বিশেষ দ্রষ্টব্যঃএই গল্প পুরোটাই কাল্পনিক।বাস্তবের কোনো কিছুরই সাথে এর মিল থাকার কথা নয়,আর মিল পাওয়া গেলেও সেটা কাকতাল ছাড়া আর কিছুই নয়।
দায় স্বীকারঃ লেখায় বানান ভুল থাকলে লেখক ক্ষমাপ্রার্থী
অংশ ১৩ (ফ্ল্যাশব্যাক ৪)
পরের দিনের সকাল। মির্জা শাব্বির খুব সকাল সকাল উঠে বেরিয়ে পড়ল তার গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য। তিন বছর পর আবার প্রাণভরে সে তার গ্রাম ঘুরে দেখবে আবার সেই আগের মত। এই গ্রামেই তো তার বেড়ে উঠা, কত শৈশব স্মৃতি। গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় শাব্বিরের ধীরে ধীরে পুরনো দিনের সব কথা মনে পড়ে যেতে লাগল। শাব্বিরের মন উদাস হয়ে গেল। সকালের মিষ্টি রোদের নিচে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে হিমেল হাওয়ার সঙ্গী হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ও চলে এল মির্জাগঞ্জের সবচেয়ে বড দীঘির এক পাড়ে। দীঘির অন্য পাড়ে সুবিশাল সবুজের সমারোহ, বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ। শাব্বির দেখতে পেল যে মাঠে কয়েকজন কৃ্ষক কাজ করছে ঐ সময়। দূর থেকে দেখাতে কৃ্ষকদেরকে ছোট পিপীলিকার মত মনে হচ্ছিল। হিমেল হাওয়া তখনও বয়ে যাচ্ছিল। মির্জাগঞ্জের এটাই হল সবচেয়ে ভাল দিক যে সেখানে সবসময় হাওয়া-বাতাস লেগেয় থাকে। তাই তো গরমের উত্তাপ এখানে অনেক কম। চারদিকের সবুজ গাছ-গাছালি থাকাতে এখানকার আবহাওয়া অনেক সহনীয়। তিন বছর লন্ডনের স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় থাকার পর আজ সতেজ আবহাওয়ার সংস্পর্শে এসে শাব্বিরের মন আনন্দে নেচে উঠল। দীঘির পাড়ে ও বসে পড়ল, দীঘির স্বচ্ছ পানিতে নিজের প্রতিছায়ার সাথে শাব্বির মনে মনে কথা বলতে লাগল। মুক্ত মনের আনন্দে আর নিজ পরিবেশে আবার ফিরে আসতে পেরে ও মনের অজান্তেই গান গাওয়া শুরু করল। শাব্বিরের গানের গলা বেশ ভাল। মির্জাগঞ্জের প্রতি বছরের বৈশাখীর মেলায় বটতলাতে ওর গাওয়া গান শুনতে অনেকেই ছুটে আসত। শাব্বিরের গানের সুরের সাথে পাখিরাও একাত্ম হয়ে কিচিরমিচির করা শুরু করল। মনে হচ্ছিল যে শাব্বিরের মনের আনন্দের সাথে প্রকৃ্তিও একাকার হয়ে গেছে।
শাব্বিরের গান গাওয়া শেষ হলে ও পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে এক মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির চোখে-মুখে সরলতার ছাপ। দেখতেও সুন্দরী। মেয়েটিকে দেখে শাব্বির একটু লজ্জা পেয়ে গেল। নিশ্চয়ই মেয়েটি ওর গান শুনেছে, না জানি গান শুনে কি মনে করেছে! মেয়েটির হাতে ছিল এক মাটির কলস, দীঘি থেকে পানি তুলতে এসেছিল মেয়েটি। মেয়েটি কিছুক্ষণ শাব্বিরের দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কিছু বলল না। শাব্বিরও বলার মত কিছু পেল না। মেয়েটি কলস নিয়ে দীঘিতে নেমে পড়ল, কলসে পানি ভরে কলস নিয়ে উপরে উঠে এল, তারপর অন্যদিকে ফিরে চলে যেতে লাগল। শাব্বির মেয়েটির পানি তোলার কায়দা, মেয়েটির হেঁটে যাওয়া আর চাহনিতে মুগ্ধ হয়ে গেল। এক অন্যরকম ভাল লাগা তৈরি হল শাব্বিরের মনে ঐ অচেনা মেয়েটির জন্য। তিন বছর ধরে লন্ডনে থেকে অনেক মেয়েকেই দেখেছে শাব্বির, কিন্তু কাউকে তেমন ভাল লাগেনি। তবে আজ এই সরল-সুন্দর মেয়েটিকে ওর ভাল লেগে গেল।
