সনু নিগাম তাঁর কনসার্টে নিজের একটা রোমান্টিক গান গাওয়ার আগে বলেন, সেটি নাকি হিন্দি গানের ইতিহাসে অন্যতম সেরা রোমান্টিক গান। এক নম্বর না হলেও সেরা পাঁচে অবশ্যই থাকবে। তাঁর এও দাবি যে এই গানটি শোনার পরেই ইন্ডিয়ার জনসংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল।
গানটি সুন্দর হলেও আমার কাছে সেরা পাঁচে রাখার মতন মনে হয়নি। যেখানে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে হিন্দি সিনেমার একশো বছরের ঐতিহ্যকে।
তারপরেই ভাবলাম, আমাকে যদি হিন্দি গানের ইতিহাসে সেরা পাঁচ রোমান্টিক গানের তালিকা করতে বলা হয়, আমি তাহলে কোনগুলিকে সেই তালিকায় স্থান দেব? আপনাকে যদি বলা হয়, আপনি কোনগুলিকে রাখবেন?
অতি জটিল এবং প্রায় অসম্ভব এই কাজটি তখনই সহজ হবে যখন আপনাকে কোন রকম চিন্তা ভাবনা না করে সেরা পাঁচটি রোমান্টিক গানের তালিকা করতে বলা হবে। সময় নিবেন সর্বোচ্চ তিরিশ সেকেন্ড। চিন্তা ভাবনা করতে এর বেশি সময় নিলেই এই তালিকা শেষ করতে পারবেন না। আর তাছাড়া যে গান আপনার প্রথম ভাবনাতে আসেনি, তার মানে সেটা আসলেই আপনার কাছে সেরা পাঁচে আসার মতন গান নয়। সহজ লজিক।
আমি নিচে আমার প্রিয় গানের তালিকা দিচ্ছি। সাথে কেন প্রিয় সেটিও লিখছি। আপনার সাথে মতের অমিল হবেই। আমার ক্ষেত্রে যেটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে, আপনার ক্ষেত্রে সেটি করবে না সেটাই স্বাভাবিক। আপনি ইচ্ছা করলে আপনার প্রিয় তালিকা কমেন্টে দিতে পারেন। স্বাগতম! সাথে মজাও হবে।
তবে একটি বিষয়ই শুধু লক্ষ্য রাখবেন, গানগুলো যেন নকল করা গান না হয়। যেমন "ম্যায়নে পেয়ার কিয়া" সিনেমার "আতে যাতে...." গানটি স্টিভি ওয়ান্ডারের I just called to say I Love you, অথবা "জুর্ম" সিনেমার "যাব কোই বাত বিগার জায়ে.." গানটি "a hundred miles" এর নির্লজ্জ্ব নকল ছিল। নাহলে ওগুলো অবশ্যই আমার প্রিয় তালিকায় থাকতো। "ক্রিমিনাল" সিনেমার "তু মিলে দিল খিলে" গানে ইংলিশ ডায়লগগুলো আরেক ইংলিশ গানের লিরিক মেরে দেয়া। তাই বাতিল।
কথা না বাড়িয়ে তালিকা দেয়া যাক।
৫. "অ্যায় মেরে, হামসাফার" (কায়ামাত সে কায়ামাত তাক):
আমির খানের প্রথম সিনেমা যখন বের হয়, স্কুলেও যাওয়া শুরু করিনি তখন। মনে আছে এই গানটি আমাদের পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় বাজতো। আমির খান জুহি চাওয়ালা জুটি রাতারাতি সুপারস্টার বনে যান। হবে নাই বা কেন? তখনকার হিন্দি রোমান্টিক সিনেমার হিরো মানে ইয়া বিশাল ভুঁড়িওয়ালা ঋষি কাপুর। কে তাঁর স্বপ্নের রাজকুমারের অমন ভুঁড়ি চাইবে?
তখনকার চকলেট হিরো আমির খানকে দেখে কে কবে ভেবেছিল এই লোকটা একাই একটি ইনস্টিটিউশন হয়ে যাবেন? রোমিও জুলিয়েটের সেই শতাব্দী প্রাচীন প্রেমকাব্যকে দুর্দান্তভাবে ফিরিয়ে এনেছিলেন আমির ও জুহি জুটি। কয়জন জানেন, যে কায়ামাত সে কায়ামাত তাক সিনেমার গল্পটি যে আমির খানেরই লেখা?
