টরোন্টো শহরের অন্যতম পশ এলাকা রিচমন্ড হীলে নীরা আর দ্বারা ভাইয়ের কয়েককোটি টাকায় কেনা বাড়িতে বসে ওয়াটার ছবি দেখছিলাম । নীরা ছাড়াও ছবি দেখার আসরে রয়েছে দীপা,মুক্তি ও তনিমা । সবাই ঢাকা থেকে সর্বেŸাচ ডীগ্রিধারী এবং একেকজন মেধার র্শীষে থেকেই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডায় নিজেদের ভাগ্য গড়তে এসছেন । সেই প্রচেষ্টাতে নিঃসন্দেহে ওরা নিজেদেরকে সফল মনে করে বলেই এইদেশে পাকাপাকিভাবে গাড়ি/বাড়ি এবং স্বামী/সস্তান নিয়ে বসবাস করছেন । নিতাও এদের সাথে বসে ছবি দেখছিলো সেই সন্ধ্যায়। বাকী চারজন মেয়ে ছবি দেখছে,বিধাবা মেয়েদের জীবন দেখছে, চুইয়াকে অনুভব করার চেষ্টা করছে আর বলছে জানেন নিতা আপা,”আমরা অনেক বেশী ফরচুনেট,অনেক বেশী অগ্রসর সময়ে আমরা বাস করছি” নিশ্চয়ই বাস করছি,নিতা দ্বিমত পোষন করে না আর করবেই বা কেন? সুপরিসর ড্রইংরুমের এককোনে বসে তাস খেলছে চার যুবক ,বাচ্চারা খেলা করছে অন্য একটি ফাকা স্পেসে , আলো আধারীর লিভিংরুমের এককোনে হোম থিয়েটারে নিতারা এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ছবি ওয়াটার দেখছে এবং প্রতিটি মেয়ের গায়ে রয়েছে আধুনিক জামাকাপড়,হোক না সেই টিশার্ট বা টাইট গেঞ্জির নীচে একবুক অভিমানের বাস ? বা বুকের ভিতর বহন করা মেয়েদের সেই প্রাচীন শব্দ ক¤েপ্রামাইজ ।তাতে কি? মানুষের শরীরের বাইরে থেকে তো আর এসব অনুভুতি দেখা যায় না,তাহলেই তো বাচা। এই যেমন ওয়াটার ছবিতে ছয় বছরের চুইয়াকে যখন ওর বাবা ঘুম থেকে ডেকে বলল, তোর স্বামী মারা গেছে,তখনই নিতা দেখতে পায় এই বাড়ির গৃহকর্তীকে । যিনি ২৬ বছর বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন দ্বারাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্সে এম এ করা মেয়ে নীরা সত্যিকার অর্থেই রুপে/গুনে /মেধায় অনন্য , ঢাকায় একনামে চেনে এমন একটি পরিবারের মেয়ে নীরা । আজ থেকে ঠিক দেড়বছর আগে প্রথম যেদিন নীরার সাথে পরিচয় হয় নিতার,তখুনি নিতা জেনেছিলো , বাঙলাদেশের এই বিখ্যাত পরিবারটি মেনে নেয়নি নীরার পছন্দকে বা ওর ভালোবাসাকে , অথচ যারা কিনা নিজেদেরকে মনে করেন মুক্তচিন্তার ধজ্বাধারী , যারা কিনা সাম্যর গান গেয়ে বাংলাদেশে বিপ্লব আনতে চেয়েছিলো আজ তারাই কিনা নিজেদের ইগো রক্ষা করতে গিয়ে নীরার শিশুপুত্রের মুখ দেখেনি , নীরার একমাত্র অপরাধ ও পছন্দ করেছে দ্বারাকে। সবকিছুকে সামলে চলার জন্যই হোক আর বাবা /মা এর কষ্টকে চোখের সামনে সইতে হবে না এমন চিন্তা থেকেই হোক, নীরা আর দ্বারা ঢাকায় ৫/৬ বছর সংসার করার পর চলে আসে কানাডায় ,কিন্তু নীরার মুক্তি মেলেনি,টরোন্টোর কঠিন বাস্তবতায় নীরাকে মেনে নিতে হচ্ছে দ্বারার ভিতরে বাস করা প্রাচীন সেই পুরুষ ইগোকে, তাই নীরা প্রায়ই বলে ,জানো নিতা, খুব বেশী ক¤েপ্রামাইজ করতে হয় ভীষন একা মনে হয় নিজেকে ,অসহায় লাগে,শুধু সমাজ নামক অদৃশ্য যন্ত্র না থাকলে আমি হয়তো একটু বুক ভরে নিঃস্বাস নিতে পারতাম”।ঠিক এই সময়েই দেখা যায় ওয়াটার ছবিতে ৭ বছরের চুইয়াকে ওর বাবা বিধাবা আশ্রমে রেখে আসছে,আর চুইয়া চিৎকার দিচ্ছে ,” আমি মায়ের কাছে যাবো,অবুঝ শিশুর আকুতি ” । নীরা সেই অর্থে চুইয়ার চেয়েও অসহায় ,যার ভাষা আছে,শক্তি আছে কিন্তু বলপ্রয়োগের রাস্তা নেই বা সে সচেতন ভাবে বিশ্বাস করে ,এই বলপ্রয়োগ করা যাবে না তার চেয়ে মেনে নেয়া ভালো । নিতা ওয়াটার ছবির দিকে একবার তাকায়, আর ৩৬ বছরের কৃতী ও মেধাবী নীরার দিকে একবার তাকায়, লিভিং রুমের অল্প আলোয় রক্তিম হয়ে উঠা নীরার ফর্সা ত্বকের নীচে বেদনার নীল আলো সহজেই ঢাকা পড়ে যায়।
দীপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোসিওলোজিতে প্রথম শ্রেনী পাওয়া ছাত্রী , ভালোবেসে দীপাও বিয়ে করেছিলো রনীকে , দীপার শাশুড়ির নাকউচু ,অন্যর ছেলেমেয়েরা যে তার সন্তানদের চেয়ে যোগ্যতায় বেশী হতে পারে তা তিনি মানেন না তাই বিয়ের পর দীপাকে তিনি বলেছিলেন,সোসিওলোজি কোন সাবজেক্ট হলো এই পড়ার কোন ভবিসৎ আছে। দীপার ছোট দেবর বিয়ের দুদিনের মাথায় বলেছিলো,ভাবী তুমি একটা ডিম সোজা করে ভাজতে পারো না। দীপা ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত বাবার বাড়িতে আক্ষরিক অর্থে কুটো নেড়ে খায়নি অথচ এই সত্য সামান্য স্বীকৃতি পায়নি প্রথমত রনীর কাছে,তাই শশুড়বাড়িতে দীপাকে মানিয়ে চলতে হবে সেটাতো জলের মতো পরিস্কার।নিতা বলে,তুমিতো বিয়ের আগেই চিনতে রনীকে তখন বুঝতে পারোনি,দীপা হেসে উঠে,আপা তখন মনে হয়েছিলো, রনীকে পাবো মানইে সব পাবো চাইকি স্বর্গও আমার হাতে,সেদিন বুঝতে পারিনি,তাই বিয়ের প্রথম রাতেও যখন সব মেনে নেবার প্রস্তাব এসছিলো রনীর কাছ থেকে, সেদিনও মনে হয়েছিলো রনীর ভালোবাসার কাছে এগুলো তো অতিতুচ্ছ আবেদন , তারপর ধীরে ধীরে আজ এতবছরে এগগুলোই মহীরুহ হতে থাকলো ।জানেন নিতা আপা , আমার পরিবারের সবার বিপক্ষে গিয়ে আমি রনীকে বিয়ে করার যে আয়োজন করেছিলাম আজ সেই আমিই সবার অলক্ষ্যে চোখের পানি ফেলছি , তাই আজ এই টরোন্টো শহরে বসে চুল কাটলেও আমার দেবর রনীকে বলে, ভাবী জানে না সে কোন বাড়ির বউ , আর রনী সেই উত্তরে বলে কি জানেন, আসলে এখানে সবাই কাটে তো তাই ? শুধু শশুড়বাড়ির মতো করে চলার জন্যই কি এই জীবন,সময় সময় অভক্তি লাগে এই জীবনের উপর।
১৯৩৮ সালের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করে ২০০৬ সালে নির্মিত হয়েছে ওয়াটার ছবি, প্রায় ৬৮ বছরের ব্যবধান। এই সময়ের ভিতর কি মেয়েদের কষ্টের ধরন পরিবর্তন হয়েছে?বদলেছে পোশাক, কিন্তু মৌলিক কি কি পরিবর্তন হয়েছে ? চুইয়া,লিসারে বা কল্যানী আজকের সময়ের চেয়ে অনেকবেশী সুখী,কারন জন্মগতভাবে ওরা শরীর ছাড়া আর কিছুই অর্জন করেনি, কিন্তু দীপা বা নীরারা অর্জন করেছে অনেককিছু , বিংশ শতাব্দীতে ওরা একই সাথে একই শ্রেনী কক্ষে,একই পাঠ্যপুস্তক পড়ে অধিক মার্কস পেয়েছে,উন্নত বিশ্বে চাকরির জায়গায় নিজেদের যোগ্যতায় স্বামীদের চেয়ে বেশী দামের চাকরিও পেয়েছে ,এমনকি খোজ নিলে দেখা যাবে অনেক ক্ষেত্রে নীরা দীপারাই কানাডায় আসার জন্য মেজর এ্যপলিকেন্ট। কিন্তু সংসার নামক আশ্রমে ঢোকার জন্য এই মেয়েরাই প্রতি পদে পদে খাটো করছে নিজেদের মেধা,অর্জিত শিক্ষা,পুরুষের সাথে সমানতালে চলার পথকে এড়িয়ে চলছে সচেতনভাবে আর তাই প্রকারান্তরে এই মেয়েরাও লক্ষাধিক ডলারের বাড়িতে থেকেও,বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশে থেকেও ওরা হয়ে পড়ছে একা ও নিঃসংগ। ওয়াটার ছবিতে মুল প্রতিপাদ্য ছিলো ”একটি মেয়ের গোটা জীবনটাই স্বামীকেন্দ্রিক”। ৭০ বছর পরেও বাংলাদেশের একটি মেয়েকে স্বামী বা শশুড়বাড়িকে জয় করার জন্যই সাজাতে হয় গোটা জীবন সুতরাং এখানে ৬ বছরের চুইয়ার যুদ্দ আর ৩৬ বছরের নীরাদের যুদ্দের মৈালিক ফারাক খুব সামান্য।
সেদিন রীচমন্ড হীল থেকে বের হবার পথেই নিতার মনে হয়েছিলো দীপা মেহতার ওয়াটার ছবিটা আর কিছু না হোক অ›তত তুলনার শক্তিতো জুগিয়েছে, একদিন হয়তো এই শক্তি নীরা আর দীপাদেরকে স্যতিকারের চলার পথটা খুজে পেতে সহযোগিতা করবে । দর্শনই বলে, দন্ধই বিকাশের উৎস ।
লুনা শীরিন,টরোন্টো,কানাডা

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



