সার্থক ও সফল শিল্প সবসময় মনে পুনঃসৃষ্টি ঘটায়। বোধ ও উপলব্ধির দিগন্ত প্রসারিত করে। অন্য সব শিল্পমাধ্যম এর মত অভিনয়েও একই নিয়ম।আসাদুজ্জামান নূর কি শিল্পসফল কুশীলব হতে পেরেছেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা অনেক আগেই পেয়ে গেছি।
ডাকসাইটে সব অভিনেতা অভিনেত্রী নিয়ে আমাদের টিভি নাটকের পথ চলা।সেখানে একক ভাবে নিজেকে নিজের নিজের মত করে ফুটিয়ে তোলা জলবৎ তরলং নয়।নূর যে অবয়বে আমাদের কাছে নূর - তিনি তা নাও থাকতে পারতেন। অন্যভাবে প্রতিভাত হতে পারতেন,যদি না হুমায়ূনের মত কেউ আমাদের টিভি অঙ্গনে না আসতেন।হুমায়ূনেই নূর সগৌরবে উদ্ভাসিত হয়েছেন।
হুমায়ূন - নূর,নূর - হুমায়ূন কে কার অলঙ্কার? এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়,কোথাও কেউ নেই, নাটকগুলি দেখতে দেখতে এই প্রশ্ন মাথায় ঘোরে।প্রত্যেকটি নাটকে হুমায়ূনের ডায়ালগ বদলাবার সাথে সাথে নূরও যেন নতুন নতুন খোলসে প্রবল প্রতাপে হাজির হয়েছেন। এসব নাটকে নূর যে সুর দিয়ে গান বেধেছেন,তার ছন্দ ও দোলায় বাঙালী দর্শক এখনো মোহিত রয়েছেন।
এইসব দিনরাত্রি দিয়ে নূরের হুমায়ূনপর্ব শুরু।আটপৌরে মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট ছোট সুখ দুঃখ মাখা নাটকটি টিভিতে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়।নিজ গুণে এই নাটকের কিছু অভিনেতা অভিনেত্রী যেমন ডলি জহুর,বুলবুল আহমেদ, আবুল খায়েরের সাথে নূর অভিনীত চরিত্রটিও দর্শকের মন কাড়ে।
হাসি কৌতুকের ভিয়েনরস মাখা নাটক ''বহুব্রীহি'' রে উঠে আসেন অন্য আরেক নূর।বেশ ভালভাবেই বুঝিয়ে দেন কেবল অভিনয়ের জন্য অভিনয় করতে আসেননি তিনি।বাড়িওয়ালা সোবাহান সাহেবের পরিবারের সদস্যদের নানাকাজে আনিসরূপী নূরের প্রতি এক ধরণের ভালবাসা মিশ্রিত নির্ভরতা দেখা যায়। নাটকে আবুল হায়াত আর নূরের পারস্পরিক অভিনয় রসায়ন লক্ষ্য করার মত। এই নাটকে নূর মুখের ভাব অবিকল স্থির শান্ত রেখে কখনো বা স্মিত হেসে যেভাবে নানা বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রাসঙ্গিক বচন আওড়ে যান, তা মনে রেখাপাত না করে পারে না। একটা উদাহরণ দিলে বোধ হয় সুবিধা হবে। সোবহান সাহেব যখন বলেন -অপরাধীর অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত, তখন তাতে সম্মতি জানিয়ে নূর যখন বলেন,''অপরাধ এবং শাস্তি দুয়ের মধ্যে একটা মজার ব্যাপার আছে। আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে আছি যখন অতি তুচ্ছ অপরাধের শাস্তি হয় কিন্তু বড় বড় অপরাধীর কিছুই হয় না।একজন পকেটমারকে ধরতে পারলে আমরা পিটিয়ে মেরে ফেলি কিন্তু যে নানা কায়দায় ব্যাংকের টাকা মেরে দেয় তাকে আমরা কিছুই করি না।একজন মানুষকে হত্যা করলে ফাঁসি হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে কিন্তু ৩০ লক্ষ্য মানুষকে হত্যা করলে তার কিছুই হয় না।'' দর্শক হিসেবে আমরা নূরের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ক্ষরিত হই, নীরব ক্ষোভের দাবানল যেন ভেতরটা পুড়িয়ে দিতে থাকে।