এই সিনেমার প্রচারে আমির জুহি নিজেরা বোম্বের পথে নেমেছিলেন। তখন তাঁদের কেউ চিনতো না। অটোরিকশা ও ট্যাক্সিওয়ালাদের অনুরোধ করতেন তাঁদের লিফলেট যেন তাঁদের ট্যাক্সিতে চিপকানোর অনুমতি দেন। তাঁরাও অতি বিরক্তির সাথে অনুমতি দিতেন।
সিনেমা বের হবার পরে আমির যখন দেখেন রাস্তাঘাটে অচেনা লোকজনও তাঁকে দেখে হাত নাড়েন, হাসিমুখে তাকান, তখন তিনি অবাক হয়ে ভাবেন, এত মানুষ আমার সিনেমা দেখেছে!
বাড়ি ফেরত আসার পরে মা বাবার গম্ভীর চাহনি দেখেন। "সারাদিন বিরামহীনভাবে তোমার জন্য মেয়ে মানুষের ফোন আসছে। "হ্যালো, আমিরের সাথে কথা বলা যাবে?" বলি, আমাদের যদি জরুরি কল আসার থাকে, তাহলে ওরা কী লাইন খালি পাবে?"
যাই হোক, প্রেম কী সেটা বুঝারও আগে এই গান আমাকে শিখিয়েছিল প্রেম কতটা মধুর হতে পারে। এই গান তালিকায় অবশ্যই শীর্ষে থাকবে।
৪. "পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া" (শ্রী ৪২০):
বলিউডের সর্বকালের অন্যতম সেরা রোমান্টিক জুটি রাজ কাপুর-নার্গিস। তাঁদের অন্যতম সেরা গান এটি। গানটির কথা, সুর, দৃশ্যায়ন, কেমেস্ট্রি সব এত নিখুঁতভাবে কাজ করেছে যে আজ থেকে একশো বছর পরেও গানটি প্রেমিক শ্রোতার হৃদস্পন্দন এলোমেলো করে দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
৩. তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা (দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে):
এই গানটি তালিকায় না থাকলে কোন তালিকাই পূর্ণতা পাবে না। এই মুভির প্রোমোতে তাঁরা প্রচার করেছিল, "Come fall in love." বাস্তবেই এই সিনেমা দর্শকদের প্রেমে ফেলেছিল। নতুন করে ভালবাসতে শিখিয়েছে। সিমরানের প্রেমে রাজের সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দেয়া, সিমরানের পরিবারের প্রতিটা সদস্যের হৃদয় জয় করে তারপরে তাঁকে বিয়ে করা - শত বিরুদ্ধ পরিবেশেও সত্যের পথে রাজের অটল থাকা, অতঃপর হ্যাপি এন্ডিং...বলিউডের সর্বকালের সর্বসেরা রোমান্টিক সিনেমার তালিকার শীর্ষে থাকার জন্য যথেষ্ট।
অনেকেই হয়তো জানেন এই সিনেমায় শাহরুখ প্রথমে অভিনয় করতে চাননি। তিনি অ্যাকশন সিনেমা খুঁজছিলেন, পুতুপুতু রোমানস্ তাঁর ভাল লাগতো না। আদিত্য চোপড়ারও প্রথম পছন্দ ছিল সাইফ আলী খান। তারপরেও, শাহরুখের ভাগ্যে ছিল এই সিনেমার নায়ক হওয়া, কোটি কোটি রমণীর হৃদস্পন্দন হওয়া, বলিউডের বাদশাহ হওয়া - কে তাঁকে ঠ্যাকাবে?
