বছরের একেবারে শেষ প্রান্তে ২০০৭-এর ২৬ ডিসেম্বর মারা গেলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। বাংলাদেশের বই প্রকাশনা ও বই মেলার ইতিহাসে চিত্তরঞ্জন ও পথিকৃৎ শব্দ দুটি একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেছে স্বাধীনতার পরপর, সেই নতুন বাংলাদেশে।
ইতিহাসে বহু কৃতী মানুষ আসেন, তাদের কাজ মানুষ মনে রাখেন। বছরের পর বছর তাদের শ্রদ্ধা জানান। কিন্তু কাজ শুরুর সুযোগ খুব কম মানুষের হয়। তারা পথিকৃৎ। প্রথম পর্বত চূড়া জয়, প্রথম বারের মতো নতুন দেশ, নদীর উৎস, সাগরের তলদেশের রহস্য আবিষ্কারের মতোই তাদের অবদান। প্রথম বারের মতো কিছু করতে হলে, ভবিষ্যৎকে এক নজরে দেখে ফেলতে হয়। প্রথম পা ফেলতে হয় সেই তাৎপর্যকে ধারণ করেই যে, এখানে এক দিন দীর্ঘ একটি রাস্তা তৈরি হবে। চিত্তরঞ্জন সাহা তেমনই একজন মানুষ। বাংলাদেশের বইয়ের জগতে বহু পদক্ষেপ তিনিই প্রথম ফেলেছিলেন।
মাস খানেক পরই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হবে অমর একুশে বই মেলা। স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর এ বই মেলাটি শুধু বই বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র নয়। এটি হলো ফেব্রুয়ারির রক্তদানের স্মৃতিকে ধারণ করা এক মাসের এক স্মরণ উৎসব। রীতিমতো এক মাসের একটি পর্ব। বাংলাদেশে বই ও প্রকাশনা কেন্দ্রিক যতো উৎসব আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আয়োজনও এটি।
বই মেলাকে ঘিরেই পুরো বছরের প্রকাশনা পরিকল্পনা তৈরি করেন দেশের প্রকাশকরা। বই মেলার গতি বুঝেই বই বিপণন করেন তারা। প্রতি বছর একটি মেলাকে ঘিরে এ দেশের প্রায় নব্বই ভাগ বই প্রকাশিত হয়। পাঠকরাও বছরভর অপেক্ষা করেন এ মেলার জন্য। প্রতিদিন হাজার পাঠকের সমাগম ঘটে। ফলে বাংলাদেশের মানুষের পাঠাভ্যাস, মনন ও সৃজনশীলতার বহু ঘটনার সাক্ষী এ বই মেলা। বই মেলা এখন লেখক পাঠক প্রকাশকের উৎসব থেকে বাংলাদেশের মানুষের সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বই মেলা তিলে তিলে তিলোত্তমা হয়েছে। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে, এ বই মেলার শুরুর দিনটা কেমন ছিল? আমাদের গর্বের এ মেলাটি কে শুরু করেছিলেন? নতুন প্রজন্মকে এ প্রশ্নের উত্তরটা জানতে হবে আবার পথিকৃৎকে সম্মান জানানোর জন্য কর্তাব্যক্তিদেরও খোজ-খবর নিতে হবে।
প্রথম বই মেলার শুরুর দিনটার ছবি একটু কল্পনা করা যাক। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। মাত্র ৫৪ দিন আগে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ঢাকার রাস্তাঘাট, বাজার, হসপিটালে যুদ্ধের দগদগে স্মৃতি তখনও স্পষ্টভাবে লেগে আছে। দেশের মতোই যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষের মন। নতুন স্বপ্ন আছে কিন্তু বাস্তবে জীবন ধারণের কঠিন এক সংগ্রামে ব্যস্ত সবাই। দৈনন্দিন নানা চিন্তার পাশাপাশি সে সময়টাই আবার ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর। নতুন করে গড়ে তোলার। নির্মাণের।
অন্য ক্ষেত্রের মানুষেরা কেমন চিনেছিলেন সেই সময়টাকে তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কিন্তু চিত্তরঞ্জন সাহা ঠিক বুঝেছিলেন। তিনি ওই দিন বাংলা একাডেমি কর্মকর্তাদের কাছে অনুমতি নিয়ে বটতলায় বই নিয়ে বসেছিলেন। টেবিল চেয়ারের আয়োজন ছিল না বলে চট কিনে তাতে বই সাজিয়েছিলেন। ওই দিনই হলো আমাদের বই মেলার উদ্বোধন।
এখানে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, নয় মাসের যুদ্ধের মাত্র ৫৪ দিন পর কোথায় বই পেলেন চিত্তরঞ্জন? ১৯৭১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ থেকে আগরতলা হয়ে কলকাতায় যান চিত্তরঞ্জন সাহা। কলকাতায় তখন বাংলাদেশের বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক আশ্রয় নিয়েছেন। কলকাতায় গিয়ে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন। শরণার্থী লেখকদের ৩২টি মুক্তিযুদ্ধের বই প্রকাশ করেন। সেদিন এটা শুধু শরণার্থী লেখকদের কাজ জুটিয়ে দেয়ার ব্যাপার ছিল না। কিংবা বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণার একটা শক্তিশালী ব্যবস্থা ছিল না।