নূর অভিনীত হুমায়ূনের নাটকগুলো দেখতে গিয়ে মনের অজান্তে বর্তমানে প্রচারিত নাটকগুলোর সাথে মনে মনে একটা তুলনা করে বসি। এখন স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক অভিনয় পর্দায় তুলে আনার নাম করে চলছে দেদারছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার ব্যবহার।নাটকে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের বিপক্ষে নই।কিন্তু প্রমিত বাংলার প্রতি এক অজানা আক্রোশ দেখিয়ে যেভাবে নাটকে জগাখিচুড়ি ভাষার আমদানি করা হচ্ছে তাতে না পাওয়া যায় শিল্প, না পাওয়া যায় প্রাণ।ভাষা-তার যে কোন রুপ, শিল্পমাধ্যমে তুলে আনতে গেলে সততা,যোগ্যতা, প্রতিভার পাশাপাশি এর ব্যবহারের আদ্যপান্ত রসায়ন জানা থাকা চাই।যেনতেন ভাবে মুখ নিঃসৃত হলেই তা পরানের গহিনের ভেতর হয়ে যাবে না।নাটকে নূর প্রমিত বাংলায় কথা বলেছেন। প্রমিত বাংলার মিঠে সৌকর্য নূরের বচনে ধরা পরেছে। এখানে স্বাভাবিক অভিনয়ের নামে তাকে মুখের চামড়া কুচকাতে হয়নি।কই তাতে ত চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে কোন বেগ পেতে হয়নি।দেখে মনে হয় কত আয়াসসাধ্য অভিনয়। আর হ্যা, মুখের ভাষায় কিভাবে অভিনয় করতে হয় তাও বাকের ভাই চরিত্রে নূর দেখিয়ে দিয়েছেন। মুনাকে যখন বলা হয় '' তয় মনটা খুব খারাপ হইছে, মুনা।আমি রাস্তার ছেলে। পড়াশুনা তেমন হয় নাই।গুণ্ডামি পান্ডামি করছি, এরে মারছি ওরে ধরছি।কিন্তু.. কিন্তু... .... ছাইড়া দিতে ইচ্ছে করে।মাঝে মইধ্যে খুব ভদ্রলোক হইতে ইচ্ছে করে।খুব আফসোস হয়।মনে হয় ভদ্রলোক হইতে পারলে তুমি হয়ত আমার সঙ্গে এত কঠিন ব্যবহার করতে পারতে না।'' ... পর্দায় এই অংশ দেখে আপ্লুত হননি এমন দর্শক খুব কম আছে।নূর কেন নূর তা শুধুমাত্র এইটুকু অংশ দেখলে বোঝা যায়। এখনকার ন্যাচরাল অভিনয়ের প্রবক্তারা একটু পেছনে গিয়ে এসব নাটক দেখে নিলে ভাল করবেন।
নূরকে সামনে রেখে হুমায়ূনের কথা একটু বলতে হয়।মানুষের মনে হুমায়ূন জায়গা নিয়েছেন গল্পে উপন্যাসে নাটকে তার চরিত্রনির্মাণ কুশলতার কারণে।কখনো যুক্তি,কখনো যুক্তিহীনতা, আবেগ, হিউমার, বুদ্ধির সূক্ষ্ম ও নাটুকে ব্যবহার তার চরিত্রনির্মাণের মূল উপাদান। মানুষের কাছে জনপ্রিয় যেসব চরিত্র তাদের ভেতর বিশেষ কিছু আচরণ লক্ষ্য করা যায়।তাদেরে ভেতর চমকে দেয়ার মনোভাব, যুক্তিহীন অপ্রত্যাশিত,খেয়ালী কিছু আচরণ পরিস্ফুট যাকে অনেকে বলেন হুমায়ূনীয় মেজাজ। পর্দায় নূর সেই হুমায়ুনীয় মেজাজকে সমপূর্ণরূপে ধারণ করতে সমর্থ হয়েছেন।