শাহরুখের ক্যারিয়ারকে পাকাপোক্ত করে দিয়েছিল এই এক সিনেমা। আজকে যারা শাহরুখ ভক্ত, তাঁদের প্রত্যেকেই তাঁর প্রেমে প্রথম ধরাশায়ী হন এই ডিডিএলজে সিনেমা দেখেই।
যে বছর এই সিনেমাটি বের হয়, তখন আমি ইন্ডিয়াতে বেড়াতে যাই। বাবার শখ ছিল হলে বসে সিনেমা দেখার। হলে চলছিল দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে অথবা অজয় দেবগনের গুণ্ডারাজ। আমি গুন্ডারাজের হলে গেলাম। বলিউডের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘসময় হলে চলা সিনেমা আমার হলে বসে দেখা হলো না। ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া হলো না।
এইবারে আমার সংযোগের কথা বলি।
আমার বৌ সারাজীবন দোয়া করেছে যাতে রাজের মতন কোন ছেলের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পরে একদিন এই কথা শুনিয়ে বললো যে মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক।
তখন আমি তাঁকে বললাম, "এক সেকেন্ড দাঁড়াও! তোমাকে পাবার জন্য আমি কী কী করেছি সেটা ভেবেছো কখনও?"
ও বললো "কী?"
তালিকা ধরিয়ে দিলাম, "তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল আরেক ছেলের সাথে। অ্যামেরিকা থেকে ছুটে গেলাম। সেই বিয়ে ভাঙালাম। তোমার বাবা মা বোন দুলাভাইয়ের মন জয় করলাম। ঐ ছেলের পরিবারের পুরো গুষ্ঠির কাছে ভিলেন হলাম। এখন আমাকে বলো, রাজ আর কী কী করেছে যেটা আমি করতে বাকি রেখেছি? সুন্দর সুন্দর ডায়লগ দেয়া? ওসব বাস্তবে শোনালে তুমি হেসে কুটিকুটি হতে। সরিষা ক্ষেতে গান গাওয়া? তুমি আমাকে কুমার শানু এনে দাও, আমি তাঁর গানে লিপসিংক করে দিচ্ছি। ভাল কোরিওগ্রাফার আনো, নেচেও দেখাবো।"
বৌ চিন্তায় পড়ে গেল। আসলেই রাজ আর কী কী করেছে যা আমি করিনি। বেচারি হয়তো এখনও সেই তালিকা করার চেষ্টা করছে।
গানটির ব্যাপারে একটি মজার তথ্য। ফেলফেয়ারের আগের পাঁচ বারের আসরে টানা পাঁচবার সেরা গায়কের পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন কুমার শানু। পঞ্চমবার পুরস্কার নেয়ার সময়ে তিনি ভাব নিয়ে বলেন, "আসলে আমার মনে হয় অন্যদেরও মাঝে মাঝে সুযোগ দেয়া উচিৎ। হেহেহে।"
পরেরবার তাঁকে আর পুরস্কার দেয়া হয়নি। এর পরে আর কখনই তাঁকে পুরস্কার দেয়নি ফিল্মফেয়ার কর্তৃপক্ষ। উদিত নারায়নের উত্থানও এর পর থেকেই। সেবার শানুদা কণ্ঠ দিয়েছিলেন এই "তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম" গানে। হয়তো তাঁর জীবনের মোস্ট ডিজার্ভিং এওয়ার্ড ছিল এই গানটিই। আহারে বেচারা।
২. চান্দ ছুপা বাদল মে (হাম দিল দে চুকে সানাম):
আমি যে এত ঐশ্বরিয়া ঐশ্বরিয়া করি, সেটার কারন শুধু এই সিনেমা। আমার ধারণা আমার মতই যারা ঐশ্বরিয়া ঐশ্বরিয়া করেন, সবারই এই একই কারন। এই সিনেমাটা আমার জীবনে এসেছিল ঝড়ের মতন। সিনেমা শুরুর আগে আমি ছিলাম এক রকম, এবং আড়াইঘন্টা পরেই জীবন পাল্টে হয়ে গেল অন্যরকম। নন্দিনী চরিত্রটি তখন আমার রক্তে রক্তে প্রতিটি কোষে মিশে গেছে। "আখোঁ কী গুস্তাখিয়া" গানে ঐ চোখের ইশারায় সদ্য কৈশোরে পা দেয়া আমি ঘায়েল হয়েছিলাম, খুন হয়েছিলাম সেদিন। বুঝলাম কেন আমাদের বাপ দাদারা সুচিত্রা সেনের অমন ভক্ত ছিলেন। এই সিনেমা দেখিয়েছিল চেহারাগুনে নয়, সুন্দর মন দিয়েও নায়িকার মন জয় করা সম্ভব। চেহারার উপর কারোর হাত নেই, কিন্তু সুন্দর মানসিকতা পুরোটাই নিজের হাতে।
