চোখ মুছে রিকশা ভাড়া মেটালেন। রহমত আলীর নুরানী চেহারা, ষাটের মতো বয়স, তবু তার পেটানো শরীর, ধবধবে ফর্সা গালের রং। মেহেদী মাখা দাড়িগুলো বড় অন্যরকম। তাকে খুব অভিজাত অভিজাত মনে হয়। তবু পুলিশ তাকে বোমাবাজ ভেবে এভাবে তল্লাশি করল। মানুষ দেখলে তো বোঝা যায় না, কে কেমন?
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হলো, তার ধারণা যে সব সময় সঠিক হবে এমন কোনো কথা নেই। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর রাজাকারদের ক্যাম্প সম্পর্কে খবর নিতে তিনি এসবের সামনে দিয়ে কতো হেঁটে বেরিয়েছেন। তাকে তল্লাশি করেও তারা তখন তাকে অর্থাৎ একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরতে পারেনি! কিন্তু স্বাধীন দেশে কেউ কেউ এখন গায়ের সঙ্গে বোমা বেঁধে মানুষ মারে। তাদের তো ধরাই উচিত। নাকি?
হাঁটতে হাঁটতে রহমত আলীর অনেক কিছুই মনে পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় টমাস আলভা এডিসনের শিক্ষকরা তাঁর রেজাল্টশিটে লিখে দিয়েছিলেন, মাথা মোটা। একে দিয়ে কিছু হবে না। সে যেন আর স্কুলে না আসে! অথচ সেই টমাস আলভা এডিসনের আবিস্কার মানবসভ্যতার জন্য খুব বেশি জরুরি ছিল। যারা বোমা মেরে মানুষ মারছে, আগে তাদের দেখে হয়তো পজেটিভ ধারণাই হতো। অথচ এখন তারা দেশ ও জাতির জন্য পুরো নেগেটিভ কাজই করছে। পৃথিবীটা কি বদলে গেল?
ছোটকালে পড়া আরো একটি জিনিস মনে পড়লো রহমত আলীর। আব্রাহাম লিংকনের বাবা ছিলেন দিনমজুর। কিস্টোফার কলম্বাসের বাবা ছিলেন তাঁতী। গ্রিক কবি সফোকিসের বাবা ছিলেন কর্মকার। শেক্সপিয়রের বাবা ছিলেন সামান্য পশম ব্যবসায়ী। কিন্তু এসব 'সামান্য' বাবাদের ছেলেরা হয়েছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত 'অসামান্য' ব্যক্তিত্ব। অর্থাৎ জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো। কাদের ছেলেরা আজ বোমা মারছে? শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল পাশার বাবার মতো একজনও কি নেই যিনি তার বোমাবাজ ছেলেকে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন? হঠাৎ তার মনে হলো অভাবগ্রস্ত পিতার অভাবী সন্তান, হীনম্মন্যতায় ভুগে ভুগে কিছু টাকার জন্য না হয় এমন হলোই। কিন্তু যারা এসব বোমাবাজদের গডফাদার, তারা তো অভাবী নন! তারা কেন মদদ দিচ্ছেন? রহমত আলীর সামনে পুরনো জিজ্ঞাসাটাও ফিরে এলো। সৌদি ধনকুবেরদের একজন যিনি কিনা হাভার্ডে লেখাপড়া করেছেন, যিনি এক সময় ছিলেন আমেরিকার আজ্ঞাবহ একজন, সেই লাদেন কেন পৃথিবীজুড়ে মুসলমানদের এমন বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিলেন? এছাড়া ইরাক, আফগানিস্তান আর বাংলাদেশ তো এক নয়। তবু কারা বাংলাদেশকে আজ ইরাক কিংবা আফগানিস্তান বানাতে চাচ্ছে?