আরেকটু এগিয়ে বলা যায় এই মেজাজ বা ধরণকে তার খুঁটিনাটিসমেত ধারণ করার সক্ষমতা একমাত্র তারই ছিল।মনে হয় সেই কারণেই হুমায়ূন নূরকে কেন্দ্রে রেখে তার নাটক সাজিয়েছেন।আর এই ধারণ করার গুণেই বোধ হয় অয়োময় নাটকের জমিদার চরিত্রে নূরকে বাছাই করা।যখন নাটক বোদ্ধা অনেকেই নূরকে জমিদার চরিত্রে তার উৎরানো নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।
অবশ্য শুধু তারাও নয়, সাধারণ দর্শকের চোখে জমিদার বলতে চোখে ভাসত গোলাম মুস্তফা, খলিলের মত রাশভারী চরিত্রের দাম্ভিক মানুষ।যা হোক জমিদার চরিত্রে নূরের অভিনয় এতদিনকার হিসেব নিকেশ সব উল্টে দিল। নূরের ভাষায় '' একইসঙ্গে দাম্ভিক,রাগী, আর খামখেয়ালি ও ক্ষমাশীল'' জমিদার দেখতে পেল।।আমরা পেলাম নতুন ধরণের জমিদার। জমিদার বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠা ডাকসাইটে জমিদারদের মুখের সাথে, নূরের হাতের আঙ্গুলে পরা আংটি নাড়াচাড়ার খেয়ালী দৃশ্য মনে প্রোথিত হয়ে গেল।নুরের ভাষ্যমতে এখনো গ্রামেগঞ্জে তাকে মির্জা বলে সম্বোধন করা হয়।এই চরিত্রটি নূরের নিজেরো পছন্দের।
হুমায়ূনীয় মেজাজ ধারণ করার বিষয়টি আরো প্রকটভাবে চোখে পরে নূর পরবর্তী হুমায়ুনের নাটকগুলোর দিকে খেয়াল করলে।কেন্দ্রীয় চরিত্রের সাথে নূর অভিনীত চরিত্রগুলোর অভিনয় ব্যবধান চোখে পরার মত।এমনকি অনেকক্ষেত্রে নূর পর্দায় সাহিত্যের চরিত্রকে ছাপিয়ে গেছেন। বাকের ভাই চরিত্রটি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।''চোখ '' গল্পের মত সংবেদী অনবদ্য ছোটগল্পের, পর্দায় রুপায়নে তিনি যেন গল্পটির সাথে সমানে সমানে টেক্কা দিয়েছেন।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে কোথাও কেউ নেই। কি নূরে,কি বাংলাদেশের নাটকে।এখানে নূর আর নূর থাকেন না,নূরকে প্রতিস্থাপিত করে বাকের ভাই হয়ে যায় রক্তমাংসের মানুষ। মনের পটে ধরে রাখার মত অসংখ্য স্মরণীয় দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন এই নাটকে তিনি। নাটকে কারাগারের শেষ দৃশ্যটায় সুবর্ণ মুস্তফার হাতে হাত চেপে আপাত ভাবলেশহীন বাকের ভাই জীবনের আকুতির যে শৈল্পিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন,তাতে শিল্প ও বাস্তব একাকার হয়ে গেছে।অভিনেতা হিসেবে তিনি পেয়েছেন অমরত্ব।
তাই হয়ত আবেগের এমন বাধ ভাঙ্গা জোয়ার।এমন দৃশ্য বাংলাদেশ আগে কখনো দেখেনি,পরেও দেখবে কিনা সন্দেহ।এখনো মনে আছে, আজাদী পত্রিকায় ''আজ কোথাও কেউ নেই এর শেষ পর্ব'' নামে প্রথম পাতায় হেডলাইন হয়েছিল।পুরো বাংলাদেশ সেদিন অপেক্ষা করছিল শেষ পর্বের জন্য।রাস্তায় রাস্তায় বাকের ভাইয়ের জন্য মিছিল, রিক্সার পেছনে লেখা বাকের ভাই, দেয়ালে শ্লোগান –
বাকের ভাইয়ের ফাসি কেন
খালেদা জিয়ার জবাব চাই !!
