দেশে এখন শীতের প্রায় শেষ। এসএসসি পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার্থীরা রাত জেগে ঢুলুঢুলু চোখে শেষ সময়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরদিন হলে গিয়ে যেন প্রশ্নপত্রে তাঁদের জন্য কোন চমক না থাকে।
সমস্যা হচ্ছে দেশে শীতকাল হচ্ছে ওয়াজ মাহফিলের মৌসুম। শীতের রাতে গ্রামে গঞ্জে এবং শহরে প্যান্ডেল টাঙিয়ে মাইক বাজিয়ে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। গভীর রাত পর্যন্ত বয়ান চলে। এবং পরীক্ষার্থী থেকে শুরু করে অসুস্থ ব্যক্তি পর্যন্ত সর্বস্তরের জনগন ভোগান্তির শিকার হয়।
কথা হচ্ছে, এইধরনের "ওয়াজ মাহফিল" কী ইসলাম অনুমোদিত?
উত্তরে আসার আগে জেনে ফেলা যাক আমাদের দেশের ওয়াজ মাহফিলে আসলে কী হয়? যেকোন random দশটা ওয়াজের ভিডিও তুলে আনুন, সবগুলোতেই দুইটি বৈশিষ্ট্য পাবেনই পাবেন।
১. সব সমস্যার মূল মেয়ে মানুষ। ওরা আছে বলেই আমাদের চারপাশে এত সমস্যা। ওরা না থাকলে পৃথিবীতে কোন যন্ত্রণাই থাকতো না।
২. হিন্দুদের গালাগাল। (ইদানিং নাস্তিকদের গালাগাল যুক্ত হয়েছে)। ওদের গিয়ে নিয়ে ফাজলামি করো। ওদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো। ওদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দাও। এই ভূখণ্ডে ওদের কোন স্থান নেই।
মঞ্চে যারা বক্তৃতা দেন, প্রত্যেকের নামের শুরুতে যুক্ত থাকে আল্লামা, মুফতি, শায়েখ ইত্যাদি। যে উপরের দুই পয়েন্টের উপর যত বেশি কথা বলবে, তার ডিমান্ড তত বেশি।
সমস্যা হচ্ছে দর্শকদের নিয়ে। এদের যা গেলানো হয়, তাই গিলে খায়।
যেমন কিছুদিন আগে এক লেখায় লিখেছিলাম, আমাদের নবীর (সাঃ) বাবা মা দুইজনই অমুসলিম ছিলেন। এতে কয়েকজন ফেসবুকীয় মুমিন বান্দা তেড়ে ফুঁড়ে এলেন। আমি গোস্তাখে রাসূল হয়ে গেলাম। একজন বললেন, তাঁরা নাকি মৃত্যুর পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। খুবই বিস্ময়কর ঘটনা। পুরো দুনিয়ার মুসলিমরা যা জানেনা, তা এই ভদ্রলোক জেনে বসে আছেন। লাইক ও শেয়ার দিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবেনা? রেফারেন্স চাইলে তিনি বললেন বিয়ানীবাজারে কোন এক ওয়াজে কোন এক শায়েখ বলেছেন। এই তাঁর রেফারেন্স।
এই কিছুদিন আগেই একটা পোস্ট দেখলাম, যেখানে এক তথাকথিত জনপ্রিয় মাওলানা ইচ্ছেমতন মনগড়া কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে যাচ্ছে, যা খুশি বলে যাচ্ছে, একজন মানুষও এর প্রতিবাদ করছে না।
চিন্তা করতে পারেন এইসব ওয়াজে কেমন ফাজলামি চলে? অথচ দর্শকসারিতে একটা কুরআনের হাফেজও উপস্থিত থাকলে এই মাওলানার ভণ্ডামি বন্ধ হয়ে যেত। বা একজন প্রকৃত আলেম থাকলেই এদের টুঁটি চেপে ধরতেন। দর্শক বাদ দেই, মঞ্চেও কী একজনও এই ফটকাবাজি ধরতে পারলো না? তাহলে কারা এইসব ওয়াজে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়? যোগ্যতা কী এদের? অদ্ভুত!
