গত বছর জুলাই মাসের সাত তারিখে লন্ডন থেকে নিতার নামে একটি চিঠি আসে । চিঠির শেষ অংশের কিছুটা এরকম ”তোমার জীবনপথটা সুবোধ সরলরেখার মতো সরলপথে যায়নি বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব মর্মাহত হয়নি। চলার পথে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কখনও কখনও একটু থমকে দাড়ানো দরকার -- চারিদিকে তাকিয়ে তখন বুঝে নেয়া যায়, কোথায় আমি দাড়িয়ে আছি। এটা একটা দিকনির্দেশনা, নতুন করে গন্তব্য নির্নয় করা,তারপর আত্ববিশ্বাসের উপর নির্ভর করে সেই পথে পা বাড়ানো । এটা বুকের পাজর জ্বালিয়ে একলা চলার পথ,এই পথে কখনো দোসর জোটে না ।” চিঠির প্রেরক জনাব শেখ আব্দুল ওহায়াব,বয়স ৭৯ বছর । অনেকদিন হলো লন্ডনে বসবাস করছেন । ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এরপর শিক্ষকতা করতে লন্ডনে চলে আসেন,এখানে ছেলেমেয়েদের বড় করার পর বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। নিতার সাথে এই প্রবীন শিক্ষাবীদের পরিচয় হয় আজকে থেকে ঠিক ১৬ বছর আগে,১৯৮৯ সালের নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে, সেই দুপুরটা নিতার কাছে একটি জ্বলজল্বে সত্য -- এই ক্ষুদ্র একঘেয়েমী জীবনে এরকম কয়েকটি অতিস্বরনীয় মুহুর্তকে জয় করতে পারার জন্যই সময় সময় ও বেচে থাকার প্রতি বড় বেশী তৃøা বোধ করে। তখন নিতা সবে ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে ,বাবা সাভারে পিএটিসিতে কর্মরত আছেন,বাবার এক কলিগ যাকে ছোটবেলা থেকে আংকেল ডাকে তার মায়ের সাথে নিতার সখ্যতা । নানী নিতাকে ভালোবাসেন,পাশাপাশি নিতা নানীর একজন কাছের মানুষ ও বন্ধু । সেদিন সেই দুপুরে নিতা নানী বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো সাভার থেকে , মিরপুর পুরবী সিনেমা হলের কাছে ছায়াঘেরা চারতালা বাড়িতে একটা রুম ছিলো নানীর । বলে নেয়া ভালো,নিতার সেই নানীও একজন গুনী মহিলা আর এমন অনেক মহিলারা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে জন্মেছিলেন বলেই আজকের বাংলাদেশ একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী পেয়েছে । তো সেদিন নিতা নানী বাসায় উপস্থিত হবার পর থেকেই স্বভাবঅনুযায়ী হৈ চৈ করছে,একসময় নানী ডেকে বললেন,দাদু আজকে বেশী চেচামেচি করো না , তোমার এক নানা এসছেন, উনি ও ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আজীবন নিষিদ্ধ বিযয়ে নিতার তীব্র আগ্রহ, তাই ধীর পায়ে নানার ঘরে প্রবেশ করে ও। একজন ৬৫/৬৬ বছরের শক্ত, লম্বা ,চওড়া মানুষ ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন,চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা , অপুর্ব সুন্দর কালো চেহারায় শ্রদ্ধা করবার মতো সিন্ধতা ছড়িয়ে আছে । নিতা নিঃশব্ধে নানার ডান হাতে আস্তে করে হাত রেখে প্রশ্ন করে , কেমন আছেন আপনি । নানা চোখ মেলে তাকান , স্মিত হেসে বলেন , তোমাকে তো আমি চিনি না, কিন্তু এই মুহুর্তে আমি কথাও বলতে চাই না তবে তুমি যদি একান্তই আমার কাছে বসতে চাও তাহলে ওই ঘর থেকে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থটা নিয়ে এসো , ওখানে ২৭৬ নাম্বার পাতায় শাহজাহান কবিতাটা আমাকে পড়ে শোনাও । একনাগাড়ে বলে যাওয়া কথাটা শুনে নিতার মনে হয়েছিলো কথাগুলো নানা বলবার জন্য তৈরী ছিলেন শুধু মানুষ পাচ্ছিলেন না । নিতা কথা না বাড়িয়ে অর্ডার ফলো করে। কবিতা শুনে একজন পুর্নবয়স্ক মানুষ নীরবে চোখ মুছতে পারে নিতার জীবনে সেটাই প্রথম দেখা ।