একদিকে সালমান খান, সুন্দর, হ্যান্ডসাম, বডি বিল্ডার, গায়ক, ডান্সার, সেন্স অফ হিউমার ইত্যাদি ইত্যাদি।
অন্যদিকে অজয় দেবগন। সাধারণ দর্শন, ব্যর্থ উকিল, বেসুরো গায়ক, কোন গুনই নজরে পড়ে না - কিন্তু হৃদয়টা খাঁটি সোনার। নন্দিনীরুপী ঐশ্বরিয়া সেই সুন্দর হৃদয়কেই বেছে নিল। এবং কিভাবে সেই সোনায় বাঁধানো হৃদয়ের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে, সেটি নিয়েই সিনেমার দ্বিতীয়ভাগ। আহ! আমার জীবনে দেখা সেরা কিছু রোমান্টিক সিনেমার একটি এটি।
এই গানটি বেছে নেয়ার কারন এই যে এক সিনেমায় সালমান ঐশ্বরিয়া কেমেস্ট্রি যেভাবে দৃশ্যায়িত হয়েছিল, তা আর কখনই কোন সিনেমায় পাই নি। কৈশোরের প্রেমের যে উচ্ছলতা, ভালবাসার সারল্য, বাঁধভাঙা এক্সপ্রেশন, রসায়ন - তা আর কেউ কখনই জমাতে পারেনি। আর কোন নায়িকার পাশে সালমানকে এতটা দ্রবীভূত হতে দেখিনি; ঐশ্বরিয়ার চোখে, মুখে অমন সারল্যভরা রোমান্স আর কোন নায়কের বিপরীতে দেখিনি। বিশ বছর পরেও গানটি এখনও আমাকে প্রেমে ফেলে, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ক্লাস নাইন টেনের বয়সে, যখন পৃথিবী ছিল সুন্দর-সরল, রঙিন ও ভাবনাহীন।
১. পেহলা নাশা, পেহলা খুমার (জো জিতা ওয়াহী সিকান্দার): আমার জীবনে শোনা সবচেয়ে রোমান্টিক গানটি এলো এমন এক সিনেমা থেকে যেটি কিনা রোমান্টিক সিনেমাই না। সাইকেল রেসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত সিনেমার এই গানটি যে কালোত্তীর্ণ, সেটি এখনও শুনলে বুঝতে পারবেন। আমির খান যে কী জিনিস তখনও দর্শক সেভাবে টের পায়নি, তবে গানটি যে তখনকার গতানুগতিক বলিউডি গান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেটি সুর হোক, বা দৃশ্যায়ন সবদিক দিয়েই - সেটি দেখলেই বুঝতে পারবেন।
প্রথম প্রেমে পড়া কতটা মধুর, কতটা সুন্দর, সেই ছোট ছোট অনুভূতিগুলো এত নিখুঁতভাবে প্রথম আমি এই গানটিতেই শুনি। গানটি যখন বের হয়, অবশ্যই প্রেম কী সেটা বুঝতাম না। বয়স ছিল কম। তবে যখন সত্যিকারের প্রেমে পড়লাম, মনে হলো আমার জন্যই এই গানটি বহু বছর আগে লেখা হয়েছিল। "কাভি কাভি মেরে দিল মে" গানটির মতন এই গানটিরও প্রতিটা কথা একদম অন্তর্ভেদী।
কয়েকদিন আগে রেডিওতে এই গানটির রিমিক্স ভার্সন (৯০এর দশকের পুরানো রিমিক্সটা না, নতুন রোবটিক রিমিক্স করেছে একজন) শুনে ইচ্ছা করছিল তখনই এয়ারপোর্টে গিয়ে টিকেট কেটে ইন্ডিয়া চলে যাই। তারপরে মুম্বাই এয়ারপোর্টে নেমেই কাল বিলম্ব না করে রিমিক্স কারিগরকে খুঁজে বের করি। তারপরে জুতা খুলে ময়লা গন্ধওয়ালা মোজা দিয়ে পিটিয়ে ব্যাটার পাছার ছাল তুলে দেই। নোংরা হাতে এই গান ছোঁয়া যে পাপ - তা কী এই আহাম্মকের বুরবাককে কেউ কখনই বলেনি?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:২৫