এটা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক বাংলাদেশি প্রকাশকের প্রথম প্রকাশনা উদ্যোগ। ওই ৩২টি বইই ছিল বাংলাদেশের জন্মের সময়ে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অভিব্যক্তি। আর কলকাতায় প্রকাশিত ও সেখান থেকে বয়ে আনা ওই বইগুলোই ছিল ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির বই মেলায় বিক্রির জন্য আনা প্রথম বই। কলকাতায় যে প্রকাশনা সংস্থা থেকে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছিল তার নাম মুক্তধারা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকেই চিত্তরঞ্জন তার প্রকাশনা সংস্থার এমন নাম বেছে নিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে শুরু করে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত প্রায় একাই একাডেমি প্রাঙ্গণে বই মেলা চালিয়ে যান চিত্তরঞ্জন। ১৯৭৬ সালে অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়ে তার সঙ্গে যোগ দেন। অবশেষে সঙ্গী জুটলো। এর দু’বছর পর ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী মেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমিকে সরাসরি সংযুক্ত করেন। জাতীয় গ্রন্থ উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় এ মেলাটি আয়োজিত হয়। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এ সংস্থাটিও সংগঠিত করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।
প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য এ প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি বই মেলার সক্রিয় অংশগ্রহণকারীরাও এ সংস্থাটির সদস্য। ১৯৮৪ সালে মেলার নাম দেয়া হয় বাংলা একাডেমি বই মেলা। ১৯৮৫ পর্যন্ত এটা ছিল শুধু বইয়ের মেলা। কিন্তু ১৯৮৫ থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে এটি প্রায় বারোয়ারি মেলায় পরিণত হয়। উদ্যোগ নেয়া হয় আবার এটিকে শুধু বইয়ের মেলায় পরিণত করার। সে উদ্যোগ সফল হয়। ২০০২ সালে এ বই মেলার নাম হয় অমর একুশে বই মেলা। চিত্তরঞ্জন সাহার শুরু করা বই মেলার এই হলো সংক্ষিপ্ত টাইম লাইন।
সাধারণ চোখেই প্রকাশক হিসেবে চিত্তরঞ্জন সাহার প্রকাশক জীবনের দুটি পর্ব খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এ পর্ব দুটির নাম দেয়া যায় পুথিঘর ও মুক্তধারা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে চিত্তরঞ্জনের জমজমাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল পুথিঘর। পুথিঘর নামটি এখন স্কুল পড়ুয়াদের কাছে কিছুটা অপরিচিত নাম হলেও একদা স্বাধীনতার আগে তো বটেই পরেও পুথিঘর ছিল স্কুলের পাঠ্য বইয়ের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। পাঠ্য বই, নোট বই আর টেস্টপেপারের জন্য বিখ্যাত এ প্রতিষ্ঠানটির একচেটিয়া ব্যবসা ছিল দেশ জুড়ে।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, এ প্রতিষ্ঠানটির অফিস ছিল নোয়াখালীতে। পরে ব্যবসা বড় হলে অফিস ঢাকায় নিয়ে আসেন চিত্তরঞ্জন। ফারজগঞ্জে বড় আকারে পুথিঘর লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতার পর সেখানেই শুরু হয় মুক্তধারা প্রকাশনী।
মুক্তিযুদ্ধের আগে পুথিঘর প্রকাশিত সাহিত্য-শিল্পের বই ছিল সামান্য কয়টি। কিন্তু স্বাধীনতার পর মুক্তধারা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ক প্রকাশনার প্রধান আশ্রয়স্থল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকের লেখকদের মধ্যে যে প্রাণচাঞ্চল্য ও সৃষ্টির তাড়না দেখা দেয় তার প্রায় সবটুকুকেই আলোর মুখ দেখায় মুক্তধারা।
