ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীন শিক জনাব সরদার ফজলুল করিম আমার প্রিয় মানুষদের তালিকায় অন্যতম। গত ১৫ বছর ধরে স্যারের ব্যক্তিগত ও পারিবরিক জীবনের সাথে আমি ঘনিষ্টভাবে জড়িত। আজ একটু আগে ঢাকা থেকে মা ফোনে জানালেন সরদার স্যার আমার বাড়িতে ফোন করে আমার খবর জানতে চেয়েছেন। টরোন্টোতে মা যখন ফোনে জানালেন ঢাকায় তখন সকাল এগারোটা,আমি তখুনি স্যারকে ফোন করি , স্যারের সেই সেন্হ মাখা কণ্ঠস্বর ” কেমন আছো তুমি কোন খোজ খবর লও না,আমি আজ আছি কি কাল নাই, তোমরা খবর না নিলে নিজেরে বড় একা মনে হয় ”। কি আশ্চর্ষ শিক। শিক কি এমনি হওয়া উচিত ? স্যারের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে আজ বাংলাদেশে কোন প্রশ্ন নেই। কিংবদন্তীর মতো স্যারের অর্জন, ছাত্র/ শিক / সাধারন মানুষ যারাই স্যারকে চিনেছেন তারা সকলেই তাকে একজন সৎ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেন বা বলা চলে করতে বাধ্য হয়েছেন । কেমন করে স্যার এই অনন্য জীবন গড়ে তুললেন? প্রশ্নটা অনেকের কাছেই কৌতুহল তৈরী করে,তারা খুজে খুজে সরদার ফজলুল করিমের কাছে যান, যেমন করে আমি একদিন দেখা করেছিলাম । ১৯৯২ সাল ,আমি তখন জাহাংগীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিঞ্জান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, একদিন দেখি রিকসায় করে লাঠিতে ভর দিয়ে সরদার ফজলুল করিম যাচ্ছেন,আমি মাঝপথে গিয়ে রিকসা থামাই, স্যারকে সরে বসতে বলে আমি পাশে উঠে বসি । স্যার তো অবাক , তুমি কে ? এভাবে আমার রিকসায় উঠলে কেন , স্যারের সেই প্রশ্নে গভীর ভালোবাসা জড়িত ছিলো , স্যারের বয়স তখন ৭৫ মতো হবে । আমি আরো বেশী অধিকার নিয়ে বললাম , আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী আপনাকে আমার ভীষন দরকার আমি আপনার সাথে ঢাকা যাবো । আমি আর স্যার মিলে উঠে বসি সাভার ঢাকার বাসে । আজো মনে পড়ে , সারা পথ আমি স্যারকে নানান কথা বলে ত বিত করেছিলাম কেন এটা হবে ,কেন ওটা হবে না ইত্যাদি । একসময় স্যার আমাকে বললেন, তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের মধ্যেই তো আমি সমম্ভবনা দেখতে পাচ্ছি , যে তরুনের মনে প্রশ্ন নেই,কিছু করবার আকাংখা নেই সে তো তরুন নয় । গভীর দার্শনিক উচ্চারন স্যারের । পরে , আরো অনেক পরে জেনেছিলাম বা বুঝতে পেরেছিলাম প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধানেও স্যার আমাদের অনেকের চেয়ে কতবেশী সজীব বা তরুন আছে । মুলত সেদিনের সেই বাসভ্রমন এর পর থেকেই স্যারের সাথে আমার যাত্রা শুরু । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যারের ক , জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যারের নির্ধারিত ঘর,শ্যামলীর ডেরাতে স্যারের সাথে সময় কাটানো , এরপর ইন্দিরা রোডে স্যারের বাড়ি , স্যারের পারিবারিক জীবনে আমার একছত্র অধিকার, আমার ব্যক্তিগত জীবনে স্যারের প্রভাব ইত্যাদি সব মিলিয়ে একজন মানুষকে যতটুকু দেখা ও বোঝা সম্ভব সবটুকুই আমি চেষ্টা করেছি । কিন্তু আমার আগ্রহ ফুরায়নি , স্যারকে যত দেখেছি তত অবাক হয়েছি , মানুষ কি এমন নিমোর্হ হয় জীবনের প্রতি ? নিশ্চয়ই হয় , নইলে সরদার ফজলুল করিম তৈরী হলো কি করে। স্যার একদিন গল্প করছিলেন ,” ১৯৪৫ সাল, স্যার তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক হিসেবে যোগ দিয়েছেন পাশাপাশি একজন সক্রিয় কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মী ।