা বৃষ্টি শুরু হলো। ততক্ষণে আমার পশ্চাদ্দেশ(যথেষ্ট মার্জিত ভাষা হোলো তো?) হাউমাউ করে কাঁদা শুরু করে দিয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বিরতি নেয়ার। চা-পানের পর আস্তে আস্তে যেতে থাকলাম, কারন-এক, রাস্তা খুবই পিচ্ছিল, আর দ্বিতীয়ত, আশুলিয়ার রাস্তা খুঁজে পেতে হবে। বাইপাইল এর কিছুদূর পুর্বে আমরা নিয়তির মুখামুখি হলাম-আমাদের না, অন্যের। এক কালভার্টের মধ্যেখানে একটা বাস, ট্রাক আর একটা গাড়ির ত্রিমুখী সংঘর্ষ। ঘটনাটা আমরা পৌছানোর পাঁচ-দশ মিনিট আগের। বাসের ভিতরের যাত্রীগুলো তখনো বাস থেকে বের হচ্ছে। কালভার্টের মধ্যে হওয়াতে আগে-পিছে হালকা একটা যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যানজটটাকে পাশ কাটিয়ে পৌছে গেলাম বাইপাইল। গাবতলীর রাস্তা ডানে রেখে আমরা আশুলিয়ার পথ ধরলাম।

আশুলিয়া মডেল টাউনের কাছে এসে আমার পশ্চাদ্দেশ আবার ফোঁপানো শুরু করলো। আমরা আরেকটা বিরতি নিতে বাধ্য হলাম। ধুমপান শেষ করে রওনা দিলাম ঢাকার দিকে। রাস্তার অন্য বাহনগুলোকে পাশ কাটিয়ে পৌছে গেলাম নিকুঞ্জ বন্ধুর বাসায়। যাত্রা সেদিনের মত শেষ। পরের দিন আবার আমাদের যাত্রা শুরু হবে- এবার সম্পূর্ণ অজানা ভ্রমণ। অপরিচিত রাস্তা, অপরিচিত জায়গা।



(চলবে)
১২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×