আমি একবার এক বিজ্ঞানীর লেখা থেকে জানলাম যে, মহাবিশ্ব বিশৃঙ্খলতাপ্রবণ, মানে ঝামেলার দিকেই ঝোঁক বেশি। আমরা এখন জানি যে, এটা আসলেই এক গভীর বাস্তবতা যা আমাদের গ্রহ এবং মহাকাশের বিশালতাকে নিয়ন্ত্রণ করা আইনগুলির সত্যতা প্রতিপন্ন করে। তবে এটি স্বজ্ঞাতভাবে এমন একটি ধারণা যা আমাদের মধ্যে যে বা যারা শিশুর বিক্ষিপ্ত খেলনা গুছিয়ে রেখেছে বা সুতার গিঁট খুলতে সংগ্রাম করেছে, তাদের কাছে সহজেই স্পষ্ট। কোনো কিছু পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করতে কর্ম সম্পাদন করা লাগে। আর আজকাল, এটা অবশ্যই মনে হচ্ছে যে বিশ্ব একটি জগাখিচুড়ি; মনে হয় যে বিশৃঙ্খলা রাজত্ব করছে, আমাদের দেশে এবং আমাদের সীমানার বাইরে।
সময়ের স্থিরচিত্রগুলোর দিকে তাকানো এবং প্রবণতার দাগগুলি স্পষ্টভাবে দেখা কখনও কখনও কঠিন, তবে বাঙালী সেনাপুলিশদের হাতে আরও আদিবাসী ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের মৃত্যু, একজন সরকারপ্রধানের দ্বারা চরমপন্থী গোষ্ঠীর কাছ থেকে 'বিধর্মী' বিরোধী চক্রান্তের অনাকাঙ্ক্ষিত ধর্মান্ধতার নিকৃষ্টতম ব্যবহার, আমাদের রাস্তায় রাজনৈতিক কর্মীদের সহিংসতা, বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অত্যাধিক সন্ত্রাসী হামলা, এমনকি অনেক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি, এর সবই এমন বিশৃঙ্খলার স্তরের নির্দেশ দেয় যা সমাজের স্থিতিশীলতাকে বিষাক্ত করে। আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে এটি রাজনৈতিক স্থবিরতা ও স্থিতাবস্থার শক্তিশালী প্রবাহ যা নিয়ন্ত্রণে না করলে বা দমন করতে না পারলে আরও খারাপ সময়ের হুমকি দেয়।
সম্প্রতি আমাদের দেশের স্বাধীনতার অর্ধশতক উদযাপনের পর এইভাবে অনুভব করাটা সম্ভবত বিদ্রূপাত্মক। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই সময়টা বঙ্গদেশীয় জামাতী সম্প্রসারণের একটি নির্দিষ্ট বিশৃঙ্খলার চিহ্ন বহন করে, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা/প্রধানের আদর্শই ছিল ভিন্ন অংশের একতা ও শৃঙ্খলা আনয়ন। কিন্তু গোষ্ঠীবদ্ধতার এই মূল নীতিবাক্য 'বহুর একতা' একটি আদর্শ স্থিতিশীলতার কথা বলে, যা আমরা এখন বুঝি, কিছু বাস্তব অর্থেই প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যায়। দেশের প্রতিষ্ঠাকালীন নীতিমালা এমন কিছু শক্তিশালী পৃষ্ঠতলের উপর লেখার প্রচেষ্টা যেগুলি শুরুর দিকের নেতাদের দুর্দান্ত পরীক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর ব্যবধান স্বচ্ছ করে দেয়, বিশেষত উত্তরাধিকারে পাওয়া ধর্ম এবং জাতের রক্তে রঞ্জিত রাজনীতি। এটি ১৯৭৫-এর মাধ্যমে আমাদের জাতীয়তাবাদী গল্পের জন্য প্রায় মারাত্মক প্রমাণিত হয়েছিল, আর এটি এমন একটি বিষয় যার উপর আমরা কখনই পুরোপুরি প্রায়শ্চিত্ত করিনি। শিরোনামগুলি প্রায় প্রতিদিন আমাদের দেখাতে থাকে যে, এটি একটি ঋণ যা এখনও আমাদের তাড়িত করে।
