অবশেষে পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যানটিও বসে গেল। যুক্ত হয়ে গেল মহাখরস্রোতা ও বিচিত্র স্বভাবের উত্তাল অবাধ্য নদী পদ্মার দুই পার, মানুষের ক্ষমতার কাছে সেও আপাতত বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হলো। জয় হলো বাংলাদেশের, জয় হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জেদের। এবং জয় হলো তাঁদের, যারা তাঁকে এই স্বপ্ন দেখতে সাহস দিয়েছিলেন। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে তাই শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করছি। যিনি ছিলেন সেই স্বপ্নদ্রষ্টাদের একজন। আশা করা যাচ্ছে এক দেড় বছরের মধ্যেই সেতুটি চালু হয়ে যাবে। তবে এর আগেই দুই পারের মানুষের জীবনে চলে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বদলে যেতে শুরু করেছে অর্থনীতি।
প্রশ্ন আসতেই পারে, what's next?
আমেরিকায় প্রচুর হাইওয়ে আছে যেখানে আমাদের টোল দিতে হয়। টোলের পরিমান কম না। আমার এক কলিগকে প্রতি মাসে দুইশ ডলার টোল দিতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর লোকজন গালাগালি করে সরকারকে। একবার এক বাঙালি দাওয়াতে এক ভদ্রলোক রীতিমতন গুষ্ঠি উদ্ধার করছিলেন মার্কিন সরকারের। যিনি "ট্যাক্স" দিতে রাজি নন, কিন্তু যাবতীয় বেনিফিট পেতে আগ্রহী। একটু বেশি আহ্লাদী আবদার হয়ে গেল না?
এইটা সত্য যে এই টোলের টাকাতেই নতুন নতুন, আরও উন্নতমানের হাইওয়ে নির্মাণ হয়। জনতার জন্য রাস্তা বানিয়ে সেই রাস্তায় চলার জন্য জনতা থেকেই টাকা তুলে আবার জনতার জন্যই রাস্তা/ব্রিজ ইত্যাদি তৈরী করা হয়। আমি যেখানে থাকি, তের বছর আগে এর পাশ দিয়ে দুই লেনের হাইওয়ে চলে গিয়েছিল। এখন সেই একই হাইওয়ে পাঁচ পাঁচ মোট দশ লেনের। শুধু তাই না। যেসব শহরকে অনেক দূরের মনে হতো, যেতে কয়েক ঘন্টা সময় নষ্ট হতো, সেগুলো বেশ কিছু নতুন হাইওয়ে দ্বারা যুক্ত হয়ে গেছে। ষাট সত্তুর মাইল (প্রায় একশো কিমি) দূরের শহরে যেতে আমাদের এক ঘন্টা সময় লাগে মাত্র। এসব হাইওয়ে বাংলাদেশে থাকলে ঢাকা চিটাগং দূরত্ব দুই আড়াই ঘন্টায় পাড়ি দেয়া যেত। বুঝতে পারছেন আমাদের জীবনযাত্রার মান ও অর্থনীতি কিভাবে রাতারাতি পাল্টে যেত?
তা আমেরিকার হাইওয়ে নির্মাণের এই টাকা কোত্থেকে আসছে? আমাদের থেকেই।
এই যে নিজের পকেট থেকে হাজার কোটি টাকা খরচ করে বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতু তৈরী করে ফেললো। এখন যদি "ফ্রি" করে দেয়, তাহলে এই সেতু নির্মাণের খরচ তুলবে কিভাবে? আরও অনেক সেতু লাগবে না? আমাদের পদ্মার উপরেই একাধিক সেতু দরকার। যমুনার উপরেও তাই। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত একটি দরকার, চিটাগং থেকে সিলেট পর্যন্ত একটি, সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত আরেকটি টানা হাইওয়ে দরকার। এখন যেগুলো আছে সেগুলোকে হাইওয়ে বলে শুধু শুধু হাইওয়ের নামের বদনাম করবেন না। ওগুলো "রাস্তা।"
দেশের রাস্তাঘাট হচ্ছে আমাদের শরীরের শিরা ধমনীর মতন। যত বেশি থাকবে, রক্তচলাচল ততই মসৃন হবে। যেকোন দেশের ইকোনোমি নির্ভর করে এর যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর। আপনি সড়ক পথে বাংলাদেশকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলুন, একের পর এক বাইপাস সড়ক নির্মাণ করুন, রেলওয়ের উন্নতি ঘটান, এবং নৌ ও বিমান চলাচল সহজলভ্য করুন - তাহলেই দেখবেন দেশের অর্থনীতি বিশাল লাফ দিয়েছে। তখন আর মালেশিয়া সিঙ্গাপুরের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে হবেনা।
আমেরিকার ইকোনমির মেরুদন্ড এটাই। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে যেকোন উন্নত দেশের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।
কাজেই, "সরকার টোল নেয় কেন," এ নিয়ে গালাগালির কিছু নেই। টোল না নিলে যে সড়ক ব্যবহার করে পঞ্চাশ মাইল দূরের বাসা থেকে এত সহজে এখন অফিসে যাচ্ছেন, সেটাই নির্মিত হতো না। আপনাকে স্বল্প বেতনে কাজ নিতে হতো আপনারই এলাকার কোন প্রতিষ্ঠানে।
বাংলাদেশে এই মানের হাইওয়ে নির্মাণ শুরু হলে দেখা যাবে কুমিল্লা থেকে লোকজন ঢাকায় অফিস করে আবার কুমিল্লায় ফেরত যাচ্ছে। "ঘনবসতি" সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এদেশে লোকে তাই করছে।
তবে যেহেতু দেশটার নাম বাংলাদেশ এবং আমাদের রক্তে মিশে আছে দুর্নীতি, প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমার টোলের কত টাকা সরকারের পকেটে যাচ্ছে?