তো যা বলছিলাম, এইসব ভন্ডদের ওয়াজের মাধ্যমে ভুলভাল ব্যাখ্যার ইসলামের সাথে ধর্মের ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।
আজকে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ধর্মের ধারেকাছেও নেই - ওরা মুসলিম পরিচয় দেয়, অথচ ইসলাম কী সেটাই জানে না। বেসিক ব্যাপারগুলিতেই ধরা খায় - কেন? কারন আমরা এখন কুরআন বা হাদিস গ্রন্থ পড়ে ধর্ম শিখি না। আমরা ওয়াজ থেকে শিখি। ওখানে দাড়িওয়ালা টুপি মাথার লোক যা বলে, তাই ১০০% বিশ্বাস করে বসি। বাড়িতে যে কুরআনের গায়ে ধুলো জমছে, সেটা উল্টে চেক করার সময় পর্যন্ত নেই। এক ইন্টারভিউতে হলিউডের এককালের সবচেয়ে বিতর্কিত সেলিব্রেটিদের একজন লিন্ডসে লোহানকে বলতে শুনেছিলাম যদিও সে এখনও মুসলিম হয়নি, হবে কিনা জানে না, তবে সে প্রতিদিন কুরআন পড়ে। তাঁর নাকি ভাল লাগে। তাঁর মিডল ইস্টার্ন বান্ধবীরা তাঁকে কুরআন উপহার দিয়েছিল।
অথচ আমরা মুসলিম হয়েও পড়িনা।
চিন্তা করে দেখুন, হলিউডের ড্রাগ এডিক্ট নায়িকা আমাদের মাওলানাদের সামনে আসলে এরা আস্তাগফিরুল্লাহ বলে দূর দূর করে তাঁড়াবে। অথবা এমনসব ফতোয়া দেয়া শুরু করবে যে শুরুতেই মেয়েটা ভড়কে যাবে।
ওর বান্ধবীরা কেবল কুরআন ধরিয়ে দিল, আর কিছু না। তুমি পড়, হেদায়েত তোমার কপালে থাকলে তুমি মুসলিম হবে, নাহলে না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের একশোটা মুসলিম নারীর কমসেকম পঞ্চাশজনের অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে তাঁরা নিজের ধর্মকে মন থেকে শ্রদ্ধা করতে পারেনা। কেন? কারন ওরা কেবল এই মাওলানাদেরই বক্তব্য শুনে ইসলামকে জেনেছে। কেউ তাঁদের কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যাওয়ালা বই এগিয়ে দেননি।
তো যা বলছিলাম, এই শীতকালীন ওয়াজ মাহফিলের কালচার বন্ধ হওয়াটা প্রয়োজন। কারন,
১. অযোগ্য ব্যক্তিরা "হেট স্পীচ" ছড়িয়ে সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে দিচ্ছে, হিন্দু মুসলিমে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দিচ্ছে। অসহিষ্ণু মনোভাব জাগিয়ে তুলছে। আপনি যদি ওয়াজ করেন, তাহলে হেট স্পীচ না ছড়ালে আপনার দাম থাকবে না। একটা মাওলানা, যে কথায় কথায় প্রকাশ্যে নাস্তিকদের কোপানোর কথা বলে, সে ভাইরাল হয়ে যায়। অথচ কেউ যদি স্ত্রীকে ভালবাসার কথা বলেন, স্ত্রী গ্লাসের যে অংশ দিয়ে পানি পান করেন, সেই অংশ দিয়ে আপনাকেও পান করতে বলেন, মাংসের যে অংশে কামড় দিয়ে খান, সেই অংশে আপনাকেও কামড় দিতে বলেন, কারন আমাদের নবীজি (সঃ) তাই করতেন - এমন মাওলানার ওয়াজ ভাইরাল হয়না। কোন মাওলানা যদি বলেন পুরুষজাতি, তোমার দৃষ্টি সংযত করো, অথবা বাল্য বিবাহ ইসলামে "ফরজ" না, কাজেই তোমরা আঠারোর কম মেয়েদের বিয়ে করোনা - তাহলে খুব বড় একটা সুযোগ আছে মঞ্চ থেকে নামার পরই সেই মাওলানা কোপ খেয়ে মরবেন।
২. শব্দদূষণ। ওয়াজের সবচেয়ে বড় সমস্যা এই শব্দ দূষণ। আমরা জানি ৮৫ ডেসিবেলের উপরের মাত্রার শব্দ মানুষের স্বাস্থ এবং আচরণ দুইয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। এবং এও জানি, ইসলাম যেকোন দূষণেরই বিপক্ষে। অন্যের "ভ্যালিড" কোন অসুবিধা হয় (ফাইজলামি টাইপ অসুবিধা না), এমন কোন কিছু করতেই ইসলাম নিষেধ করে।
সেখানে ইসলামের নামে এই আচরণ ইসলামেরই পরিপন্থী।
শব্দ দূষণ নিয়ে দেশে আইন জারি করাটা অবশ্য কর্তব্য হয়ে গেছে। পৃথিবীর যেকোন সভ্য দেশেই এই সম্পর্কিত আইন আছে। সৌদি আরবে পর্যন্ত। আমরা অসভ্য বলেই আমাদের নেই।
আমাদের দেশে গাড়ির হর্ন, অযথা মাইকিং, উচ্চ ভলিউমে গান, ঢাক ঢোল (সেটার পূজার ক্ষেত্রেও), ব্যান্ডপার্টি, ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদি সব কঠোরভাবে মনিটর করা উচিৎ। এগারো বছরের উপর হলো অ্যামেরিকা আছি, একদিনও গির্জার ঘন্টাধ্বনি শোনা হলো না। আজান শুনতে হলে মসজিদে যেতে হয়, মুয়াজ্জিন তাঁর সুললিত কণ্ঠে আজান দেন, যখন "হাইয়া আলাসসালা" বলেন, শুনে চোখে পানি চলে আসে। হৃদয়ে গিয়ে বিঁধে। মাইকের কর্কশতার কারনে কানে বাজেনা।
তোমার ওয়াজ করতে হয়, তুমি ইনডোরে (মসজিদের ভিতরে) আয়োজন করো। শব্দ বাইরে আসবে কেন? যে হার্টের রোগীর, বা শিশুর নিশ্ছিদ্র ঘুম প্রয়োজন, এইসব শব্দদূষণ তাঁদের সেই বিশ্রামের সময়ে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায়। যে ছাত্রের পড়ালেখা প্রয়োজন, সম্পূর্ণ নীরবতা তাঁর কাম্য, সেখানে আপনি তাঁর কানের সামনে মাইক বাজিয়ে যাচ্ছেন। ইসলাম কখনই এমন অবিবেচকের মতন আচরণ সহ্য করেনা।
সমস্যা হচ্ছে, আপনি এর বিরুদ্ধে কিছু বলতে যান, আপনাকে নাস্তিকের দালাল, দাজ্জাল, কাফের বলে কুপিয়ে মেরে ফেলবে।
আফসোস। আমাদের মুসলিমপ্রধান দেশে ইসলামকে খুঁজে পাওয়া যায় না।