নারী নির্যাতনের কথা শুনলেই আমরা অনেকটা মধ্যযুগীয় কায়দায় একতরফাভাবে পুরুষ ব্যাক্তিটিকে দায়ী করে থাকি। সেটা যে কোন ধরণের নারী নির্যাতনের কথায়ই হোক না কেন। ঘরে বা পরিবারে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলাই হোক আর রাস্তাঘাটে বখাটে ছেলে কর্তৃক ঈভ টিজিং-এর ঘটনাই হোক—এজাতীয় যে কোন ঘটনা ঘটলেই আমরা মোটামুটিভাবে মনে মনে হলেও ঐ দায়ী পুরুষ ব্যাক্তিটির Fourteen Generations উদ্ধার করে থাকি। আমি প্রকৃপক্ষে কোন অবস্থাতেই কোন অপরাধীর পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করছিনা বরং এ জাতীয় ঘটনায় পুরুষ ব্যাক্তিটি যদি দায়ী হয়ে থাকে তাহলে তা’ জঘন্য অপরাধ এবং তার উপযুক্ত দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হওয়া আবশ্যক; যেন এ ধরণের অপকর্ম ঘটানোর আগে এর শাস্তির কথা ভেবে আর কোন ব্যাক্তির আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার যোগাড় হয়। আমি শুধুমাত্র যে দিকটির উপর সচেতন পাঠকের দৃষ্টি নিবদ্ধ করাতে চাচ্ছি, এই লেখাটির শেষাংশ পর্যন্ত গেলেই তার স্বরুপ বের হয়ে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের এই মুসলিম দেশটিতে ঈভ টিজিং এর হার এত ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যে এটাকে সেই ইসলাম পূর্ববর্তী আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকারের যুগের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কিছুদিন আগে দেশের একটি অঞ্চলে এই ঈভ টিজিং-এর বিরুদ্ধে আমাদের সম্মানিত মা-বোনদের আন্দোলন পর্যন্ত করতে হয়েছে—জাতি হিসেবে এর থেকে লজ্জার আর ঘৃনার কিছু আছে বলে আমি মনে করিনা। যাইহোক, তবে সকল ঘটনার জন্য কি কেবল পুরুষই দায়ী? এর জন্য নারীর কি কোন দায়বদ্ধতা নেই? যে অপমানের যন্ত্রনা সইতে না পেরে নারী আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে সেই অপমানের জন্য সে নিজেও কি কখনো দায়ী হতে পারে? মুদ্রার উল্টোপিঠের এই দিকটি নিয়ে ভাববার সুযোগই হয়তো আমাদের নেই। নারীরা আমাদের কাছে যেন দুধে ধোয়া তুলসী পাতা। আর মিডিয়া তো আছেই। তাই, কিছু ঘটলেই বিনা বিচারে আমরা পুরুষ ব্যাক্তিটিকে দায়ী করে থাকি আর তার শাস্তির দাবীতে মিছিল মিটিং করতে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়ি; কখনো কখনো হয়তো প্রকৃত ঘটনায়ই আমরা জানিনা।
নারী সৌন্দর্য্যময়ী। একটা বিশেষ সময়ে নর-নারী বয়োঃপ্রাপ্ত হয় আর তাদের মধ্যে জন্ম নেয় দূর্নিবার আকর্ষন। নারীর সৌন্দর্য্যে গুনমুগ্ধ হয় প্রেম -পিয়াসী পুরুষ। আর বহুগামীতার বার্তাবাহী নারী নিরবে নির্জনে মিলিত হতে চায় প্রেমাভিসারে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। পৃথিবীতে মানুষ পাঠানোর ব্যাবস্থা হিসেবে আল্লাহ তায়ালা নারী-পুরুষের মিলনকে করেছেন আবশ্যক। আর তাই, তাদের মধ্যকার এই সুতীব্র আকর্ষন যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবমুখী। কিন্তু এর জন্য চাই সমাজসম্মত সুস্থ সুন্দর বিধান। নারীর দৈহিক সৌন্দর্য্যের প্রতি পুরুষের আকর্ষন তীব্র ভাবাবেগ সম্পন্ন। এই সময়ে নারী-পুরুষের মনে একে অপরে সান্নিধ্য পাওয়ার বাসনায় নানা ধরনের কু-চিন্তা প্রকট হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে আমাদের সমাজের নারীরা তাদের যথাযথ সম্মানের কথা ভুলে গিয়ে পুরুষের সেই নিষিদ্ধ বাসনাকে প্রলুদ্ধ করতে যেন উঠে পড়ে লেগেছে।
