রাজউক-এর বিড়ম্বনা ও আমলাতান্ত্রিক জটিল আবর্তে যারা একবার পড়েছেন, তারা রূঢ় বাস্তবতায় এই সত্যে উপনীত হয়েছেন যে, রাজউক হচ্ছে, সরকারের ভেতর আর একটি সরকার;- এ গবর্নমেন্ট উইদিন এ গবর্নমেন্ট। সংবিধান সংশোধন হয়েছে, রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সাবেক ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা ডিআইটি-কে সেই এককেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক সরকার এরশাদের শাসনামলে রাজউক-নামের যে রাজকীয় মেজাজের আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও রাষ্ট্র-সরকারের প্রশ্রয়ে ভূমিদস্যু হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল, তার কোন সংস্কার হয়নি। বরং এই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষমতায়, স্বেচ্ছাচারিতায়, দুর্নীতিতে এবং অস্বচ্ছতায় রাষ্ট্র-সরকারের অধীনে একটি স্বেচ্ছাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার দাপট চালিয়ে আসছে।
রাজউক- মানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবে উন্নয়ন' বাদের রাজকীয় কর্তৃপক্ষীয় মেজাজ ও দাপট রাজউক ঠিকই দেখিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন'-এর বদলে রাজউক- রাজধানীকে একটি- বিশাল বস্তি এবং যানজটের গ্রামে পরিণত করে তুলেছে। উন্নয়নের সাথে পরিকল্পনার যোগসূত্র থাকে। আর পরিকল্পনার দর্শন হচ্ছে বৃহত্তর জনগণের কল্যাণ, দেশ ও জাতির সুন্দর আধুনিক ও শিল্পীত নগরী নির্মাণের প্রেরণা। ১৯৭১ সালে যে ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক লাখ, সেখানে ৩৮ বছরে ঢাকা মহানগরীর লোকসংখ্যা প্রায় দেড় কোটিতে পৌঁছেছে। জনসংখ্যার এই হার ক্রমবর্ধমান। জাতীয় পর্যায়ে উন্নয়নের যে এককেন্দ্রিকতা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক অভিঘাতে তাড়িত জনগোষ্ঠীর বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়ন-পুনর্বাসন না হবার ফলে রাজধানী ঢাকা আরো ব্যাপকভাবে জনস্ফীতিতে তলিয়ে যাবার আশংকা রয়েছে। ঢাকা এখন সময়ের বিবর্তনে একটি স্বাধীন দেশের গর্বিত রাজধানী। দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মেট্টোপলিটন মহানগরীর বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র ধারণ করতে না পারলে ঢাকা এক বিপন্ন বস্তি নগরী হিসেবে পরিগণিত হবে। নিশ্চিতভাবেই ঢাকাকে মেট্টোপলিটন মহানগরীর অবয়ব দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করার কথা রাজউক-এর। কিন্তু রাজউক সরকারি পর্যায়ে দেশের বৃহত্তম রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতারণা ও ভূমিদস্যুতার দুর্নাম নিয়ে টিকে থাকা জনগণের কাছে এক আতংক ও অভিশাপের প্রতীক হয়ে উঠেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যেখানে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সকল খাত সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে ব্যক্তিপর্যায় ও বেসরকারি খাতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রাজউক-এর হাতে বৃহত্তর রিয়েল এস্টেট ব্যবসা কেন্দ্রীভূত রাখার নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিগত এক-দেড় দশক ধরে চেষ্টা করেও সরকার মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবাহ অতিক্রম করে টিসিবি-কে বাজার অর্থনীতির নিয়ামক হিসেবে আগের অবস্থানে নিতে পারেনি। অথচ পাকিস্তান আমলের আইউবী ধারার ডিআইটি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের এরশাদীয় স্বৈরতান্ত্রিক আমলের বিবর্তিত রাজউক-আজও তার পুরনো খোলস ও কাঠামো নিয়ে মহাদাপটে আইনী বৈধতার প্রশ্রয়ে ভূমিদস্যুতার তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পর সরকার এসেছে, কিন্তু রাজউক-এর নিপীড়ন ও আমলাতান্ত্রিক দুর্গতি থেকে ঢাকার মানুষ মুক্তি পায়নি। কেননা রাষ্ট্র সরকারের যারা নীতি নির্ধারক, তারাও রাজউক নামের পরশমনি হাতে পেয়ে আত্মহারা হয়ে পড়েন।