somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পদোন্নতি

০৫ ই মে, ২০১২ রাত ১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাস শেষে উপরওয়ালা তার দফতরে ডেকে বেতন আর প্রোমোশন লেটার একসাথে হাতে ধরিয়ে দিলেন, “পরের মাস থেকে আপনি মেইন অফিসে কাজ করবেন”। তারপর খুঁটিনাটি আলোচনা শেষে দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে বললেন, “ওখানে ভাল কাজ দেখাতে পারলে আপনার পরের প্রোমোশন হয়ত আরো তাড়াতাড়ি হবে। আর শুধু কাজ দেখালেই চলবে না, ওখানকার উপরওয়ালাদের সাথে মানিয়ে চলতে পারলেই দেখবেন একদিন আপনাকেও কোনো শাখা অফিসের প্রধান করে পাঠানো হয়েছে”।

গুরুজনেরা বলেন- সফলদের পদাঙ্ক অনুসরণ কর। উপরওয়ালাকে তার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বের হয়ে আসলাম।

এদিকে আমার প্রোমোশনের খবর পুরো অফিসে এমনভাবে ছড়িয়েছে যেমন বাড়ির মেয়ের বিয়ের খবর পড়শির কাছে। সহকর্মীরা একে একে এসে অভিনন্দন জানিয়ে, পিঠ চাপড়িয়ে পরের দিন রাতের খাবারের দাওয়াত এক রকম জোর করেই নিয়ে যার যার কাজে চলে গেলেন।

সহকর্মীদের অভিনন্দনে আমিও একটু উদ্বেলিত হই। কুমারী মেয়ের মত আসন্ন সুখের দিনের নিশ্চিত খুশির আতিশয্যের বহিঃপ্রকাশের জন্য ঠিক করি সহধর্মিনীর জন্য ভাল দেখে একটা শাড়ি কেনা যাক। বোনাসের সময় ছাড়া ভদ্রমহিলাকে সাধারণত কখনো কিছু কিনে দেয়া হয়না। বেতন যে খুব কম পাই তা নয়, কিন্তু তা দিয়ে এই বড় শহরে মাস গুজার করার পর অবশিষ্ট যা থাকে তা দিয়ে আমাদের দুই রুমের বাসার রুচিবর্ধনে কর্ত্রী একক কৃতিত্বের দাবিদার। সুতরাং মাস শেষে মজুদ সূচক সেই শূন্যের কোঠাতেই স্থির হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে বংশবৃদ্ধির কথা বললে সহধর্মিণী এক কথায় নাকচ করে দেন। আগে আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি, অনাগত মুখে আহারের নিশ্চয়তা- তারপর ভাবি অথিতিকে সাদরে বরণ। জন্মদানে জায়ার ভূমিকাই মূখ্য, সহধর্মিণীর সচেতন সিদ্ধান্তে মৌণ সম্মতি জানাই।

দরজা খুলে হাতে প্যাকেট দেখে সহধর্মিণীর হাসি দুই কোণায় গিয়ে ঠেকে, “প্রোমোশনটা তাহলে হল?” স্ত্রীর সহাস্য বদন দেখে খুশি হই, যদিও অন্তস্থলে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে- কেন যে এরকম উষ্ণ আপ্যায়ন প্রতিদিন কপালে জোটে না! যাই হোক, মাঝে মাঝেই সই। হাসিমুখে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই। ঘরে ঢুকে আমাকে বসতে দিয়ে সহধর্মিণী প্যাকেট খোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শাড়ির পাড়, জমিন, আরো কি কি সব বিচার করে আমাকে জানান শাড়িটা সুন্দর হয়েছে। মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলেও আমি নিজে ততটা নিঃসংশয় হতে পারিনা। শাড়িটি কিনে ফেরার পথে নীড়ের যতই নিকটবর্তী হচ্ছিলাম মনে নিন্মচাপের সম্ভাবনার পারদ ততই উপরের দিকে উঠছিল। অন্যথা হওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। তবুও একটা খুঁতখুঁতে ভাব মনে থেকেই গেলো।