অতি সাম্প্রতিককালে নারীদের পোষাক এত আটোসাঁটো যে সেই পোষাকের মধ্য দিয়ে তাদের দেহের প্রতিটা ভাজ একেবারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পুরুষদেরকে প্রলুদ্ধ করতে এই নারীরা যেন সৌন্দর্য্যের পসরা সাজিয়ে রুপের হাটে বিকিকিনি করতে ব্যাস্ত। এমতাবস্থায় ঈভ-টিজিং বা তার থেকে জঘন্যতর কোন অপরাধের ঘটনা ঘটলে তার জন্য কি কেবল পুরুষই দায়ী? পুরুষের সামনে এমন শরমহীনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য কি নারী বিন্দুমাত্রও দায়ী নয়? আমি আবারও বলছি, নিরীহ নারীর প্রতি নির্যাতনের জন্য পুরুষ এককভাবেই দায়ী। কিন্তু বর্তমান সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নারীকে আর নিরীহ বলা যাচ্ছেনা; বরং তারা পুরুষের একটি বিশেষ অনুভুতির Incentive রুপেই নিজেদেরকে তুলে ধরতে পারাটাকে স্বার্থকতা বলে মনে করে। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-- “হে নবী, আপনি আপনার পত্মীগনকে ও কন্যাগনকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগনকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে, ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবেনা, আল্লাহ পরম দয়ালু (সুরা আল আযাহাব-৫৯)।” আর পুরুষদেরকে সম্পর্কেও আল্লাহ তায়ালা বলেন-- “মুমিনদেরকে বলুন, তার যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে, এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবগত আছেন (সুরা আন নূর-৩০)।”
পাশাপাশি আছে আধুনিকতার নামে বয়স্ক নর-নারীর অবাধে মেলা মেশার সীমাহীন সুযোগ। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গুলো যেন আর শিক্ষাকেন্দ্র নেই, সেগুলো এখন বয়স্ক নর-নারীর অবাধ মেলা মেশার মিলনকেন্দ্র। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো এক ধাপ এগিয়ে। আর সেই সাথে আছে আমাদের বিবেকবর্জিত স্থুল চিন্তাধারার মিডিয়া- হোক তা ইলেক্ট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়া। ফ্যাশন শো’ বা সাজসজ্জার অনুষ্ঠানের নামে এই মিডিয়াই টেনে আনছে বিদেশী অপ-সংস্কৃতি; অথচ দেশের কথা বললেও দেশী সংস্কৃতির বিকাশে এদের কোন মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হয়না। এই সকল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে এক সময়ের মুসলিম ঐতিহ্যধারণকারী নারীরা আজ গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাচ্ছে। ফলস্বরুপ, তাদের উপর নেমে আসছে নিম্নতর অপমানের সুতীব্র যন্ত্রনা। আল্লাহর দেয়া বিধান যদি আজ নারী পুরুষ উভয়েই মেনে চলতো তাহলে আজ নিশ্চয়ই আমাদের মা-বোনদের সম্মান রক্ষার জন্য রাস্তায় নামতে হতোনা।
সর্বশেষ একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে আমি আমার এই লেখাটি শেষ করছি। আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন সুমিদের (ছদ্মনাম ব্যাবহার করছি) এলাকায় মেসে (Mess) থাকতাম। আমি কলেজ ছাত্রী সেই সুমির কথায়ই বলছি যে কয়েক বছর আগে বখাটেদের দ্বারা উত্যক্ত হওয়ার কারণে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দোষী ছেলেগুলোর উপযুক্ত শাস্তিও হয়েছিলো। ছেলেগুলো বখাটে ছিলো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু নেপথ্যের ঘটনার জন্য সুমি নিজেও কি কম দায়ী ছিলো? অবশ্যই না। শুধুমাত্র প্রেমের প্রস্তাব দেয়ার জন্য যদি একটি ছেলের গালে চড় মারতে হয় তাহলে তো পৃথিবী থেকে প্রেম নামক জিনিসটা উঠে যেত। আমার কোন নারীকে ভালো লাগলেই যে সেই নারীর আমাকে ভালো লাগবে এমনটি নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু আমার ভালোবাসার কথা বলার জন্য কি আমাকে চড় খেতে হবে? ঘটনার প্রথম দিকটা কিন্তু এরকমই ছিলো। সুমির দূর্ভাগ্য এই যে সেই ছেলেটি ছিলো বখাটে আর তাই সুমির দেয়া চড়ের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলো যে কোন মুল্যে। আর ঘটনার ধারাবাহিকতায় মৃত্যু হয় সুমির। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে পরবর্তী সকল ঘটনার জন্য ওই ছেলেগুলোই দায়ী। কিন্তু আগুন চাপা না থাকলেও এরকম হাজারো সত্য চাপা থাকে চিরকাল। কেননা এটা যে নারী-নির্যাতনের মামলা!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