শুধু কি দর্শক? নূর নিজেও কি আক্রান্ত হননি? তার ভাষায় -''কোথাও কেউ নেই '' এর শেষ পর্ব প্রচারিত হবে। আমি রাতে বাসার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি।গোটা শহর খাঁ খাঁ করছে।মনে হচ্ছে, যেন ঢাকায় কারফিউ জারি হয়েছে।দু -একটা রিকশা শুধু মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। নাটক শুরু হওয়ার আগে ফোনে হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, তিনি বাসাবাড়ি ফেলে অন্য কোথাও গা ঢাকা দিচ্ছেন।আমার মা, স্ত্রী সহ সবাই নাটকের শেষ দৃশ্যের আগে টিভির সামনে থেকে উঠ চলে গেল।সবাই চোখের পানি লুকোচ্ছে।কেউ নাটকের শেষ দৃশ্য দেখতে চায় না। মনে হচ্ছিল,আমি কোনো ঘোরের মধ্যে আছি।'' একজন অভিনেতার জীবনে এর চাইতে বড় অর্জন আর কি হতে পারে?
সব কীর্তিরই বোধ হয় শেষ আছে।এর পরে তিনি হুমায়ূনের কিছু ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেছেন। সেসব জনপ্রিয়ও হয়েছে,কিন্তু সেই বাদ্য আর বাজেনি। সর্বশেষ সিনেমা ''চন্দ্রকথায়'' মনে হল কোথাও যেন সুর তাল কেটে গেছে।''অর্ধেক জীবন''এ এসব বিষয় তিনি অপকটে স্বীকার করেছেন।
''অর্ধেক জীবন'' এ নিজের সম্পর্কে নানা কথাই বলেছেন নূর। তার জন্ম,যে পটভূমিকায় তার বিকাশ ও বেড়ে ওঠ সবকিছুই সাবলীলভাবে বলে গেছেন।কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ পেয়েছে নানা উপলব্ধি। একজন খাটি শিল্পীর মতই জীবনের প্রতি বিস্ময় রেখে তার উক্তি- ''জীবন সত্যিকার অর্থেই এক আশ্চর্য সফর।'' তাতে জীবনের বহুবর্ণীল ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে।
''অর্ধেক জীবন'' ই তিনি একে ফেলেছেন অক্ষয় চিহ্ন। '' জীবন হতে যা কুড়াবার,যা দেবার তা ইতিমধ্যেই তিনি সঞ্চয় ও দান করেছেন।অর্ধেকেই তিনি পূর্ণ। ঋদ্ধ। তাই একজন পরিতৃপ্ত জীবন রসিক হিসেবে তিনি বলতে পেরেছেন,'' জীবনের কোন অতৃপ্তি আমাকে পীড়িত করে না।তাড়া করে ফেরে না কোন লুকানো অপরাধবোধ ও। নাহ, এই অর্ধেক জীবনের কোনো কিছু নিয়ে একরত্তি আপসোস নেই আমার।''
সত্যি ই , নুরুলদিনের আব্বাস,মুখোশ এর ডাক্তার,বহুব্রীহির আনিস,অয়োময়ের মির্জা,কোথাও কেউ নেই এর বাকের আর নান্দাইলের ইউনুসের কি ই বা খেদ থাকতে পারে?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:২৮