সহধর্মিণীকে খুশি দেখে আসল কথাটা পেশ করার সাহস করলাম, “আমার কলিগদের কালকে রাতে খাবার দাওয়াত দিয়েছি। আমি নিজে আগে থেকে বলিনি, ওরাই এক রকম জোর করে দাওয়াত নিলো”।

শাড়ি থেকে চোখ না সরিয়ে সহধর্মিণী যা বললেন বুঝলাম তা ভাল সংবাদেরই পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, “ঠিকই তো আছে। তুমি নিজে থেকে কিছু না করলে আরেকজনকে তো বাধ্য হয়েই কাজটা করতে হবে। তোমারই তো নিজে থেকে দেওয়া উচিত ছিল। তাও ভাল যে আজকেই আসার সময় নিয়ে চলে আসোনি”।

এক ফোঁটা লেবুর রস সবসময় বোধহয় এক গ্লাস খাঁটি দুধ নষ্ট করেনা, শুনেছি পশ্চিমারা এই দুইয়ের মিশ্রণে ইয়োগাট নামক এক ধরণের সুস্বাদু খাবার তৈরী করে। যাই হোক, আরেকটি ফাঁড়া কাটলো। সহধর্মিণীর যত্ন-আত্তিতে রাতের খাবার শেষ করে সুখী মানুষের মত করে ঘুমাতে গেলাম।

সারাদিন খাটনির পরও তার নতুন শাড়ি পরে সহধর্মিণী যখন অতিথিদের আপ্যায়ন করছিলেন তখন নিজেকে আক্ষরিক অর্থেই একজন সুখি মানুষ মনে হচ্ছিল। বসার ঘরে সকলের স্থান সংকুলান না হওয়ায় রমণীরা ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। কোনো এক কাজে সহধর্মিণীকে ডাকতে গেলে বাহির থেকে অতিথিদের শাড়ি সম্পর্কিত প্রশংসার প্রেক্ষিতে গিন্নীর বিনয়সূচক গর্ব শুনে খুশি হলাম, অন্তত একটিবারের জন্য হলেও কোনো কিছু কিনে তার অসন্তোষের হেতু হতে হয়নি। রাতের খাবার শেষ করে সহধর্মিণীর অতিথিপরায়ণতা, রন্ধন নিপূণতা ও গৃহস্থালি রুচিশিল্পের প্রশংসা করে অতিথিরা বিদায় জানালেন। পতিগর্ব সহধর্মিণীর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক, উভয় ঔজ্জ্বল্যই শতগুণে বৃদ্ধি করেছে। প্রতিদানে পতিসেবা করে সহধর্মিণী তার পতিভক্তির কথা আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন।

নতুন অফিসে এক মাস পার হয়ে গেছে। সফলদের পথ অনুসরণ করার সুযোগ এখনো হয়ে উঠেনি। আমার যে খুব তাড়া ছিলো তাও নয়। কিন্তু অফিসের কর্তাব্যক্তির বিবাহবার্ষিকী হঠাৎ করেই উপরওয়ালাদের সাথে উঠাবসা করার একটা সুযোগ তৈরী করে দিলো। বর্ষীয়ান দম্পতি তাদের বিশেষ দিন সকলের সাথে উপভোগ করার জন্য আমাদের সবাইকে সপরিবারে দাওয়াত করলেন। এ ধরণের নিমন্ত্রণ সাধারণত আমি এড়িয়ে চলি। কিন্তু উপরওয়ালা বলে কথা, গিন্নী সহকারে উপস্থিত হবার প্রতিশ্রুতি তাকে দিতেই হল।

