শেষবার বাসা থেকে বের হবার পরও তিনবার বাড়িতে ডুকতে হয়েছে নায়লাকে । গতকাল সন্ধ্যায় ছোটবোন নুপুর বলেছিলো , আজ ক্যাম্পিং হবে, রাতেই সব গোছগাছ করে রাখবি সকালে বাচ্চাদের নাস্তা খাইয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়বো , দেখবি জংগলের ভিতর রাত কাটানো কি এক্সাইটিং । কি আর করা , নায়লার না বলার স্কোপ নেই বহুবার ও না বলে পাড় পেয়েছে, বিশেষ করে গত ছয়মাসের টরোন্টোর জীবনে।
কথামতো সকালে উঠে ছোটবোনের ছেলে কিশান আর নায়লার ছেলে সামিরকে রেডি করে নুপুরের স্বামী মনজুর যখন গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে তখন ঘড়িতে সকাল ১১.১৫ । গাড়ি পার্কিং লট ঘুরে বের হবার মুহুর্তে সামির বলল ওর ওয়াটারগানটা বাড়িতে রয়ে গেছে আর কিশানেরটা ওর হাতেই আছে । অতয়েব, আবার গাড়ি ঘোরাও , মেঝপা তুই দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আয় । নায়লা চারবারের বার বাড়িতে ডুকে খেলনাটা আনে আর সুরা পরে ঘরে তালা লাগায় । সুরা পড়া নায়লার ছোটবেলার অভ্যাস ।
ভিক্টোরিয়া পার্ক ছেড়ে গাড়ি ফোরজিরোওয়ান ধরে এগুচ্ছে, ছোট হোন্ডা সিভিক , সামনের দুই সিটে বসা নুপুর আর মনজুর পিছনে দুই বাচ্চা নিয়ে নায়লা । খোলা গলার গায়িকা মৌসুমি ভৌমিক গান গাইছে , আমি শুনেছি তোমরা নাকি এখনো গল্প লেখো ”। নায়লার মনে পড়ে , ১৯৯২ সাল ঢাকার প্রতিশুতিশীল লেখিকা শাহিন আখতারের সাথে একটি কনফেকশনারীর সামনে দেখা,শাহিন পরিচয় করিয়ে দেয় মৌসুিম ভৌমিকের সাথে,সংগে আছে স্বামী নাজেজ আফরোজ,নাজেজ তখন বিবিসিতে কাজ করে । মৌসুমী ভৌমিক তখনো শিল্পী হয়ে উঠেনি । কালো সাধারন চেহারার একটি মেয়ে মৌসুমি,সাথে একটি বাচ্চা,একটি ক্যাসেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে মৌসুমি বলল শুনে বলো কেমন লাগলো।এর ঠিক একবছর পর মৌসুমি ভৌমিক দুই বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী হয়েছিলো,বিশেষ করে আমি শুনেছি তোমরা নাকি এবং যশোহর রোডের গানটি গেয়ে গোটা তরুন সমাজকে মাত করেছে ও ।আজ টরোন্টো শহরের রাস্তায় মৌসুমির গান বাজছে আর নায়লা ফিরে দেখছিলো প্রায় ১৭ বছর আগের স্বৃতি।এত বয়স হয়ে গেছে নায়লার,কি আশ্চর্ষ সময় এত প্রতারক,এত নিষ্ঠুর,এত অল্প সময়ের জন্য জীবনকে ছুয়ে যায় ।
গাড়ি চলছে তুমুল গতিতে সামনের সীটে বসা নুপুরদের দেখছিলো নায়লা, মাত্র তিনমাসের সন্তানসম্ভবনা ছোটবোনটি । চারবোনের মধ্যে মাঝের দুবোন টরোন্টোতে থাকে।নুপুর এসছে বছর চারেক আগে আর নায়লা তো সবে এই শহরের জীবন শুরু করলো তাই নায়লাকে নতুন দেশ দেখানোর ভীষন আগ্রহ নুপুর আর মনজুরের । ওরা দুজনেই নায়লাকে মেঝপা ডাকে । নুপুরের ছেলে কিশান নায়লাকে ডাকে মেজআম্মু ।মানুষের জীবনে প্রাপ্তির যেমন শেষ নেই তেমনি নীল বেদনাও ছুয়ে থাকে জীবনজুড়ে ।
