কোনরকমে ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে জোহরা ওর বকনা ছাগলদুটোকে ঘরে তোলে । মাত্র দুই ফিট বাই দুই ফিট একচাতালের একটা ঘর ,ঘর না বলে বরং ছাউনি বলা ভালো । উপরের ছাউনি থেকে অনবরত পানি পড়ছে, পুরোন নড়বঢ়ে বেড়ার গায়ে রাজ্যের জিনিস গোজা এবং সবই সংসারের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি । ১৯ বছর বয়সী জোহরার আধাপাগলা স্বামী হযরত, বয়স ৩৭ , জোহরা ওর তিন নম্বর বউ। এরই মধ্যে জোহরার দুই ছেলেমেয়ে হয়েছে । জোহরাকে হযরতের সাথে বিয়ে দেবার সময় ওর বাবা গুনে গুনে পাচ হাজার টাকা তুলে দিয়োছলো হযরতের হাতে , তবুও বিয়ের তিনদিনের মাথায় হযরত জোহরাকে বাশের চেলা দিয়ে মারতে মারতে বলেছিলো ”তোমার বাপ মোক ঠকা দিছেন , মুই তোক মারেয়া শেষ করিম ”। জোহরা ওর ৫ আর ৬ বছরের ছেলেমেয়ে দুটোকে ছালা এগিয়ে দেয় শীত থেকে রা পাবার জন্য , ঘরের কোনে গবরের তৈরী ঘুটো দিয়ে মাত্র চারটা লাল আলু সিদ্ব দেয়া হয়েছে, ওদের আজ রাতের খারার । সেই সকালে লবন দিয়ে পান্তা খাবার পর পেটে আর কোন দানা পড়েনি ।
মা, মোক একনা মুড়ি দেন মা , পেট জ্বলি গেইল
এতন পরে মেয়েটিও করুন মুখে মায়ের দিকে তাকায় । অথচ জোহরা নির্বিকার ,কিছুই করার নেই । ঘরে গত তিনদিনে কোন দানাও কেনা হয়নি ,হবেই বা কোথা থেকে ? আধপাগলা হযরত সারা এলাকা ঘুরেও পেটে ভাতে একটা কাজ জোগাড় করতে পারে না তাই জোহরা আজকে দুপুরে জংলা এলাকা থেকে ৪ টা মাটি আলু তুলে এনেছে। আজ তাই খেয়ে রাত পার করতে হবে। এরকম বহু রাতে ুধার তীব্র যন্ত্রনা এবং হযরতের বেদম প্রহারের পর জোহরার জীবনের চাকা অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত রংপুর,দিনাজপুর এবং নীলফামারীতে বাংলাদেশের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাক অতিদরিদ্র প্রকল্প শুরু করেছে আর জোহরার মতো হাজার হাজার জোহরাদের নাম লিপিবদ্ব হয়েছে সেই অতিদরিদ্রদের তালিকায় । জোহরা আজ তাই দুটো বকনা ছাগলের মালিক , অতিদরিদ্র প্রকল্পের ভাইদের নাম হলো টিইউপি ( টার্গেটেড
আলট্রা পুওর) ভাই । এই ভাইয়েরা ছাগল পালবার জন্য সপ্তাহে কিছু টাকাও দিয়ে দেয় জোহরার হাতে এবং পাশাপাশি কঠিন ভাবে আদেশ দেয়া আছে কোনভাবে এই টাকার হিসেব দিতে না পারলে খবর আছে , জোহরাকে এই কর্মসুচি থেকে বাদ দেয়া হতে পারে ।জোহরা তাই ওর পুরোন টিনের ডিব্বার ভিতর তিনটে দশ টাকার নোট লুকিয়ে রেখেছে।
আজও পোলার বাপ কাজে যাবার আগে জোহরার চুলের মুঠি ধরে ভিষন মেরেছে আর টাকা চেয়েছে , কিন্তু জোহরা মুখ খোলেনি , এই কনকনে শীতে ও কালকে দুটো ছালা বা বস্তা এবং ছাগলের ওষুধ কিনবে । এখন জোহরার চোখে শুধুই আগামী দিনের স্বপ্ন । ও পাড়ার করিমন গত একবছরে ৬ টা ছাগল এর মালিক হয়েছে, প্রথম দিকে করিমনও জোহরার মতো কষ্ট করেছে নিজে না খেয়ে ছাগলের জন্য খাবার কিনেছে ,ছাগল বুকে করে রেখেছে তেমনি এক বছরের মাথায় করিমন এখন প্রায় ৫০০ টাকার মালিক , এবং টাকা দিয়ে করিমন এই বছর ঘর মেরামত করবে , স্বামীকে একটা কোদাল কিনে দেবে , এসবই এখন জোহরার কাছে এক বিশাল কর্মময় জগৎ । তাই সন্ধ্যা সাতটা থেকে দুটোর ছেলেমেয়ের ুধার জ্বালা জোহরাকে তেমন বিচলিত করে না, যতটা বিচলিত করে বকনা ছাগলদুটোর সঠিক নিরাপত্তা । জোহরা দ্রুত হাতে আলুর ছিলকা ছিলতে শুরু করে,ছেলেমেয়েকে আলুর সাথে কিছু উদা হয়ে যাওয়্ মুড়িও দিতে পারবে , আজকে সকালেই পাড়ার মুদি দোকানের খাদেম