সোনারগাঁও হোটেলের উল্টো পাশে এসে একটু দাঁড়ালেন রহমত আলী। বয়স হয়ে যাচ্ছে। একনাগাড়ে বেশিক্ষণ হাঁটতে পারেন না তিনি। তার সামনে পেপার বিক্রি হচ্ছে। বেশিরভাগ পত্রিকা শিরোনাম করেছে সংলাপ বিষয়ক চিঠিকে ঘিরে। একটি পত্রিকার শিরোনাম এমন_চিঠি এলো, ফিরে গেল! হায়, রহমত আলীর লেখা প্রথম চিঠিটার কথা মনে পড়ে গেল। যাকে দিয়েছিলেন, সে চিঠিটা নেয়নি! এত বেশি অভিমান হয়েছিল তার। এভাবে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারল মেয়েটি? মেয়েটি সব সময় বোরকা পরে কলেজে আসা-যাওয়া করত। যদিও তার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে রহমত আলীর। বিয়ের আগেই একবার মেয়েটিকে দেখার খায়েশ হয়েছিল তার। মেয়েটি যখন নিজের বাড়ির পুকুরে গোছল করতে নামল এক দুপুরে, তাকে দেখার জন্য রহমত আলী নারিকেল গাছে উঠে পড়লেন। অতীব উত্তেজনায় রহমত আলী গাছে থাকতে পারেননি। ধপাস করে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। অতঃপর ভাঙা পা নিয়ে পলায়ন এবং ডান পায়ে প্লাস্টার থাকা অবস্তাতেই তার বিয়ে হয়েছিল। নিজের অজান্তেই তার হাতটা চলে গেল ডান পার দিকে। পরম মমতায় তিনি সেখানে হাত বুলালেন। এরপর পান্থপথের দিকে হাঁটা শুরু করলেন।
তবে পত্রিকার ব্যাপারটা তার মাথা থেকে গেল না। সংলাপের পরে জঙ্গি আর বোমা বিষয়ক খবর সারা পত্রিকা জুড়ে। আরো আছে টেলিফোনে আড়ি পাতার খবর। আইন হচ্ছে সন্দেহভাজন যেকারো টেলিফোনে এখন থেকে নাকি আড়িপাতা যাবে! শাস্তি কমিয়ে আনতে এরশাদ সাহেবের এক বিচারককে ঘুষ দেয়ার সেই টেলিফোন সংলাপ এদেশের ক্যাসেট কেলেঙ্কারি নামেই পরিচিতি পেয়েছিল। আমেরিকাতে প্রথম যখন টেলিফোনে আড়িপাতা আইন চালু হয় তখন 'প্রাইভেসি গেল, প্রাইভেসি গেল' বলে রব উঠেছিল। তখন যে কৌতুকটা ছড়িয়ে পড়েছিল তা এমন_তিনফুট উচ্চতার এক বামন তার চেয়েও উচ্চতায় ছোট তার প্রেমিকাকে টেলিফোনে বলল_বেশি তেড়িবেড়ি করবে না বলে দিচ্ছি। আমি রাগলে কিন্তু এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংটাকে গুঁড়িয়ে দিতে পারি। কিছুক্ষণ পরেই সেখানে হাজির হলো এফবিআই কর্মকর্তারা। বামন তাদের পায়ের নিচ থেকে দৌড়ে পালাতে লাগল। ধরা পড়ার পর বামন বলেছিল, আসলে আমি আমার প্রেমিকার কাছে ভাব নিচ্ছিলাম। এত সোজা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং ধ্বংস করা? যদি কেউ করেও তাহলে টেলিফোন করে সেটা কেউ কাউকে জানাবে না। সে যাই হোক, বামনের প্রেমিকা সেদিন তড়িঘড়ি করে ছুটে গিয়েছিল। দেখল এফবিআই কর্মকর্তারা বামনকে ছেড়ে দিচ্ছে। প্রেমিকা জানতে চাইলো, ওনারা কী বললেন? বামন প্রেমিক পুনরায় ভাব নিয়ে বলল ওনারা আমাকে হাত জোড় করে অনুরোধ করলেন আমি যেন স্টেট বিল্ডিংটা গুঁড়িয়ে না দিই! তোমার দিকে চেয়ে আমি তাদের কথা দিয়ে এলাম!