গাড়ি পিকারিং,এ্যাজাকস,অশোয়া ছাড়িয়ে হাইওয়েতে উঠেছে ,শহরের আবরন ছেড়ে ক্রমাগত নীরব এলাকা চোখে পড়ে,কে বলে শষ্য শ্যমলা বাংলাদেশ তাহলে এসব দেশের সবুজ আর প্রকৃতি নিশ্চয়ই কবি দেখেননি। নায়লা একদিনের এই ট্যুরে সাথে নিয়েছে প্রিয় কাগজ কলম । সময় নাকি খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়,তাই যতটুকু ধরে রাখা যায় স্বৃতির পাতায় ।
মনজুরের গাড়ি থামে চেকপোষ্টের মতো একটি জায়গায়,ওখানে কতর্ব্যরত কর্মী জানিয়ে দেয় প্রয়োজনীয় তথ্য অর্থ্যাৎ কত নন্বর স্পটে তাবু লাগানো যাবে,কোথায় কি কি পাওয়া যাবে । নুপুর বুদ্ধি করে একটি ম্যাপও চেয়ে নেয় । এরপর হোন্ডা সিভিকটা ডুকে যায় জংগলের ভিতর , কিন্তু কি আশ্চর্ষ জংগল হলে কি হবে নায়লা পরিস্কার বোঝে এটি একটি পরিকল্পিত জংগল । ছোট ছোট খুটি দিয়ে রাস্তার লোকেশন দেয়া আছে ,এমনকি চমৎকার পাবলিক টয়লেট দিয়ে নিখুত হাতে সাজানো হয়েছে অরন্যটিকে । নায়লার আবার মনে পড়ে যায় পিছে ফেলে আসা দেশের স্বৃতি । বেসরকারী সংস্থায় কাজ করার কারনেই বাংলাদেশের মধ্যে প্রচুর ঘোরার সুযোগ হয়েছে ওর । আর কি দুঃসহ ভয়াভহ এলামেলো সেসব স্বৃতি,একে তো দেশে রাস্তায় বের হওয়া মানেই প্রতিমুহুর্তের অনিশ্চয়তা , আদৌ মানুষ বেচে বাড়ি ফিরবে কিনা তা কেউ জানে না অন্যদিকে রয়েছে অব্যবস্থা । দেশের প্রধান প্রধান বাস টার্মিনাল যেমন, গাবতলী , ফুলবাড়ি, যাত্রাবাড়ি এবং কমলাপুর রেলস্টেশন এর মতো জায়গার অভিঞ্জতাও যদি কারো থাকে সে জানবে যে এর চেয়ে নরক ভালো ।
যাক সেসব কথা,অরন্যর ভিতর ১১৮ নং লোকেশনটা বরাদ্ধ করেছে মনজুর । ৩৩ বছরের তরুন এই বোনজামাইটা সারাক্ষন আনন্দ উত্তেজনা দিয়ে ভরা । কোন ক্লান্তি বা বিরক্তিবোধ যে ওর ভিতরে আছে এটা অনেকেই মানে না,মনজুর মানেই উৎসাহী তরুন । বন্ধুমহলে তাই মনজুরের কদরও কম না ।
গাড়িটা জায়গামতো পার্ক করেই নুপুর গাড়িতে সিডি বাজিয়ে দেয় , ’যে ছিলো দৃষ্টির সীমানায় যে ছিলো হদয়ের আংগিনায় সে হারালো কোথায় কোন দুর অজানায় সেই চেনামুখ কতদিন দেখিনি ” । আহ শাহনাজ রহমতউল্লাহ,এমন কালজয়ী শিল্পী বাংলাদেশে অদ্বিতীয় । এমন পরিবেশে এত সুন্দর গান শুনলে জীবনের সব কামনা বাসনা জেগে উঠে, প্রিয়জনকে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরে উøতা পাবার এই তো সময় । শাহনাজের গলায় এমন উজাড় করে ভালোবাসার কথা বলার পর কি আর কিছু বলার থাকে,চারিদিকে অপুর্ব সুন্দর প্রকৃতি,সামনে নীল পানির আদিগন্ত দৃশ্য,মনজুর ইচ্ছে করে সমুদ্রের পাড়ের এই লোকেশনটি বেছে নিয়েছে।