এরপর নানার সাথে অথ্যার্ৎ নানীর সেই ভাই এর সাথে নিতার দুবছর দেখা হয়নি , ততদিনে নিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিঞ্জান বিভাগের ছাত্রী,একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গাড়ী থেকে নানাকে নামতে দেখে নিতা । এই তো সেই ওহায়াব নানা ? নিতার চোখের সামনে সেই কবিতা পড়ার দুপুরটা চলে আসে, নানার পিছু নিয়ে নিতা জাহাংগীরনগরের দর্শন বিভাগে প্রবেশ করে এবং নানা তখন নিতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আছেন । এরপর থেকে আজকে পর্যন্ত সেই দুপুরকে জয় করার গল্পটা করা যাবে ,কিন্তু তাতে তৃপ্তি নেই,আছে অবারিত দুঃখের কিছু অনুভুতি,অথার্ৎ নিতার সাথে গত ১৩ বছর নানার আর দেখা হয়নি, আদৌ কোনদিন দেখা হবে কিনা নিতা জানে না ।
আজকেও ছুটির দিনে এই দুপুরে নানাকে নিয়ে গল্পটা শেষ করার আগে নিতা লন্ডনে ফোন করে , জানতে চায় নানা তুমি তোমার ডিটেলগুলো আমাকে বলো তো , এই যেমন ধরো কবে তুমি এম এ পাশ করলে, কবে তোমার বই বের হলো ইত্যাদি । নানা সহসাই ফিরে যান অতীতে , কে আছেন এমন মানুষ যিনি কষ্ট করে সফলতা অর্জন করলে বলেন না বা বলতে ভালোবাসেন না ? দাদু,আমি ১৯৫৩ সালে অনার্স এম এ পাশ করি ফিলসফি ডিপার্টমেন্ট থেকে , আমি দুটোতেই প্রথম হয়েছিলাম এবং গোল্ডমেডেল সহ ,আজো মনে পড়ে সেই শিক্ষকের কথা যিনি আনন্দে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন আমার পরীক্ষার ফল দেখে, বলেছিলেন তোমাকে আমি একটা পেপারে একটু কম মার্ক দিয়েছি কিন্তু তাতেও তুমি সেরা রেজাল্ট করেছো, তিনি আরো বলেছিলেন, তোমার মতো ছেলের জন্য আমরা গর্ব করি । ৫৩ সালের এপ্রিল এ আমার পরীক্ষার ফল বের হয় আমি সেই মাসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করি । নানা যেনো ফিরে গিয়েছেন তার যৌবনের দিনগুলোতে, বেশ উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকেন , এরপরের মাসেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেই অনেকটাই নিজের জেদে বলতে পারো , আবার যোগ দেই কলেজে,এরপর তো দাদু বিলেতে চলে এলাম ৬৩ সালে,দেশ স্বাধীন হলো আমি ৭৭ সালে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলাম, এবার টানা ১০ বছর পড়ালাম,সেই সময়ে আমার কান্টের নীতিদর্শন(১৯৮২ সালে) নামে বিশ্ববিদ্যালয় পযার্য়ের একটি বই প্রকাশিত হয় এরপর লিখি বিংশ শতাব্দীর নীতিদর্শন(১৯৮৬ সালে) । এই দুটো বই ই এম এ লেভেলের ছেলেমেয়েদের কাছে ভীষন সমাদৃত হয়েছিলো। ১৯৮৯ সালে আমি আবার বিলেতে চলে আসি ।
নিতা হ্যন্ডসেট কানে ধরে আছে কিন্তু নিতার সামনে ভেসে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ কলাভবন এ শিক্ষকদের ঘরগুলো , একজন মানুষ যিনি একসময়ের অগুনিত গুনী মানুষের চোখে একজন গুনী মানুষ বলে বিবেচিত , সময়কে জয় করে যিনি ইতিহাস তৈরী করেছিলেন , তার সাথেই কি নিতা কথা বলছে ? আজকে এতবছর পরেও নিতা ভাবে , নানার মনের ভিতর ওর জন্য জায়গা হয়েছে , সেই সত্যর চেয়েও বড় সত্য নানার প্রতি নিতার অসীম ভালোবাসা । কিন্তু নিতা জয় করতে পারেনি নিজের অসহায়ত্বকে , সুযোগ এবং সময়কে মেলাতে পারেনি নিতা,মাত্র আরো একটি দুপুর নানার পাশে বসে কাটাবার তীব্র আগ্রহ আর ইচ্ছাকে বলি দিতে নিতার মন সরে না । তাই টরোন্টো শহরের ফাকা দুপুরে নিতা আবার ফোন ঘোরায় নানাকে ,ওপাশ থেকে নানার সেন্হমাখা গলা ভেসে আসে, নানা বলতে থাকেন ” বুবু তুমি আমাকে দেখতে চাও, কিন্তু তুমি তো জানো না প্রিয়জন এর সামনে একটা সময়ের পরে আর দাড়ানো যায় না ,তখন শুধু উভয়ের ক্ষয় আর কালিমা উভয়ের চোখে পড়ে, এটা বড় দুঃসহ আর বেদনার । বরং শাহজাহান নামে যে কবিতা দিয়ে আমাদের পরিচয় হয়েছিলো সেটাই কালের সাক্ষর হয়ে থাকুক ”। শেষের দিকে নানার গলা জড়িয়ে আসে নিতা বুঝতে পারে নানা নিজেকে লুকোচ্ছেন ,নিঃশব্দে ফোন ছেড়ে নিতা ঠান্ডা পানিতে চোখ ধুয়ে নেয় ।
লুনা শীরিন,টরোন্টো,কানাডা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