মেয়েটি কিছুদূর যেতেই হঠাৎ ওর হাত থেকে মাটির কলস ধপাস করে মাটিতে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে গেল। শাব্বির মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেল। মেয়েটির চোখে-মুখে বির্মষ একটা ভাব। দীঘি থেকে পানি তুলতেও তো কষ্ট লাগে, ওর এখন সেই কষ্ট বৃথা গেল। শাব্বির আগ বাড়িয়ে কথা বলা শুরু করল।
“ কলসটা ভেঙ্গে গেল? আপনি মন খারাপ করবেন না, সামান্য একটা কলসই তো ভেঙ্গেছে।”
“আপনি তো বড়লোক জমিদারের ছেলে, তাই এই একটা মাটির কলসকে আপনার সামান্য মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার জন্য তা সামান্য নয়। আমাদের বাসার একমাত্র কলস ছিল এটি। বাসায় সবাই বসে আছে পানির জন্য। আমি কলসে করে পানি নিয়ে গেলে তা দিয়ে মা নাস্তা বানাবেন, ছোট ভাই হাত মুখ ধুয়ে স্কুলে যাবে আর বাবা লেবুর শরবত খাবেন। এখন তো তা সম্ভব হবে না।” মেয়েটির প্রতি উত্তর।
মেয়েটির কথা শুনে শাব্বির বুঝতে পারল যে মেয়েটির পরিবার অতটা স্বচ্ছল নয় এবং মেয়েটির কথা শুনে ওর কেমন জানি খারাপও লাগল।
“ঠিক আছে, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আপনার পানির ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। আপনি আসুন আমার সাথে।”
“কোথায়?”
“সপ্নপুরীতে”
“ওখানে কেন?”
“আপনার জন্য পানির ব্যবস্থা হবে”
মেয়েটি একটু ইতস্তত বোধ করল। শাব্বির মেয়েটিকে বোঝানোর চেষ্টা করল।
“আপনিই বলছেন আমি জমিদারের ছেলে, তাই না? জমিদার বংশের একজন সদস্য হিসেবে আমাদের এলাকার কার কি লাগবে সেটা দেখার দায়িত্ব আমারও আছে। আপনার এখন পানি লাগবে। তাই আপনি আমার সাথে সপ্নপুরী চলুন, ওখানে আপনার আর আপনার পরিবারের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হবে। এতে আপনার মায়ের নাস্তা বানানো, ছোট ভাইয়ের হাত-মুখ ধোয়া আর বাবার লেবুর শরবত পান করা ব্যাহত হবে না। আর আপনি ভাবছেন যে আপনি সামান্য একজন গ্রামবাসি, আপনি কিভাবে সপ্নপুরীতে যাবেন, তাই না? তাহলে শুনে রাখুন সপ্নপুরীর দরজা সকল মির্জাগঞ্জবাসির জন্য সবসময় খোলা থাকে এবং থাকবেও। এবার আপনি চলুন আমার সাথে, ও আচ্ছা এতক্ষণ কথা হল, কিন্তু আপনার নাম জানা হল না।”
“আমার নাম দিয়ে কি করবেন?”
“না মানে, আপনি সপ্নপুরী যাবেন, সেখানে গেলে আমার মায়ের সাথে আপনার দেখা হবে, আর মা যদি জিজ্ঞেস করে বসে আপনি কে? তখন আমি কি বলব?”
“বলবেন যে আপনার সাথে রত্না এসেছে।”
“ও আচ্ছা, তাহলে আপনার নাম রত্না। সুন্দর নাম।”
শাব্বির আর রত্না কথা বলতে বলতে রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল।
“আপনি খুব সুন্দর গান করেন, সেটা কি আপনি জানেন? আপনার গানের গলা অনেক ভাল।”
একজন নারী ভক্তের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়ে শাব্বির একটু লজ্জা পেল।
“তাই নাকি? জানতাম না তো।”
“হমম...”
“আচ্ছা আপনি এমনিতে কি করেন?”
“একজন গ্রামের মেয়ে কি করে আপনি জানেন না?”
“তা তো জানি, ওসব কাজ ছাড়া কি আপনি আর কি করেন?”
“হ্যা করি।”
“কি করেন?”
