somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছাতা আছে মাথা নেই

১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


__সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আমরা আর বেঁচে নেই। বেঁচে আছে একটি মাত্র প্রশ্ন - কী হবে ? ছাত্রের প্রশ্ন, লেখাপড়া করে কী হবে ? সময়ের অপচয়, অর্থের শ্রাদ্ধ। চাকরি মিলেব না। এ দেশে একটিমাত্র জীবিকায় সোনা ফলবে, সেটি হল গুণ্ডামি। যদ্দিন বাঁচবে সুখে বাঁচবে, দাপটে বাঁচবে। মিউ মিউ করতে হবে না। সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক কর। সিমেন্ট ব্ল্যাক কর। ওয়াগন ভেঙে ফাঁক কর। নির্বাচনের সময় বুথ দখল কর। ‘টেরারে’র ব্যবসায় ভাল কামাই। পাড়ার মানুষ দাদা বলে ভয় ভক্তি করবে। দাদার দাদারা বাড়ি সামনে গাড়ি থামাবে। দোকানদার ছুটে এসে পায়ের ধুলো নেবে। শেয়ানার দেশে শেয়ানে শেয়ানেই কোলাকুলি হয়। অনর্থক শেলী, বায়রন, কীটস, শেকসপীয়র, কান্ট, হেগেল, হিউম, নিৎসেকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করে কী হবে ! জিও, পিও, ফুস্, ফিনিশ।

গৃহীর প্রশ্ন, কী হবে বেঁচে ! শুধু শুধু জায়গা জুড়ে বসে থাকা। র‌্যাশানের বোগড়া আলোচাল ধবংস করা। দিনগত পাপক্ষয় ছাড়া আর কী হবে !

শিক্ষকের প্রশ্ন, কী শেখাব ? কে শিখবে ? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন রণক্ষেত্র। রুটিন অতি চমৎকার। প্রথম ঘন্টায় ভিন্ন্ মতাবলম্বী শিক্ষকে শিক্ষকে ফিস্ট ফাইট। দ্বিতীয় ঘন্টায় শিক্ষকের পক্ষাবলম্বী ছাত্রে ছাত্রে সঙঘর্ষ। অন্তে ঘন্টাবাদন, কুরুক্ষেত্রে দিবসের শান্তি। দেয়াল লিখন আর পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। গেটে ছাত্রদের জমায়েত। জ্বালাময়ী ভাষণ। বিশেষ আকর্ষণ, বোমা বিস্ফোরণ। নিজেদের সমস্যা তো আছেই, গোদের ওপর বিষফোঁড়া, আন্তর্জাতিক সমস্যা - কম্বোডিয়া, কামপুচিয়া, ইরাক, ইরান, ফকল্যাণ্ড আইল্যাণ্ড।

তালগোল পাকান একটা দেশ। কয়েক বছর আগে অফিসপাড়ার এক রাস্তা ধরে হাঁটছি। প্রায় সন্ধ্যা। হঠাৎ এক অফিসবাড়ির দোতলার সিড়ি বেয়ে ধোপদুরস্ত দুই বাবু জড়াজড়ি, কোস্তাকুস্তি করতে করতে, দুম্ করে একেবারে রাস্তায় আমার পাশে এসে পড়লেন, যেন যমজ সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। রাস্তায় শুয়ে শুয়ে দু’জনে , দু’জনকে খুব খানিক লাথালাথি করলেন, তারপর ধুলোটুলো ঝেড়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। প্রবেশপথ থেকেই ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার রহস্যলোকে। সুন্দর চেহারার, হৃষ্টপুষ্ট দুই বঙ্গপুঙ্গব প্রদোষের ম্লান আলোকে সেই ভুতুড়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেলেন। পরস্পর পরস্পরের ওপর অনর্গল বৃষ্টিধারার মত কটু বাক্য বর্ষণ করে চলেছেন। সাদা পোশাকে রাস্তার ধুলো জড়িয়ে আছে। আমাকে অবাক হতে দেখে ফুটপাথের এক বিক্রেতা বললেন, ‘অবাক হবার কিছু নেই, দোতলায় অমুক মিলের বোর্ড অফ ডিরেক্টার্সের অ্যানুয়েল জেনারেল মিটিং হচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ান। দেখবেন জোড়ায় জোড়ায় বাঙলী ওইভাবে লড়ালড়ি করতে করতে নিচে এসে পড়ছে, আবার ধুলো মেখে ওপরে উঠে যাচ্ছে।’ বাঙালীর সেই বিখ্যাত মিলটি অবশ্য লাটে উঠে গেছে। সেকালের জমিদাররা মাঝে মাঝে বাইরে যেতেন। নায়েবরা বলত, বাবু লাটে গেছেন। অর্থাৎ জমিদারি দেখতে গেছেন। লাটে যাওয়া এক জিনিস, আর লাটে ওঠা আর এক জিনিস। সারা দেশ জুড়ে এখন বোর্ড অফ ডিরেক্টার্সের মিটিং চলেছে। আর জড়াজড়ি, গলাগলি করে ভদ্র বঙ্গসন্তান রাস্তায় এসে পড়ছে। লাটে ওঠার পূর্ব লক্ষণ।