রহমত আলী বাস্তবে ফিরে এলেন। আসলে শরীর ঠিক রাখতেই তিনি এখন হাঁটাহাঁটিটা নিয়মিত করেন। বাসার খুব কাছাকাছি এসে তার সেই দুঃখটা আবার ফিরে এলো। এভাবে তল্লাশি করা হলো তাকে। তিনি একটা জিনিস ভেবে পেলেন না। এই যে প্রধানমন্ত্রী চিঠি পাঠালেন আর বিরোধীদলীয় নেত্রী গ্রহণ করলেন না, এটা কোন ধরনের রাজনীতি। গত আওয়ামী লীগ আমলে অন্তত আটটি বড় ধরনের বোমা হামলার ঘটনায় পঞ্চাশের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। সে সময় বোমা হামলার হোতাদের ধরা যায়নি। কারো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হয়নি, জনগণ তাই ভুল বুঝেছিল সেই সরকারকে। গত আমলের চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর বোমা হামলার ঘটনা এই আমলে ঘটছে। কিন্তু ধরা পড়ছে না মুল হোতারা, কেউ পাচ্ছে না দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তাহলে? জনগণ কী এবারো ভুল বুঝবে না সরকারকে? বোমা হামলার হোতাদের আড়ালে রাখার এ কোন রাজনীতি?
রহমত আলী বাসায় ঢুকলেন। তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতা ঘুমুচ্ছে। পরম মমতায় তিনি মমতার কপালে হাত রাখলেন। মুহুর্তেই জেগে উঠলেন মমতা। অাঁতকে উঠলেন রহমত আলীও। মমতার পাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা বেড়ালটাও লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দৌড় দিল। রহমত আলীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তিনি বললেন, তোমাকে না কতদিন বলেছি, এসব ইতর জীবদের নিয়ে বিছানায় ঘুমাবা না?
মমতা হাই তুলে উত্তর দিলেন, তুমি না পশু প্রেমিক? তুমি না এক সময় কুকুর আর বানর পালতে? তুমি যদি ঘুমুতে এসে দেখ বানর বা বেড়াল বিছানায় ঘুমিয়ে আছে, তাহলে তো সেটা তাড়ানোর দায়িত্ব তোমার? নাকি?
রহমত আলীর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। তার তখনই মনে পড়ল, ঢোল আর বানরকে রাখতে হয় মাইরের ওপর। যারা ইসলামের নামে বোমা ছুড়ে মানুষ মারে, যারা মানুষ হত্যা করে বেহেশতে যেতে চায়, সেই সব বানরদের রাখতে হবে মাইরের ওপর। কারা তাদের প্রশ্রয় দেয়?
রহমত আলীর মন খারাপ দেখে মুখ খুললেন মমতা। বললেন, স্বপ্নেদেখছিলাম পঙিখরাজে চড়ে এক রাজকুমার আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি মুগ্ধ হয়ে জানতে চেয়েছিলাম রাজকুমার তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? রাজকুমার উত্তর দিয়েছিল স্বপ্নটাতো তোমার। তোমার স্বপ্নআমি ধরা দিয়েছি। এবার আমাকেই বলে দাও তোমাকে নিয়ে আমার কোথায় যেতে হবে? এর মধ্যে ঘুম ভেঙে দেখি তুমি।
রহমত আলী তার লেখার টেবিলে বসলেন। তিনি চিঠি লিখবেন। দুই নেত্রীর কাছে। যদি তার চিঠি কেউ নাও পড়ে, তাহলে তিনি সেটা জনে জনে পেঁৗছে দেবেন। এখনও তো তার মতো অন্তত একলাখ মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছে। তারা অস্ত্র জমা দিয়েছে, ট্রেনিং জমা দেয়নি। তারা আবার রুখে দাঁড়াবে। ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া প্রধান দুই নেত্রীর না হয় আর কোনো স্বপ্ন নেই। কিন্তু যে পোষা বানররা দেশের সব সম্ভাবনাকে বোমাবিদ্ধ করে ছাড়ছে তাদের শাস্তি দিয়ে দেশটাকে কাঙ্খিত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন তো রহমত আলীর মতো আরো অনেকেরই আছে।
রহমত আলী তার স্বপ্নমাখা চিঠিটা লিখতে শুরু করলেন। মমতা তার চশমাটা এগিয়ে দিতে এসে বলল_দেশের স্বার্থে দুই নেত্রীর এক হওয়ার স্বপ্নটা তুমি ছড়িয়ে দাও। মানুষকে সেই পুরনো ছড়াটা মনে করিয়ে দাও_কেউ বলে খালেদা কেউ বলে হাসিনা/দুই ভাগে ভাগ হওয়া মোটে ভালো বাসি না!