একদিন স্যার খবর পেলেন স্যারের নামে বিভাগে একটি স্কলারশীপ এসছে । স্যার যথারীতি তৎকালীন পার্টির নেতার কাছে গেলেন অনুমতির জন্য , তখন অল ইন্ডিয়া কমিউনিষ্ট পার্টির প্রধান ছিলেন মোজাফফর আহমেদ(ম্যাক) । তার কাছে স্যার অফারটার কথা তুলতেই তিনি স্যার কে বললেন ,” তুমি দেশের বাইরে গিয়া পড়াশোনা করবা আর আমরা কি এইখানে বইসা ভেরেন্ডা ভাজবো” । ব্যাস,স্যার তার অফার লেটারটা ছিড়ে ফেললেন । আজকের যুগে এমন গল্প অনেকের কাছেই হাসির খোরাক যোগাবে , কিন্তু পার্টির প্রতি ডেডিগেশন কি এমনি হওয়া উচিত না । আজকের বাংলাদেশে যে কোন রাজনৈতিক কর্মীর কাছে রাজনীতি আর আত্বত্যাগ বা সমাজ বদলানোর জায়গা হিসেবে বিবেচিত নয় বরং এটি হলো নিজেদের সুবিধা করে নেবার একটি প্লাটফর্ম আর সেই বাস্তবতার রোষানলে পরে একটি দেশর সাধারন মানুষের জীবন রক্তাত্ব হচ্ছে প্রতিমুহুর্ত । সরদার স্যার আজকের তরুন সমাজের কাছে প্রায় অপরিচিত কারন সমাজ সত্যিই এখন আর গুনী মানুষের পে নেই, কারন যে সমাজে বাপ ছেলেকে চুরির টাকা সম্পর্কে প্রশ্ন করে না , যে সমাজে আজীবন সততার সাথে যুদ্দ করা একজন পিতা অবলীলায় অসৎ এবং চোর ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয় সেই সমাজে আর কি বাকী থাকে?মুল্যবোধ বা নৈতিকতা নামক কোন শব্দের সাথে গত ২০ বছরের বাংলাদেশের তরুন প্রজন্মের কি আদৌ পরিচয় হয়েছে ? প্রশ্নগুলো গভীর বিশ্লেষনের দাবী রাখে । আমি আমার প্রজন্মের সেই গুটিকয়েক সৌভাগ্যবানদের একজন যে সরদার স্যারের সময়কে জেনেছিলাম । বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালেও স্যার যেভাবে আশার আলো জ্বালিয়েছেন তাতে ভরসা ফিরে পাই ,মনে হয় দেশে একজন মানুষ হলেও আছেন যাকে চাইলেই টাকা দিয়ে কেনা যায় না , যিনি ৮৩ বছর বয়সে তরুন ছেলেমেয়েদের বলতে পারেন , তুমি সৎ থাকবা মুল্য দিবা না তা কেমনে হয় । গল্পে গল্পে স্যার আরো একদিন বলেছিলেন , দেইখো বাংলাদেশে আর কয়েকদিন পর সৎ মানুষ জাদুঘরে রাখন লাগবো ,তারপর আংগুল তুইলা কওন লাগবো ”যান ওইখানে গিয়া সৎ মানূষ দেইখা আসেন”।
কি অবলীলায় স্যার সমাজের গভীর সত্যটা বলেছেন , আজ টরোন্টো শহরের আমার নিজঘরে নিরিবিলি বসে আমি আকাশ পাতাল ভাবতে থাকি , কিসের মোহে এই জীবন? যে দেশে গন্ডায় গন্ডায় মন্ত্রী আর নীতি নীতি নির্ধারকরা চুরির দায়ে জেলের ভাত খাচ্ছে , যে দেশে শিক ছাত্রীকে অবমাননা করার দায়ে চাকরিচ্যুত হন , যেই দেশে সরদার স্যারের মতো শিককে ফুল প্রফেসর না করে অযোগ্য অর্থব শিককে স্বজনপ্রীতির নামে বিদেশে পড়তে পাঠিয়ে কলংকের সুচনা করে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো , সেই দেশেরই শি্কক্ক কি সরদার স্যার? কোন যোগ্যতার মাপকাঠিতে স্যারকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অবসর নিতে হয় , এই প্রশ্নের উত্তরটা বড় বেশী ভাবায় ,আর দাড় করিয়ে দেখাতে ইচ্ছে করে সেইসব শিকদের যারা সমাজে শিক নামে কলংক।
আজকে স্যারের প্রতি ভালোবাসা জানাতে গিয়ে মনে হচ্ছে স্যারকে গিয়ে বলি, আপনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে জাদুঘরে রাখার জন্যও লোক পাবো না ,আসুন স্যার ,আপনি মশাল হাতে দাড়ান আমরা নিশ্চয়ই আপনার জ্বালানো পাদপ্রদীপের নীচে হাজির হয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়বো , আপনার এই মহান জীবনদর্শনের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম ।
লুনা শীরিন , টরোন্টো
পহেলা মে , ২০০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