বহু নতুন লেখকের উত্থান ও বিকাশ ঘটে মুক্তধারার মাধ্যমে। অনেক বিখ্যাত লেখকের প্রথম বইয়ের প্রকাশকও মুক্তধারা। শুধু লেখকই নয়, পাঠকের দিকেও দৃষ্টি ছিল মুক্তধারার। স্বাধীনতার পর কম দামের কাগজে বই ছেপে সেটাকে পাঠকের ক্রয় সীমার মধ্যে রাখতে পেরেছিল মুক্তধারা। সাদামাটা এক বা দুই রঙের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বা কামরুল হাসানের আকা গভীর কালো রেখার কাজ। হলদেটে নিউজপ্রিন্টে ছাপা লেটার প্রেসের অক্ষর। এ কাগজের নাম ছিল লেখক কাগজ। এ কাগজেই ছাপা হতো মুক্তধারার কম দামের বইগুলো। বাংলাদেশের পাঠকের ক্রয় সীমা অনুসারে মুক্তধারা আঙ্গিকের বই ছিল আদর্শ। কিন্তু আশির দশকের পর হঠাৎ করেই অফসেট প্রেসে অফসেট কাগজে রঙচঙে ছাপা বইগুলো পাঠকের ক্রয় সীমাকে অতিক্রম করে যেতে থাকে। বইয়ের কন্টেন্ট থেকে প্রকাশক-পাঠকদের নজর সরে যেতে থাকে আঙ্গিকের সৌষ্ঠবের দিকে। কাগজ, কালি প্রেসের খরচও বাড়তে থাকে। প্রকাশনা জগতের এ উল্লম্ফন আমাদের পাঠাভ্যাস ও বইয়ের বাজারকে সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হতে দেয়নি। মুক্তধারার পথে এগিয়ে গেলে হয়তো আরো স্থিতিশীল একটি প্রকাশনা শিল্পের দেখা পেতাম আমরা। প্রকাশনা জগতের হঠাৎ রঙ পরিবর্তনের সঙ্গে মুক্তধারা তাল মেলাতে পারেনি। ফলে শেষ দিকে তাই মুক্তধারা ছিল পুরনো বইয়ের দোকান। বই মেলায় তাদের উপস্থিতি বা নতুন বই প্রকাশ তেমন একটা নজরও কাড়েনি। কয়েকটি প্রজন্মের লেখকদের উত্থান পর্বকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নতুন আর কোনো লেখক বা পাঠক গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে পারেনি মুক্তধারা। ফলে মুক্তধারা উজ্জ্বলতা ২০০০ সালের পর প্রায় ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রকাশনার জগতে স্থান করে নিয়েছে, আলোচিত হয়েছে নতুন প্রকাশকরা। কিন্তু চিত্তরঞ্জন সাহা ও মুক্তধারা যে পথ তৈরি করে দিয়ে গেছেন তার তুলনা বাংলাদেশে নেই। ফলে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ ও বই মেলাকে মনে রাখতেই হবে সেই পথিকৃতের অবদান।
চিত্তরঞ্জন মারা যাওয়ার পর বাংলাবাজারে আনা হয়েছিল তার মরদেহ। সেদিন বাংলাবাজার, নর্থব্রুক হল রোড ও প্যারিদাস রোডের সব প্রকাশনা সংস্থা ও বই বিক্রির দোকান বন্ধ ছিল তার প্রতি সম্মান জানিয়ে। চিত্তরঞ্জনের জন্ম হয়েছিল ১৯২৭ সালের পহেলা জানুয়ারিতে। বাবার নাম কৈলাশ চন্দ্র সাহা। মায়ের নাম তীর্থবাসী সাহা। জন্মস্থান নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার লতিবপুর। ছয় ভাই বোনের মধ্যে চিত্তরঞ্জন ছিলেন দ্বিতীয়। পৈত্রিকভাবে তাদের বারোয়ারি ব্যবসা ছিল। ১৯৫১ সালে পরিবারের অমত থাকা সত্ত্বেও নোয়াখালীতেই বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে স্ত্রীর নামে ছাপাঘর নামে একটি প্রেস স্থাপন করেন। ১৯৫৭ সালে বাধাইঘর নাম দিয়ে বই বাধাইয়ের কাজ শুরু করেন। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পুথিঘর। মৃত্যুর পর জন্মস্থানেই শেষকৃত্য করা করা হয় চিত্তরঞ্জন সাহার।
শুধু বাংলা একাডেমির বই মেলা নয়। মুক্তধারার আয়োজনে বিভিন্ন সময় জেলা পর্যায়ে বই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বাইরের পাঠকদের জন্য বই মেলার আয়োজন করে মুক্তধারা।
পাঠকদের জন্য নানা পুরস্কারের আয়োজন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। লেখকদের জন্য আয়োজন করেছিলেন মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে সাহিত্য পুরস্কার। ২০০৫ সালে চিত্তরঞ্জন সাহা একুশে পদকে ভূষিত হন। তিনি বাংলাদেশের পাঠক ও বিদ্বৎ সমাজের কাছে যে শ্রদ্ধার আসন পেয়েছেন তা হয়তো তার জীবনের সেরা পুরস্কার। কিন্তু রাষ্ট্র ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর
পুরস্কার ও স্বীকৃতিও গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোই গর্বিত হতে পারে।
চিত্তরঞ্জন সাহার হাত দিয়েই শুরু হয়েছিল অমর একুশে বই মেলার। এ বছরের মেলা আয়োজনে তাকে স্মরণ করতে পারা তাই একুশে বই মেলার জন্যই গর্বের একটি বিষয় হতে পারে। আমাদের প্রস্তাব হলো, এবারের অমর একুশে বই মেলার পুরো মাসটিকে চিত্তরঞ্জন সাহার স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা হোক। বই মেলাটির থিম করা হোক মুক্তধারা ও চিত্তরঞ্জন সাহাকে।
আজকের যায়যায়দিনে প্রকাশিত

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