সহধর্মিণীকে নিমন্ত্রণের কথা বলতেই তিনি একটু বিচলিত হন। তৎক্ষণাৎ শাড়ি নির্বাচনে ব্যকুল হয়ে পড়েন। সব সম্ভাবনা যাচাই করে নতুন শাড়িটিতেই তার চক্ষুজোড়া স্থির হয়। সমস্যা ছিলো ম্যাচিং করা, আর সকল মহীয়ষী নারীর মত সেটা তাকেও রুখে দিতে পারলো না। পরের দিনই তিনি সমস্যার সমাধানে সফল হন।

নিমন্ত্রণটা ছিল উপরওয়ালার বাসভবনে। সহধর্মিণীসহ যথা সময়েই উপস্থিত হই। নতুন সদস্য পেয়ে নারীকুল অর্ধাঙ্গিনীকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যান। আমিও ঘুরেফিরে পুরুষদের আলোচনায় যেয়ে যোগদান করি। দফতর সম্পর্কিত ও অন্যান্য খুচরো কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ি, ভাবি তিনিও নতুন ভগিনীদের সাথে ভাল সময় কাটাচ্ছেন। রাতে খাবার সময় আমাদের পুনর্মিলন হয়। কিন্তু সহধর্মিণীর মেজাজমর্জি খুব ভাল ঠেকে না। ভাবি ঝঞ্ঝার আশংকায় আমার আহারের রুচি পুরোমাত্রায় লোপ পায়।

ফেরার পথ কালবৈশাখীর পূর্বমুহূর্তের মতই থমথমে। নিরাপদ আশ্রয়কামী পথিকের মত ঘরে ফেরার তাগিদ অনুভব করি। ঘরে ফিরে ভাবি কালো মেঘে দমকা হাওয়া লাগলে হয়ত মেঘ কাটতে পারে। কিন্তু সাইমুমে বাতাস লাগলে তার প্রভাব হয় তীব্রতর। সহধর্মিণীর মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য তার সন্ধ্যা কেমন কাটলো তা জিজ্ঞেস করতেই তিনি ফেটে পড়েন, “ভাল কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে আগে ভাল কিছু জামা-কাপড় কিনে দিতে হয়”।

“কেন? এই শাড়িটা তো তোমার অনেক পছন্দ ছিলো”।

“এইটা ভাল শাড়ি?”

“তুমিই তো বলেছিলা যে শাড়িটা অনেক সুন্দর”।

“সুন্দর? সুন্দর শাড়ি কাকে বলে তুমি তা জানো?”

কি বলতে কি বলে ফেলবো তাই নিরবতাকেই মোক্ষম ঢাল হিসেবে বেছে নেই। কিন্তু তিনি ছাড়ার পাত্রী নন, “মিসেস চৌধুরীর শাড়িটা দেখেছো? ওটাকে সুন্দর শাড়ি বলে। দামও এটার চেয়ে খুব বেশী না। আর কিনবাই যখন আমাকে নিয়ে গেলেই তো হত। নিজে মাতব্বরি করে টাকা দিয়ে কি সব যে কিনে আনে”।

সহধর্মিণীর অসন্তোষ শুধু শাড়ি সম্পর্কিত নালিশেই সীমাবদ্ধ থাকেনা। সুযোগ্য এ মুহূর্তকে তিনি অন্যান্য দাবি পেশেরও কাজে লাগান, “ভেবেছিলাম তোমার বেতন বেড়েছে এখন একটা বড় বাসায় উঠা হবে। এই ছোট বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসে। তোমার তো সেদিকে খেয়াল নেই। খালি খাওয়া আর ঘুমানোর জায়গা হলেই তো তোমার হয়ে যায়। আর কয়েকদিন পর তো আরেকটা রুম লাগবে, সেদিকেও তো তোমার কোনো খেয়াল নেই”।

অবাক হয়ে বলি, “তুমি তো আমাকে কিছু বলনি”।

“তুমি যদি চোখ থেকেও না দেখো তাহলে আমি কি করতে পারি? সব কি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে নাকি? অবশ্য তোমার কাছে আর কি বা আশা করা যায়?’ কথা বলতে বলতে সহধর্মিণী অন্যদিক ফিরে ঘুমিয়ে যান।

৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×