বছর কয়েক আগে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন রাজউক ভবনে গণ-শুনানী করে তাৎক্ষণিকভাবে জনগণের সমস্যার সমাধান দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অবশ্য তার আগে সাবেক বিএনপি সরকারের পূর্তমন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলামও গণ-শুনানীর ব্যবস্থা করেছিলেন। এই উদ্যোগের একটা মিডিয়া পাবলিসিটির মূল্য রয়েছে।তবে কিছুদিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদ্বয়ের উদ্যোগে ভাটা পড়ে। রাজউক-এর সাথে সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী জনগণ আবার আগের মতোই রাজউক-এর খোঁয়াড়ে বন্দী হয়ে পড়েন। সংসদীয় সরকারের আমলে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির এককেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক কালচারে গড়া রাজউক-এর পুনর্বিনাস করা তিনি জরুরি মনে করেন কিনা? মন্ত্রী আমার প্রশ্ন শুনেও না শোনার ভান করে এড়িয়ে যান রাজউক-এর সাংগঠনিক কাঠামো, ক্ষমতার পরিধি এবং জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিরূপণে যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা অপরিবর্তিত রেখে এই সংস্থাকে স্বচ্ছতা ও জনকল্যাণমুখী করা সম্ভব নয়। রাজউক-এর দীর্ঘকালীন চেয়ারম্যান, যিনি ঐ সংস্থার কাছে একজন লৌহমানব' হিসেবে নিজের ইমেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই ভদ্রলোককে এরশাদ শাসনামলে একবার দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হয়েছিল।রাজউক-এর রাজারা ধরা পড়ছেন'- শীর্ষক আমার ঐ লেখাটি রাজউক-এর তদানীন্তন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার সাক্ষ্য হিসেবে নথীভুক্ত করা হয়। তবে ঐ ডাকসাঁইটে রাজউক- চেয়ারম্যানকে বেশিদিন জেলে আটকে রাখা যায়নি। প্রেসিডেন্ট এরশাদের প্রশাসনের দুর্নীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে তদারকীর দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ব্রিগেডিয়ারের সাথে আমার আলোচনায় মনে হয়েছে যে, যে কোন কারণেই হোক, রাজউক চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট এরশাদের কনফিডেন্স হারিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন। তবে অন্য চেয়ারম্যানরা এরপর থেকে বেশ সতর্ক ও সাবধানী হয়ে গেছে। সৎ ও সজ্জন চেয়ারম্যানও আছেন। যদিও রাজউক-এর জঞ্জালের আবর্তে পড়ে কোন চেয়ারম্যানই আর ব্যক্তিগত সততা দিয়ে ইতিহাস তৈরি করতে পারছেন না। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি-রাজউক-এর কাঠামো, ক্ষমতার পরিধি ও স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে বিরাজমান প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে তা শোধরানোর কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না, আমরা জানি না।
দুই.
সম্প্রতি এক সহযোগির একটি রিপোর্ট বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। রাজউকের সুদের ব্যবসা' শীর্ষক ঐ রিপোর্টে যে সব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে, তা যদি কোন বেসরকারি রিয়েল এস্টেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রকাশিত হতো, তাহলে সরকার প্রশাসনিকভাবে শুধু তদন্ত কমিটিই গঠন করতো না, এতদিনে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদেরও জেলের ঘানি টানতে হতো। কিন্তু আমরা জানি না, এ রিপোর্টে সরকারের পক্ষ থেকে আদৌ কোন আইনগত প্রক্রিয়া নেয়া হয়েছে কিনা। সরকারের গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর দফতর কিংবা দুদক-এর ধীমান কর্তাব্যক্তিদের চোখে এ রিপোর্টটি পড়েছে কিনা, তা আমাদের জানার