আসসালামু আলাইকুম,
ফেব্রুয়ারি মাস আসিলেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দরদ নানাভাবে নানা জায়গায় উপচাইয়া পড়িতে থাকে। সেই দরদ সরকারের কর্তাব্যক্তিগণের ভিতরও যেমন দেখা যায় তেমনি দেশের নানা শ্রেণীর ভিতরেও। তবে এই দেশের (হয়তো বা সবদেশেই)উচ্চ শ্রেণীর মানুষের ভিতর যেহেতু কথায় আর কাজে গরমিলটা বেশি দেখা যায় ভাষা নিয়াও সেই গরমিল দেখিতে বেশি বেগ পাইতে হয় না।
ভাষার মাস আসিলেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর উপর জোর দেওয়া হইয়া থাকে। কিন্তু আফশোশের বিষয় এই যে আজ পর্যন্ত এমন চাকুরির বিজ্ঞাপন দেখিলাম না যেখানে বলা হইয়াছে : 'ভালো বাংলা জানা/ ভালো বাংলা লিখিতে পারা/' প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হইবে।
এই হইতেছে আমাদের ভাষা-প্রীতির নমুনা!!!
২. একুশে ফেব্রুয়ারির বইমেলার উদ্বোধনী দিনে বিটিভি-র সৌজন্যে আমরা নোবেল-জয়ী অমর্ত্য সেনের নিকট হইতে অনেক ভালো-ভালো কথা শুনিলাম। তিনি বাংলা ভাষা নিয়াও অনেক বড়ো-বড়ো কথা কহিয়াছেন। তাহার সব কথা বুঝিতে না পারিলেও একটা জিনিস বুঝিতে বাকী ছিলো না যে তিনিও বাংলার চাহিতে ইংরেজিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিয়া থাকেন। তাহার পাশে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। বাংলা ভাষা নিয়া তিনিও কম কথা কহেন নাই। আমরা সেইসব কথা শুনিয়া অনেক জ্ঞান অর্জন করিলাম।
৩. সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন---এই কথাটির অর্থ কেহ কি আমাকে বুঝাইয়া দিতে পারিবেন? উহার অর্থ কি এইটা যে বক্তৃতায় এক কথা আর কাজের বেলায় ভিন্ন কথা? নাকি তাহার অর্থ এইটাও যে গ্রাম-বাংলার রহিম-করিমের পুত্রকন্যাগণ বাংলা শিখিয়া ভালো চাকুরি না পাইয়া কোনোমতে জীবন কাটাইবে বা না খাইয়া মরিবে আর শহরের সাহেবদিগের পুত্রকন্যাগণ ইংরাজি শিখিয়া চাকুরি বাগাইয়া খোশ মেজাজে জীবন কাটাইবে?
৪. সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। পকথাটি শুনিতে বেশ লাগে। এই সর্বস্তরটা কোন্ কোন্ স্তর---তাহা সরকার যদি খোলাসা করিয়া কহিতেন--তবে জনগণের উপকার হইতো। কেননা ৬৬ মহাখালি বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা----এই ঠিকানাটি কি বাংলাদেশের বাহিরে? কেন এই প্রশ্ন? এইখানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা-জমিন-ক্যাম্পাস। এই দেশে ব্র্যাকের ব্যবসা দিন-দিন উন্নিতর দিকে। কাজেই তাহার শিক্ষার ব্যবসা মন্দ যাইতেছে---এইটি ব্র্যাকের শত্রুও কহিতে পারিবে না। সেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ''সমাবর্তন'' অনুষ্ঠান হইয়া গিয়াছে গত ৭ ই ফেব্রুয়ারি তারিখে। সেই উপলক্ষে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী হইতে শুরু করিয়া ''স্যার'' উপাধি-পাওয়া ব্র্যাকের ''হর্তা-কর্তা বিধাতা'' শ্রদ্ধেয় ফজলে হোসেন আবেদও বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে তাহাদের অমূল্য বাণী প্রকাশ করিয়াছেন।
৫.এইটা ভাষার মাস। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করিবার মাস। ব্র্যাকের সমাবর্তন উপলক্ষে প্রকাশিত সেই বাণীতে দেশের রাষ্ট্রপতি কহিয়াছেন :
''I am delighted to learn that BRAC University is observing......''
একটু হোচট খাইতে হইলো। কেননা এইটা কি ১৯৫২ সালের ভাষা-শহীদগণের ভাষা?
দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কহিয়াছেন :
''I am happy to learn that BRAC......''
উনি ১ লা ফেব্রুয়ারি বইমেলার বক্তৃতায় কি কহিলেন আর কাজের বেলায় কি করিলেন!!!
দেশের শিক্ষামন্ত্রীও বেলাইনে যান নাই। তিনিও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া কহিয়াছেন :
''I am pleased to know that BRAC....''
৬.অনেকেই কহিবেন ব্র্যাক-বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশি-বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করিয়া থাকে (আমার অবশ্য জানা নাই কতোজন বিদেশি সেইখানে পড়াশুনা করিয়া থাকেন!) কাজেই ইংরাজিতে ''বাণী'' দিয়া তাহারা সঠিক কাজই করিয়াছেন।তাহা করুন। আমার প্রশ্ন হইতেছে কতোজন বিদেশি সেইখানে পড়াশুনা করিতেছে যে তাহার জন্য ১২ কোটি মানুষের ভাষাকে অগ্রাহ্য করিতে হইবে?
আয়ারল্যাণ্ডের সাবেক রাষ্ট্রপতিও সেই অনুষ্ঠানের জন্য বাণী দিয়াছেন। উনি ইংরাজিতে দিবেন--তাহাতে আপত্তি নাই। কিন্তু উনার জন্য কি দেশের রাষ্ট্রপতি হইতে শুরু করিয়া শিক্ষামন্ত্রী--সকলকেই ইংরাজিতে ''বাণী'' প্রদান করিতে হইবে?
৭.তাহা হইলে যে সর্বস্তরের কথা বলা হইয়া থাকে---সেইটা কোন্ স্তর।আমরা কি তবে কবরবাসী হইয়া সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কায়েম করিবার খোয়াব দেখিতেছি?
পরম করুণাময় আমাদিগকে সহজ সরল পতে অগ্রসর হইবার তাওফিক দিন। সকলে ছহি-ছালামতে থাকিবেন।