আলী কিছু মুড়ি ঝাড়তে দিয়েছিলো ,সেখান থেকেই ফেলে দেয়া মুড়িগুলো নিয়ে এসছে জোহরা । খাবার গোছাতে গোছাতে আবার জোহরার সামনে টিউপি ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায় , উনি বার বার বলেছেন , দেখ জোহরা তোমার ছেলেমেয়েদের অসুখ হলে তুমি আমাদের খরব দিবা ,ওদের দেখাশোনা করাও আমাদের কাজ ,কিন্তু জোহরা এ ব্যাপারেও নিলির্প্ত , কারন বাসিপচা না খেলেই তো ওদের অসুখ করবে । অবিরাম দুঃখের এই একঘেয়েমি সময়েও জোহরার হাসি পায় , কত রকমের মানুষ আছে এই জগৎ সংসারে। মাটির সানকি গুলো ওদের দিকে এগিয়ে দেবার সময় জোহরা এবার কেয়ারের স্বাস্থ্য আপার কথা মনে করে , কি আর্শ্চষ ? আপা মটর সাইকেল চালায় , অনেকটাকা বেতন পায় আবার ঘর সংসারও করে । হ্যা , সেই আপাকেই তো জোহরা একদিন বলতে শুনেছে , আপনাদের স্বামী যদি আপনাদেরকে নির্যাতন করে আমাদেরকে বলবেন আমরা পুলিশে খবর দেবো । জোহরা সেদিন নির্যাতন শব্দের অর্থ বোঝেনি পরে জানতে পেরেছে স্বামীর খারাপ ব্যবহারকেই ওরা নির্যাতন বলে , এটা কি কোন কথা হলো ? পেটের ুধার কাছে নির্যাতন তো কোন বড় ব্যাপার না,স্বামী যদি ভাত দেয়,তবে তো সে মারতেই পারে,এমনকি ভাত না দিলেও তো স্বামী মারবে,আজন্ম দরিদ্রতার সাথে লড়াই করে আসা জোহরার জগৎ কেবল দুটো পান্তা ভাত জোগাড়ের পিছনেই চলে গেলো,এসব ভাবনা তাই জোহরার অবান্তর মনে হয় । আরো রাত বাড়ে,জোহরার চোখে ঝিমুনি চলে এসছে,ছেলেমেয়ে দুটো ছাগলগুলোর পাশে জড়ো সড়ো হয়ে শুয়ে পড়েছে,কিন্তু জোহরার চোখে ঘুম আসে না । হযরত আজকেও বলে গেছে রাতে এসে ভাত খাবে ,জোহরা যেখান থেকে পারে ভাত জোগাড় করে রাখবে । কিন্তু জোহরা পারেনি ,তাই হাতের কাছ থেকে লাঠি আর বাশের চটা গুলো সরিয়ে রাখে সে । মার খাওয়া বা না খেয়ে থাকা জোহরার জীবনে খুব সাধারন ঘটনার একটি , কিন্তু কোনদিন একজন শহরের মানুষকে কাছ দেখতে না পাওয়া এই জীবনে টিইউপি ভাইয়ের আশ্বাস বা স্বাস্থ্য আপাকে কাছ থেকে দেখতে পাবার ঘটনা জোহরাকে বাড়তি শক্তি জোগায় । জোহরা হযরতের অপোয় নড়েচড়ে বসে।
খুব শীত পড়েছে আজ ,মাইনাস ৩০ ,এই শিতেই একটা ৬ ঘন্টার শিফট করতে হয়েছে নিতাকে,গায়ে কম্বলের মতো মোটা ওভারকোট তবুও মনে হচ্ছে শীত তীরের মতো শরীরে প্রবেশ করছে।ডনমিলস রোডে টিটিসি(টরোন্টো ট্রানজিট কমিশন) বাসের জন্য প্রায় পনের মিনিট দাড়াতে হচ্ছে , রাত বারোটার পরে বাসের গ্যাপটা বেড়ে যায় । আজকে কাজ শেষে ম্যানেজার হেডার দুই পাইল মিট আর বার্গার এর বান ফেলে দিলো আর সেই থেকে নিতার চোখে জোহরার ছায়া ভেসে উঠছে । দেশ থেকে চলে আসার আগে তিনবছর ব্র্যাকের অতিদরিদ্র প্রকল্পে কাজ করার সময় একটা কেস স্টাডি লেখার কারনে জোহরাকে কাছ থেকে দেখতে হয়েছিলো নিতাকে। রংপুরের কদমতলী ইউনিয়নের এক নিভৃত অজো পাড়াগায়ের মেয়ের সাথে নিতার এই টরোন্টোর জীবনটার খুব ফারাক নেই বলেই নিতার বিশ্বাস। একবেলা ভাতের জন্য যে বেচে থাকে তাকে বরং সহজেই সুখী করা সম্ভব কিন্তু যারা নিতার মতো জীবনের স্যটিসফেকশন চায় তাদেরকে কি দিয়ে সুখী করা যায়? দুর থেকে টিটিসি বাসের হেডলাইটটা নিতাকে বাসে চড়তে নির্দেশ দেয়,ওভারকোটের পকেটে হাত দিয়ে মেট্রোপাসটা চেক করে নিতা,স্যাটিসফেকশনক শব্দের বাংলা ব্যাখা কি? বাস নির্ধারিত স্টপেজে পৌছালে নিতা চকচকে স্বচ্ছ কাচের মতো বরফের উপর পা রাখে ।
লুনা শীরিন , টরোন্টো, কানাডা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