কোন সুযোগ ঘটেনি। এমনকি খোদ রাজউক থেকেও এর কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এর দু'রকম অর্থ হতে পারে। হয়, রাজউক-- রিপোর্টের বক্তব্যটি আমলে নেয়নি। অথবা রিপোর্টে উল্লেখিত তথ্য- উপাত্ত এতটাই সঠিক যে, এ নিয়ে প্রতিবাদ বা স্বীকার করার সৎসাহস তাদের নেই। প্রকাশিত রিপোর্টের কিয়দংশ উদ্ধৃত করছি পাঠকের আগ্রহ নিবৃত্তির জন্য। এতে বলা হয়েছে : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উত্তরা ও পূর্বাচল প্রকল্পের প্লট বরাদ্দের জামানতের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে রেখে সুদের ব্যবসা করছে রাজউক। দুই দফা সময় বাড়ানোর কারণে আবেদনকারীদের জামানতের টাকা অনেকের তিন মাস এবং অধিকাংশের সাত মাস ধরে পড়ে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত, প্রায় সাত হাজার প্লটের বিপরীতে ১ লাখ ৬৮ হাজার আবেদন জমা পড়ে। এই টাকা আর কতদিন এভাবে আটকে থাকবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। এই বিপুল অর্থ সর্বনিম্ন তিন মাসও যদি ব্যাংকে আমানত রাখা হয়, তাহলে ৫০ কোটি টাকা সুদ আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, প্লট না পাওয়া আবেদনকারীদের জামানতের টাকা ফেরত পেতে কমপক্ষে ২-১ বছর পার হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে পরের ধনে রাজউক-এর সুদ হবে কয়েকশ' কোটি টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, এই টাকার স্বত্ব কার? রাজউক কোন আইন ও বিধিতে দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের জামানতের টাকার সুদ ভোগ করবে? স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতির প্রশ্নটি বিবেচনায় রাখলে প্লট না পাওয়া আবেদনকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার সময় ব্যক্তিগত আমানতের বিপরীতে ব্যাংক হিসেবে যে সুদ পুঞ্জীভূত হবে, রাজউক-এর সার্ভিস চার্জ (যদি থাকে) কেটে তা আবেদনকারীদের ফেরত দেয়া। কিন্তু লাখ লাখ মানুষকে প্লট দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল অর্থের জামানত আদায় করে রাজউক যে নীতিহীনতা ও প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে, নৈতিক বিচারে ও আইনী বিবেচনায় তা দন্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিৎ। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাগরিকদের কাছে লোভনীয় প্লট বরাদ্দ দেয়ার সুযোগ রাজউকেরই আছে। আর সে কারণেই উত্তরা ও পূর্বাচল প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের আবেদন করা মাত্র তীব্র আবাসিক সংকটে জর্জরিত স্বদেশী ও প্রবাসী নাগরিকরা পঙ্গপালের মতো আবেদন ও জামানতের টাকা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তিটা প্রদান করা হয়েছিল সেনাপ্রধান জেনারেল মইন সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদায়কালে কেন তড়িঘড়ি করে উত্তরা ও পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের রমরমা বাণিজ্য শুরু করা হয়েছে, তা নিয়েও রহস্য রয়েছে। একটি অনির্বাচিত সরকার, সংবিধান যাদের তিন মাসের বৈধতা দিয়েছে তারা গায়ের জোরে দু'বছর ক্ষমতায় থেকে আরও অনেক অনিয়ম ও এখতিয়ার-- বহির্ভূত কাজের সাথে উত্তরা ও পূর্বাচল প্লট বরাদ্দের ঘোষণাটি দিয়েছে। যদিও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদে প্রাজ্ঞ আইনজীবীও ছিলেন। এমনকি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাও একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠা আইনজীবী। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উচ্চকণ্ঠ প্রবক্তা হিসেবে সমাজ যাঁদের সমীহ করে, তাদের কাছে মানুষ স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা আশা করেন। কয়েক মাসের ব্যবধানে যেখানে একটি নির্বাচিত সরকার দেশের শাসনভার নিতে যাচ্ছে, সেখানে তদানীন্তন পূর্ত উপদেষ্টা রাজউক-এর কর্তাভজা সুচতুর আমলাদের প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন কি কারণে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তির পর আরও দু'দফা সময় বাড়ানো হয়েছে। যদিও রাজউক পরিষ্কার করে জানায়নি যে, উত্তরা ও পূর্বাচল প্রকল্পে বরাদ্দ দেবার মতো কি পরিমাণ প্লট রয়েছে। স্বদেশী ও প্রবাসী নাগরিকদের আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়েছে তাদেরকে অন্ধকারে রেখেই। এমনকি প্লট বরাদ্দের ক্রাইটেরিয়া-পদ্ধতি স্থির ও চূড়ান্ত না করেই রাজউক স্বদেশী এবং প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের থেকে ঢালাওভাবে আবেদনসহ জামানতের টাকা নিয়ে কার্যত প্রতারণা করেছে। প্লটের পরিমাণ জানানো হলে এবং তার ক্রাইটরিয়া ও পদ্ধতি অবহিত করলে আবেদনকারীরা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারত। কিন্তু সবাই পাবে অথবা কেউ কেউ পাবে, এমন ভাবনার ওপর ভিত্তি করে সাধারণ মানুষ তাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় রাজউক-এর কাছে জামানত হিসেবে গচ্ছিত রেখেছেন।
তাজ্জব ব্যাপার হচ্ছে, ১ লাখ ৬৮ হাজার আবেদনকারীর কাউকেই রাজউক-প্রাপ্তি স্বীকার করে কোন লিখিত ডকুমেন্ট দেয়নি। জমা দেয়ার সময় আবেদনপত্রের একটি ক্রমিক নম্বর ও তারিখ-জানানো হয়েছে। কয়েকমাস পরে রাজউক-এর সংশ্লিষ্ট বিভাগে খোঁজ নিয়ে প্রাপ্তি স্বীকারপত্রের কথা বললে, জানানো হয় যে, সব আবেদনপত্র রাজউক-এর পরিচালক ভূমি'র কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পরিচালক ভূমি'র দফতরে গিয়ে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। পরিচালক-ভূমি'র পিএ বললেন, পূর্বাচল প্রকল্পে খোঁজ নেন। কিন্তু যারা পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন, কেবল তাদেরই সেখানে যাওয়ার কথা। পূর্বাচল প্রকল্পে প্লটের জন্য যারা নতুন করে আবেদন করেছেন, যাদের আবেদনপত্র এখনও বাছাই প্রক্রিয়ায় বুয়েটে পড়ে আছে, তারা রাজউক-এর পূর্বাচল প্রকল্পে গিয়ে কী করবেন? অর্থাৎ উত্তরা ও পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য এক লাখ ৬৮ হাজার আবেদনকারীর মানসিক প্রশান্তি ও আস্থা অর্জনের জন্য রাজউক কোন তথ্য দিতে পারেনি। রাজউক ভবনে এজন্য কোন বিশেষ তথ্যকেন্দ্রও খোলা হয়নি। উত্তরা প্রকল্পে আদৌ আবেদনকারীদের মধ্য থেকে কেউ প্লট বরাদ্দ পাবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।কেননা অভিজাত এ আবাসিক এলাকায় লটারী করে প্লট বরাদ্দ করা হচ্ছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তাছাড়া দু'দফা সময় বাড়ানোর পরও বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের মর্জিতে আরও আবেদনপত্র জমা হয়নি, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। পুরো বিষয়টিকেই রাজউক অস্পষ্ট করে রেখেছে। অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতার সূত্রেই দুর্নীতির জন্ম হয়। দু'দফা সময় বৃদ্ধির মধ্যে উত্তরা ও পূর্বাচল প্রকল্পে কারা আবেদন করেছেন এবং কাদের জামানত জমা পড়েছে, রাজউক-এর উচিত ছিল কয়েক দফায় তা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রচার করা। এসব তথ্য তারা তাদের ওয়েব সাইটেও দিতে পারে। প্রবাসী অনেক আবেদনকারী আছেন, যাদের পক্ষে সহসা দেশে ফিরে তাদের জামানতের টাকা তুলে নেয়া সম্ভব হবে না। তাদেরকে অথোরাইজ লেটারসহ কোন না কোন প্রতিনিধিকে পাঠাতে হবে। কিন্তু রাজউক কি ফ্যাকড়া বাধায়, তা কেউ বলতে পারছেন না। আবেদনকারীদের মধ্যে যারা প্রবাসী, তাদের তালিকা দেশভিত্তিক আলাদাভাবে প্রকাশ করা উচিৎ। তাছাড়া প্রবাসীদের আবেদন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করলে বিদেশে উপার্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ হবে। প্রবাসীদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে তাদেরকে রাজউক-এর আবাসিক প্রকল্পে আকৃষ্ট করা উত্তম ব্যবস্থা হতে পারে। দেশে একখন্ড জমির টানে অনেকে দেশে বাড়ি বানাতে আরও বিনিয়োগ করবেন এবং অন্যান্য খাতেও বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন।