সেই বরিভূমের শ্রাদ্ধ। কৃষকের পিতা পরলোকে গেলেন। শ্রাদ্ধ হবে। পুরোহিত কৃষকবধূকে বলে গেলেন, উঠানের কিছুটা জায়গা পরিস্কার করে রাখবে, কাল সকালে শ্রাদ্ধ হবে। কৃষকবধূ পুরোহিতের নির্দেশমত বাড়ির সামনের কিছুটা জায়গা নিকিয়ে, পরিস্কার করে রাখলো, শ্রাদ্ধ হবে। যথাসময়ে পুরোহিত এলেন। নিখুঁত আয়োজন। সামনে কাছাগলায় যজমান। পুজো-আচ্চার নিয়মকানুন কিছুই জানা নেই। পুরোহিত যেমন বলবেন তেমনই বলতে হবে। এইটুকু কে আর না জানে ! পুরোহিত ছিলেন তোতলা।
তিনি প্রথমেই বললেন, ‘ব ব বল ব্যা ব্যাটা তো তোর বা বাপের নাম বল।’
কৃষক অমনি বলল, ‘ব ব বল ব্যা ব্যাটা তো তোর বা বাপের নাম বল।’
পুরোহিত বললেন, ‘উ উ উ লয়, বা বা বাপের নাম।’
কৃষক বলল, ‘উ উ উ লয়, বা বা বাপের নাম।’
পুরোহিত মশাই ভাবলেন, যজমান ব্যঙ্গ করছে। মারলেন এক চড়। কৃষকও পুরোহিতের গালে কষিয়ে দিল এক চড়। শুরু হয়ে গেল কোস্তাকুস্তি, ধস্তাধস্তি। দু’জনে ঝটাপটি করতে করতে, গড়াতে গড়াতে পাশের নর্দমায়।

কৃষকবধূ দাওয়ায় বসে সব দেখছিল। শ্বশুরের শ্রাদ্ধ খুব জমেছে। দু’জনকে নর্দমায় গড়িয়ে পড়তে দেখে আপন মনে বলে উঠল, ‘আই বাপ্ , অ্যাদ্দুর গড়াবে জানলে আর একটু লিকিয়ে রাখতুম।’

বীরভূমের ওই শ্রাদ্ধের মত বাঙালীর শ্রাদ্ধ কতদূর গড়াবে কে জানে ? প্রস্তুত হয়েই থাকা ভাল। যতটা পারা যায় ভেতরটাকে নিকিয়ে রাখাই উচিত। প্রাচীন সংস্কার, আদর্শ মনের গোশালায় গোবরের মত জমে আছে। সেই আবর্জনায় জন্মাচ্ছে নতুন আদর্শের শূক কীট। ঝাঁক ঝাঁক অস্বস্তির মশা বিবেকে হূল ফোটাচ্ছে। চিন্তার সঞ্চয়ে শ্রেষ্ঠ বলে যা তোলা আছে তার কোনও মূল্য নেই ? যা শিখে এলুম সব ভুল ? শাশ্বতের ধারণা পাল্টাতে হবে। যাঁদের মহাপুরুষ বলে জেনে এসেছি, এ যুগের চোখে তাঁরা কাপুরুষ। জ্ঞান, সৎকর্ম, শান্তি, অহিংসা, আদর্শ, সত্য এ সবই হল মধ্যযুগীয় কুয়াশা, কুআশা। পশুজগতের নিয়মই মানুষের আদর্শ। ধরো আর মারো। মেরে খাও। এর মার, তার মার, পকেট মার। আবরণ মানুষের, অন্তর পশুর। বড় সংশয়। বড় বিস্ময়। মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচতে চায় ! উপনিষদের চরৈবেতি মানে সামনে চলা, না পেছনে চলা !

প্রশ্নের উত্তর পেলাম স্বামী সত্যানন্দের কাছে : হতাশ হয়ো না। প্রত্যেক মানুষের ঠিকমত চলতে চলতে বেচাল চলতে ইচ্ছে করে। পশুদের দেখা যায় হঠাৎ একদিকে দৌড় দেয়। বিচারশীলতা নিয়ে মন ঠিক চলছে হঠাৎ চঞ্চলতা নিয়ে এক দৌড় দেয়। এই হচ্ছে Erraticism of Soul. ব্রহ্মাও একদিন সমরসে থাকতে থাকতে এমনই বিসম হয়ে গেলেন। খুব নিয়মে চলেও হঠাৎ ইচ্ছে করে বেনিয়মে চলবার। আবার আমরা বহু জন্ম পশু ছিলাম। কাজেই পশুত্বের Erratic nature - বিচারহীনতা - হঠাৎ জেগে ওঠে। সেই Erratic ভাবগুলোকে অবশ্য দমন করা উচিত। দার্শনিক কান্ট তাই ‘Moral ought’, উচিত-বোধকে বড় করে স্থান দিয়েছেন।

একক মানুষ হয়তো এগোতে চায়। ঘরে ঘরে আদর্শের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। পূর্বপুরুষের ছবির সামনে আনত হবার মত মাথা হয়তো এখনও ধড় থেকে এক কোপে নামিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সাধনহীন, আদর্শহীন হয়ে পড়েছে মানুষের সঙঘ, সংগঠন, Organisation Man. যে হাত মানুষকে সামনে ঠেলবে, সেই হাত পেছনে ঠেলছে। মুকুট আছে, রাজা নেই। মর্কট লাফচ্ছে সিংহাসনে।
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×