যাইহোক, বিশৃঙ্খলার মুখে নিজেদের শক্তিহীন বলে ভাবাটা খুব হতাশাবাদী এবং অদৃষ্টবাদী। হয়তো আমরা মহাবিশ্বের সবগুলো স্তরের সমীকরণ পরিবর্তন করতে পারি না, তবে আমরা আমাদের নিজেদের জীবন এবং আমাদের আশেপাশের সম্প্রদায়ের উন্নতি করতে পারি। আমাদের ইতিহাসের বইয়ে আজ আমরা যে নায়কদের প্রশংসা করি তাদের বেশিরভাগই পুরুষ এবং অল্পকিছু মহিলা, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়ে বলতে পারতো যে, কাজ কঠিন হতে পারে, আর ব্যক্তিগত পুরষ্কারও অনিশ্চিত, কিন্তু আমরা মানি যে আমাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে বিশ্বকে আরও ভাল জায়গা বানানো সম্ভব। সময় এবং স্থানের মধ্য দিয়ে মানুষ ও মহাকালের যাত্রাটা দেখার জন্য মার্টিন লুথার কিং-এর নিজস্ব সমীকরণটা অবশ্য একটু অন্যরকম: 'নৈতিক মহাবিশ্বের বক্ররেখাটা দীর্ঘ, তবে এটি ন্যায়বিচারের দিকেই বাঁকানো।'
আমি এই আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটা গ্রহণ করার জন্য বেছে নিয়েছি এবং আপনাদেরও একই কাজ করতে বলছি। প্রকাশ্যে এই বিবৃতি শুধুমাত্র শুরু। আমাদের যা দরকার তা হল বিশৃঙ্খলার জোয়ার ফিরিয়ে আনার জন্য প্রবৃত্তি, কাজ। এটি ভোট দেওয়ার মতো সহজ একটি কাজ হতে পারে, বা আরও টেকসই প্রচেষ্টা হতে পারে, যেমন শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য প্রকৃত আন্দোলনকারী গোষ্ঠীগুলিতে যোগদান ও সমর্থন করা। যা গ্রহণযোগ্য নয় তা হলো, আমাদের মুখোমুখি হওয়া বাস্তবতা এবং অন্তরায়গুলিকে উপেক্ষা করা।
সম্ভবত প্রয়াত এলি উইজেলের নোবেল শান্তি পুরস্কারের বক্তৃতার উল্লেখ করে এই লেখাটা শেষ করা ভাল। তার বিজয়ী পূর্বসূরী ডঃ কিং এর মত, উইজেল নৈতিক মহাবিশ্বের নিজস্ব মানচিত্র আঁকতে এবং বিশৃঙ্খলার মোকাবিলা করার জন্য আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দায়িত্বকেই উপযুক্ত প্রতিরক্ষা বলে মনে করেন।
আমাদের অবশ্যই পক্ষ নিতে হবে। নিরপেক্ষতা নিপীড়ককেই সাহায্য করে, কখনোই নিপীড়িতকে নয়। নীরবতা যন্ত্রণা-প্রদানকেই উৎসাহিত করে, কখনোই যন্ত্রণা-প্রশমন করে না। কখনো কখনো আমাদেরকে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে। যখন মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, যখন মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, তখন জাতীয় সীমানা এবং সংবেদনশীলতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। যেখানেই মানুষ তাদের জাতি, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নির্যাতিত হয়, সেই স্থানটি অবশ্যই, সেই মুহূর্তে, মহাবিশ্বের কেন্দ্র হয়ে উঠা উচিত।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪২