জনাব আবদুর রব শরীফ সাহেবের একটি পোস্ট পড়ে মনে হলো এবিষয়ে আমি কিছু লিখি। উনার পোস্টের শিরনাম যৌবনে চারটি বিয়ে করা কি সুন্নত? । আচ্ছা আসুন দেখি এটা আসলে ফরজ, সুন্নত নাকি নফল ? কোনটা ?
বহুবিবাহ—এই শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। মুসলিম সমাজে এই প্রথা নিয়ে যেমন আলোচনা-সমালোচনা আছে, তেমনি অমুসলিমদের মধ্যেও আছে অনেক ভুল ধারণা। কেউ বলেন এটা পুরুষের আধিপত্যের প্রতীক, আবার কেউ বলেন এটা রাসুলের (সঃ) সুন্নাহ। কিন্তু প্রকৃত সত্য কী?
কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি:
কুরআনের সূরা আন-নিসার ৩ নম্বর আয়াতে বহুবিবাহের উল্লেখ আছে। আল্লাহ বলেন:
وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَىٰ فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا 1 فَوَاحِدَةً أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَلَّا تَعُولُوا 2
"আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, এতীমদের (সম্পদের ব্যাপারে) সুবিচার করতে পারবে না, তবে নারীদের মধ্যে যাদেরকে তোমাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে কর—দুই, তিন বা চার। আর যদি আশঙ্কা কর যে, তোমরা সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে (বিয়ে কর)। এটাই সঙ্গত, যাতে তোমরা সীমালঙ্ঘন না কর।" (সূরা আন-নিসা: ৩)
এই আয়াতে ‘সুবিচার’ (عدل) -এর শর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সুবিচার বলতে শুধু ভরণপোষণ বা বাসস্থানের সমতা বোঝায় না, বরং স্ত্রীদের প্রতি সমান ভালবাসা ও মনোযোগ দেওয়াকেও বোঝায়। আর মানুষের পক্ষে একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সম্পূর্ণরূপে সমান অনুভূতি বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব। তাই অনেক ইসলামী পণ্ডিতের মতে, কুরআনের এই আয়াত মূলত একটি বিয়ের দিকেই উৎসাহিত করে। কারণ সুবিচারের শর্ত পূরণ করা খুবই কঠিন।
নবী মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবনের প্রেক্ষাপট:
নবী মুহাম্মাদ (সঃ) এর একাধিক বিবাহের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তবে তাঁর জীবনের প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করে শুধু এই দিকটি নিয়ে আলোচনা করা সঠিক নয়।
প্রথম বিবাহ: নবী (সঃ) ২৫ বছর বয়সে খাদিজা (রাঃ)-কে বিয়ে করেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় অন্য কোনো বিয়ে করেননি। খাদিজা (রাঃ) এর মৃত্যুর পর তিনি অন্যান্য বিয়ে করেন।
সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ: নবী (সঃ) এর অনেক বিবাহের পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণ ছিল। বিধবা নারীদের আশ্রয় দেওয়া, বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন, ইসলামের দাওয়াত প্রসারের মতো উদ্দেশ্যও এর সাথে জড়িত ছিল। তৎকালীন আরবের সমাজে বিধবাদের অবস্থা খুবই করুণ ছিল। তাদের আশ্রয় দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব ছিল।
উদাহরণ: নবী (সঃ) তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতেন। তিনি স্ত্রীদের সাথে কেমন আচরণ করতে হয়, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ইসলামী পণ্ডিতদের মতামত:
বহুবিবাহ নিয়ে ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কেউ কেউ বিশেষ পরিস্থিতিতে বহুবিবাহকে জায়েজ মনে করেন, তবে সুবিচারের শর্তের উপর জোর দেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি বিয়েই উত্তম। তবে সকলেই একমত যে, সুবিচার ছাড়া বহুবিবাহ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আধুনিক সমাজের প্রেক্ষাপট:
বর্তমান সমাজে বহুবিবাহের প্রচলন কম দেখা যায়। আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষের সমতা, নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বহুবিবাহের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পেয়েছে। তবে কিছু সমাজে এখনো এর প্রচলন আছে। কিন্তু সুবিচারের শর্ত পূরণ না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়।
ইসলামে বহুবিবাহ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কুরআন ও হাদিসের আলোকে এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। শুধু আবেগ বা প্রচলিত ধারণার উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। সুবিচারের শর্ত পূরণ করা কঠিন হওয়ায় একটি বিয়েই উত্তম। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে এবং সুবিচারের নিশ্চয়তা থাকলে বহুবিবাহের অনুমতি আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম একটি বাস্তবসম্মত ধর্ম এবং মানুষের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিধান দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ৮:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