দুর্নীতি রোধে সরকার ডিজিটাল টোলের ব্যবস্থা করতে পারে। জানিনা দেশে ইতিমধ্যেই আছে কিনা। এটি হচ্ছে একটি "টোল ট্যাগ" স্টিকার, যা যেকোন গাড়ির উইন্ডশিল্ডে টাঙ্গানো থাকবে। এগুলো "প্রিপেইড" ট্যাগ। আগেভাবে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা (যেমন দশ হাজার টাকা) পরিশোধ করে রেজিস্ট্রেশন করলে তবেই এই চিপযুক্ত স্টিকার আপনার নামে ইস্যু হবে। একটি ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাংক একাউন্ট এই রেজিস্ট্রেশনে যুক্ত থাকে, যখন টোল কাটতে কাটতে ব্যালেন্স ফুরিয়ে আসে, তখন আপনাতেই সেই একাউন্ট থেকে টাকা কেটে আবার একাউন্ট রিলোড করা হয়ে যাবে। যদি কোন কারনে টাকা কাটা না যায়, যেমন একাউন্টে হয়তো পর্যাপ্ত ব্যালেন্স নেই, তখন এই চিপ সাময়িকভাবে বাতিল হয়ে যায়।
টোল রাস্তার শুরুতেই একটি স্ক্যানার থাকবে। টোল দিতে গাড়িকে থামতে হবেনা। একশো মাইল বেগে সেই স্ক্যানারের নিচে দিয়ে গাড়ি চলে গেলেও স্ক্যানার ঠিকই ট্যাগ স্ক্যান করে নিবে। আর যাদের ট্যাগ থাকবে না, তাদের পেছনের নাম্বার প্লেটের ছবি তুলে রাখবে। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ঠিকানা অনুযায়ী বাড়িতে বিল পাঠিয়ে দেয়া হবে। যদি কেউ বিল না দেয়, সরকার তখন গাড়ি তুলে নিয়ে যায়। হিসাব সহজ। কোন ভ্যাজাল নাই।
টোল ট্যাগের সুবিধা হচ্ছে, ট্যাগ থাকলে আপনি টোলেও ডিসকাউন্ট পাবেন। সাধারণকে যেখানে একশো টাকা টোল দিতে হয়, আপনাকে হয়তো ষাট টাকা দিতে হচ্ছে। এই ডিসকাউন্টের কারণেই বেশিরভাগ মানুষ টোল ট্যাগ নিয়ে থাকেন।
অটোমেটিক মেশিনে টাকা কাটা শুরু হলে দুর্নীতি কম হবে, সরকারের টাকা সরকারের কাছেই যাবে, সেই টাকায় নির্মিত হবে আরও বড় বড় সেতু ও সড়ক। বদলে যাবে বাংলাদেশের চেহারা।
টোল ট্যাগ প্রযুক্তি অতি সহজ প্রযুক্তি। বিশ্বের সব দেশেই নানান মডেল আছে। ইচ্ছা করলেই কপি পেস্ট করতে পারবে আমাদের ডেভলোপাররা। আর যদি আমরা আরও উন্নত নির্ভুল কিছু বানাতে পারি, তাহলেতো কথাই নাই।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৫৩