এদিকে প্রায় দু'লাখ আবেদনকারীর প্রতিজন ১০০০ টাকা করে রেজিস্ট্রেশন ফী জমা দেয়ায় এই খাতে অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। রাজউক ১ লাখ ৬৮ হাজার আবেদনকারীর কাছ থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা নিলেও কাউকে কোন ডকুমেন্ট প্রদান করেনি। ফলে তারা ফুটপাতের হায় হায় কোম্পানির আচরণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজউক যেহেতু পরের ধনে পোদ্দারী করে শ্বেতহস্তী হিসেবে দাপটেই আছে, সে কারণে জামানতের টাকা ফ্যাকড়া তুলে তারা যতো বেশিদিন আটকে রাখবে, ততোই লাভ। আবার যদি এই অর্থ সরকারকে ধার-কর্জ দেয়া হয়, তাহলে তা ফেরৎ পেতে আবেদনকারীদের কয়েক জোড়া জুতোর তলি খোয়াতে হতে পারে। এর আগে ১৯৯৭ সালে উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে আবেদন নেয়া হয়েছিল। দীর্ঘ আড়াই বছর পর ১৯৯৯-এর জুলাইয়ে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। জামানতের টাকা আটকে ছিল আড়াই বছর। পরে অবশ্য এই বরাদ্দ প্রক্রিয়াটিই বাতিল করা হয়।
রাজউক-সূত্র বলেছে, নতুন করে প্লট বরাদ্দের নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু নীতিমালা ও বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারণ না করে আবেদনপত্র আহবান করে দেড় হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা কতটা বৈধ, রাজউক-কর্তৃপক্ষকে তার জবাব দিতে হবে। গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এডভোকেট আবদুল মান্নান বলেছেন, তারা সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে আবেদনকারীদের মধ্যে প্লট বরাদ্দ দিতে চান। সেজন্য কিছুটা সময় দিতে হবে। যারা প্লট পাবেন না, তাদের টাকা যতো দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ ব্যাপারে কালক্ষেপণ করা হবে না।ওকালতি মার-প্যাঁচে জনপ্রতিনিধিত্বের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয় না। ‘সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা'-র ক্রাইটেরিয়াটা ঘোষণা করুন, জনগণ বিচার করবেন। ‘যতো দ্রুত সম্ভব, কথাটা আপেক্ষিক। এসব নীতিমালা যখন বিজ্ঞাপন দেয়ার আগে তৈরি করা হয়নি, তখন নির্বাচিত সরকার ৬/৭ মাসেও কেন তৈরি করতে পারেনি। ঘাপলা কোথায়? প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এখানে নিমিত্তের ভাগী। রাজউক যেভাবে চাইবে, তারা সেভাবেই যাচাই-বাছাই করবে। বাছাই-প্রক্রিয়ার নীতিমালা তৈরি বিলম্ব কেন? গণপূর্তমন্ত্রী নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে নীতিমালা তৈরিতে একমাস বা একসপ্তাহই যথেষ্ট সময়। তাহলে সময়ক্ষেপণের টালবাহানা কেন? নির্বাচিত সরকারের সময়ও যদি রাজউক হরিলুটের ভাগার হয়, তাহলে দিনবদলের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নই হয়ে থাকবে। রাজউক-এর অস্বচ্ছতা ও প্রতারণার হাতে সাধারণ মানুষকে দয়া করে আর জিম্মি করবেন না। অন্তত একজন জনপ্রতিনিধি মন্ত্রীর কাছে স্বৈরশাসনামল বা উদ্বাস্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মন্ত্রী উপদেষ্টার আচরণ কেউ আশা করেন না। এর আগে রাজউক জনগণের আন্দোলনের মুখে বাড্ডা-খিলক্ষেত এলাকার জমি অবমুক্ত করলেও সব জায়গায়ই কিছু না কিছু ফ্যাকড়া বাঁধিয়ে রেখেছে। রাজউক যেন সরকারের ভেতরে আর একটি সরকার হিসেবে জনগণের রক্ত নিংড়ে নিতে না পারে, বর্তমান নির্বাচিত সরকারের কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