“গ্রামের এতিমদের জন্য স্কুলে শিক্ষকতা করি।”
রত্নার কথা শুনে শাব্বিরের ভাল লাগল। রত্নাও তাহলে ওর মত শিক্ষিত।
“আমি তো মনে করতাম যে গ্রামের মেয়েরা লেখাপড়ায় কিছুটা পিছিয়ে। আর এখানকার মেয়েরা লেখাপড়ার তেমন কোনো সুযোগ পায় না। কিন্তু আপনি তো ব্যতিক্রম। আপনি শিক্ষকতা করছেন, খুব ভাল ও মহৎ কাজ।”
“মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে আপনার ধারণাটা সত্যি। তবে এক্ষেত্রে আমার ভাগ্য ভাল। আমি জানি এখানকার অনেক মেয়েই লেখাপড়া করার সুযোগ পায় না। এই জন্যই তো আমি নিজে শিক্ষিত হয়েছি এবং চেষ্টা করছি অন্যদেরকেও শিক্ষিত করে তুলতে। এতিমদের পড়ানোর পাশাপাশি আমি সপ্তাহে তিন দিন এলাকার নারীদের নিয়ে মজলিসে বসি এবং তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। বেগম রোকেয়া যে পথ এবং আদর্শ তৈরি করে গেছেন, সেটাকে আমি আরো অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।”
রত্নার কথা শুনে শাব্বিরের মনে রত্নার প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হল। মির্জাগঞ্জের মত একটি গ্রামে বসবাস করা সাধারণ এক মেয়ে আধুনিক মনোভাব নিয়ে কথা বলছে, শুনতে শাব্বিরের ভালই লাগছে। রত্নার কথা ওকে প্রতি মুহুর্তে মুগ্ধ করছে।
“খুব ভাল চিন্তাধারা আপনার। আপনার কথা শুনে খুব ভাল লাগল। আপনার এই প্রচেষ্টায় আমিও শামিল হতে চাই। আপনার যখন যা সাহায্য প্রয়োজন হবে আমাকে আপনার পাশে পাবেন সবসময়। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এই মহৎ প্রচেষ্টা শামিল হয়ে আমিও কিছু পুণ্য অর্জন করতে চাই।”
“ঠিক আছে।”
“ধন্যবাদ আপনাকে। আচ্ছা আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড ভাল। আপনি পড়াশোনা করেছেন, অথচ আপনাদের ঘরে পানি তোলার জন্য মাত্র একটি কলস, তাও আবার মাটির? আপনাদের আর্থিক অবস্থা তো ভাল হওয়ার কথা।”
“সবকিছুই ভাল ছিল, কিন্তু একদিন সবকিছু উলট-পালট হয়ে গেল।”
“কিভাবে হল এই অবস্থা?”
“সে এক অন্য কাহিনী, অন্যদিন সময় করে আপনাকে বলব, আজ নয়। এই তো সপ্নপুরীতে এসে গেছি।”
শাব্বির রত্নাকে নিয়ে প্রবেশ করল সপ্নপুরীর ভেতর। শাব্বিরের সাথে একটা মেয়েকে দেখে সবাই থতমত খেয়ে গেল। বেগম হেনা মনে মনে ভাবল বিদেশ থেকে এসেছে ২-৩ দিন হল আর এর মধ্যেই একটা মেয়েকে নিয়ে হাজির তাও সপ্নপুরীতে? লন্ডনের কোনো প্রভাব না তো? মির্জা আলি, মির্জা শাহরিয়ার আর বেগম শিফাও অন্দর মহলের ভেতর থেকে বের হয়ে দরবার হলে চলে এল। সবার চোখে-মুখে প্রশ্ন, কে এই মেয়েটি? শাব্বির বুঝতে পারল ব্যাপারটা। তাই ও নিজেই মুখ খুলল।
“আরে তোমাদের চেহারাতে এত বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন কেন? তোমরা কি ভাবছ এখন সেটা আমি জানি, তোমরা যা ভাবছ সেরকম কিছু হয়নি। এ হল রত্না, আমি যখন সকালে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, তখন দীঘির পাড়ে রত্না এসেছিলেন পানি তুলতে। পানি তোলার পর তার বাসায় যাবার পথে তার হাত থেকে মাটির কলস ভেঙ্গে গেল। ওনার বাসায় পানির খুব দরকার। তাই এখানে নিয়ে এলাম। সপ্নপুরী থেকে পানির ব্যবস্থা করার জন্য, আর কিছু না।” (চলবে)
পরের অংশঃ অংশ ১৪ (ফ্ল্যাশব্যাক ৫)
ঘোষণাঃ গল্পটি ভাল লেগে থাকলে কমেন্ট করতে পারেন, তবে কোনো অপ্রাসঙ্গিক কোনো কমেন্ট করলে লেখক তা মুছে ফেলার অধিকার রাখে।
এই গল্পের আগের অংশগুলো পড়তে চাইলে ফ্রি ই-বুক হিসেবে তা ডাইউনলোড করে নিতে পারেন। ডাউনলোড লিংক পেতে এই পোস্ট দেখুনঃ Click This Link
ব্লগ পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
শারিফ শাব্বির
ইমেইলঃ [email protected]
টুইটারঃ http://www.twitter.com/kliptu
ফেইসবুকঃ http://www.facebook.com/kliptu
গুগল প্রোফাইলঃ http://www.google.com/profiles/sharifshabbir
ইউটিউবঃ http://www.youtube.com/user/sharifshabbir
ওয়েবসাইটঃ
http://bdbuzz.ucoz.net
http://grou.ps/bdlinks
http://kotharbuli.blogspot.com