নায়লার মনের ভিতরটা পরিপুর্নতায় ভরে উঠে,মনে হয় জীবনের কাছে আর চাইবার কিছু নেই । থাকুক না কিছু দুঃখ,দুঃখের অবারিত স্রোতকে পাশ কাটাবার জন্যই তো এতদুর দেশে আসা তবুও কেন আনন্দের মুহুর্তগুলোতে এমন কষ্টের হয়ে উঠে,নাকি গভীর দুঃখ না থাকলে সুখকে উপভোগ করা যায় না । নায়লা এবার অন্যদিকে মনোযোগী হয়ে উঠে । সামির আর কিশানের বয়স প্রায় সমান, একজন ৪ অন্যজন ৫ , দুজনেই পাগলের মতো মজা করছে । কিশান অনেকটা দেবশিশুর মতো দেখতে , মুলত মনজুরের মা ভীষন সুন্দর দেখতে , অবিকল খালাম্মার মুখটা বসানো কিশানের মুখে । কিশান নায়লার হাত ধরে বলে , মেজআম্মু ওই দিকে আসো আমরা ওখানে যাবো । নায়লা যখন প্রথম এই শহরে আসে তখন কিশান আধো আধো বোলে বাংলা বলতো এখন সামিরের সাথে থেকে অনেকটাই সাবলীল বাংলা বলতে পারে।
মধ্য দুপুর , বেলা প্রায় ১ টা, মনজুর আর নুপুর মিলে চোখের পলকে তাবু টাঙিয়ে লোকেশনটাকে নিজের করে তুলল । স্যাটেলাইট চ্যানেলের কারনে ঢাকায় টিভিতে দেখেছিলো বিদেশে মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে ক্যাম্পিং করে,আজ তা নিজেই তা করছে । জীবন কি ভিষন সুন্দর আর স্বপ্নীল হতে পারে যদি একটু উপভোগ করার সুযোগ থাকে মানুষের । না আর না , এবার গাড়িতে উঠো সবাই , মনজুর বাচ্চাগুলোর পিঠে চাপড় দেয় , কুইক গাইস, কুইক আসরা সুইমিং এ যাবো । নায়লা, নুপুর তাড়াহড়ো করে , গাড়িতে সীটবেল্ট বাধতেই আবার মৌসুমির গান , আমার কিছু কথা ছিলো । কি অপুর্ব জলরাশি , একজন দুজন মানুষ হাফপ্যন্ট পড়ে ঘুরছে নিকানো পরিপাটি প্রকৃতি যেন সাজিয়ে বসে আছে আগমন বার্তা নিয়ে । চারিদিকে দিগন্ত বি¯তৃত পানি আর যতদুর চোখ যায় গহীন অরন্য । নায়লা পানিতে পা দেবার সাথে সাথে মনে পড়ে যায় দেশে ফেলে আসা কাপ্তাই হদের কথা । এইতো গতবছর গিয়েছিলো নায়লারা দলবেধে রাঙামাটিতে কি অপুর্ব সুন্দর কাপ্তাই , প্রকৃতি যেন উজাড় করে ভালোবেসেছিলো রাঙামাটিকে ,নায়লা জানে বিশ্বের যত সুন্দর দেশেই ও যাক এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারবে না প্রিয় মাতৃভুমির কথা ।
কেমন ঝুপ করে শান্ত দুপুরটা চলে এলো, সবাই মিলে পানিতে ঝাপাঝাপি করে এইমাএ তাবুতে ফিরে এলো ,গতরাতেই নায়লা ডিমভুনা আর নুডুলস করে রেখেছিলো, সকালে ঘুম থেকে উঠেই নুপুর খিচুড়ি চড়িয়ে দিয়েছিলো । এখন এই ক্ষিদে পেটে সামান্য খিচুড়ি আর ডিমভুনা মনে হচ্ছে অমৃত । সন্ধ্যার আয়োজনে বিদেশী স্টাইলে রয়েছে বার বি কিউ ,এখন টরোন্টোতে সামার চলছে দিনের আলো থাকে রাত দশটা অব্দি । ঠিক এই মুহুর্তে নায়লার মনে পড়ে যায় অন্য একটি স্বৃতির কথা , যদিও সেই জীবন এখন নিষিদ্ধ অতীত তবুও তো সত্যি । আর জীবনে ঘটে যাওয়া সব সত্যিই তো জীবনের ই অংশ । ১৯৯৮ সাল , নায়লার স্বামী লন্ডনের সোয়ানজিতে এসছিলো একটি শর্টকোর্সে সেই সুযোগে নায়লাও জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমনটা করে নেয় । টানা দেড়দিনের জার্নি শেষে যখন নায়লা হিথরো বিমানবন্দরে যখন নামে তখন দুপুর তিনটা , লন্ডনের কান্ট্রিসাইড সোয়ানজি হিথরো থেকে আরো সাতঘন্টার জার্নি । নায়লা যখন সোয়ানজিতে গিয়ে পৌছে তখন রাত দশটা অথচ কি সুন্দর ঝকঝকে বিকেল ছিলো সেই দিনটিতে । আজ প্রায় ৮ বছর পর নায়লার সামনে সেই স্বৃতিটা এমন করে ভেসে উঠলো কেন।
দুপুর তিনটা মতো হবে ,তাবুতে ঘুমিয়ে পড়েছে নুপুর,দু বাচ্চা আর মনজুর। নায়লা বসে আছে কাগজ কলম নিয়ে,স্বৃতি আক্রান্ত মানুষ তাই স্বৃতি তৈরীর চেয়ে পুরোন স্বৃতিতে ভেসে বেড়ানোতেই আনন্দ বেশী । কোন জীবনকে প্রত্যাশা করে মানুষ ? কেন তৃপ্তি হয় না মানুষের ? কিসের ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করতে ছুটে বেড়ায় মানুষ ? নানান প্রশ্ন আলোড়িত করে মনকে। ঢাকাতে সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লারা বইতে কানাডা নামে একটি দেশের বিবরন পড়েছিলো নায়লা , আজ এই শান্ত বিকেল হয়ে আসা নীরব দুপুরে কোন দুর অতীতে চলে যায় ও । নায়লা বসে আছে একটি কাঠের টেবিল চেয়ারে ,বিকেল ৬টা মতো হবে । দুজন বৃদ্ধ মহিলার সাথে এইমাত্র আধাঘন্টা আলাপ করে এলো ও,সুজান আর মর্ন । মর্নের বয়স প্রায় ৭৫ চামড়া কুচকে গেছে কিন্তু জীবনকে উপভোগ করতে জানে, তাইতো বন্ধু সুজানের সাথে ক্যাম্পিং করতে বেড়িয়েছে মর্ন । তাবু থেকে টুকটুক করে বেড়িয়ে পড়েছে বাচ্চারা , পড়ন্ত বিকেল ,চারিদিকে রুপোলী আলোর আভা, মনজুর আর নুপুর তাগাদা দেয় এখুনি বের হতে হবে অরন্য দেখতে, কোন অজুহাত খাটবে না । ২০ মিনিটের ড্রাইভে লোকেশনটা ঘুরে আসতেই নায়লা টের পায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে । চারিদিকে স্তব্ধ নীলিমা , আকাশ যেন আর কিছুক্ষন পড়েই অন্ধকারের চাদর পড়বে এই শেষ হয়ে আসা আলোটুকুই সম্বল এরই মধ্যে শেষ করতে হবে তাবুতে কাটানো একটি রাতের গল্প । নায়লা দেখতে পায় দুরে বার বি কিউ এর লাল আলো জল্বছে , টরোন্টো শহরে একটি অন্য জীবন শুরু হয়েছে নায়লার যেখানে নীল বেদনার মতো অতীত আছে আবার একটি ভিন্ন মাত্রার জীবন শুরুর আনন্দও আছে । নায়লা সব অনুভুতিগুলোকে সাথে নিয়ে আগুনের উত্তাপে সন্ধ্যার আয়োজনে নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়।
লুনা শীরিন , টরোন্টো ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



