somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক চোর আরেক চোরকে জোর গলায় ধমক দেয় কোন সাহসে?

১২ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এদেশে সেদিন ক্যাশে কিছু একটা কিনলাম। দোকানদার একদম আনায় আনায় ভাংতি টাকা ফেরত দিল। চব্বিশ ডলার সাতান্ন সেন্ট।
বাংলাদেশে যখন কিনতাম, তখন দোকানদার এক দুই টাকার জায়গায় অতি জঘন্য লজেন্স ধরিয়ে দিত। "এইটা কেন দিলেন" বললে বলতো "ভাংতি নাই।"
অথচ সেই একই দোকানদারের কাছ থেকে এক দুইটাকার কিছু কিনুন, তাঁকে তাঁর লজেন্স দিয়েই দাম মেটানোর চেষ্টা করুন, জবাব কি দেয় সেটা এই কমেন্টে লিখতে পারেন।
অফিসের পিওনকে রাখা হয় এমপ্লয়িদের ফুটফরমাশ খাটার জন্য। আপনার চা লাগবে, সে এনে দিবে। আপনার সিঙ্গারা খেতে ইচ্ছা করছে, সে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসবে। আপনার ফটোস্ট্যাট, প্রিন্টার কপি ইত্যাদি দরকার - এসব তার কাজ। সেজন্য ওকে বেতন দেয়া হয়। ঠিক না? দুই টাকার সিঙ্গারা আনতে ওর হাতে দশ টাকা দিন, একটাকাও ফেরত পাবেন না। ভাংতি টাকা কই জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাবেন, "ওটা স্যার বখশিশ!"
পুরো পরিবার মিলে ট্রেনে চড়বো। একটি ফার্স্ট ক্লাস রুম রিজার্ভ করলাম। হাজার টাকার নোট দিলাম। টিকিটের মূল্য কেটে একশো টাকার কাছাকাছি ফেরত দেয়ার কথা। একটাকাও ফেরত পেলাম না। ঘটনা কি?
"ওটা বখশিশ।"
"কিসের বখশিশ?"
"টিকেটের এই আকালের সময়ে আপনাকে টিকেট জোগাড় করে দিলাম, আমাদের চা পানি খাওয়ার টাকা দিবেন না?"
খুবই মেজাজ খারাপ হবার মতন কথা। দেশে গেলে এই কারণেই আমার প্রেশার অনেক হাই থাকে। পায়ের স্যান্ডেল খুলে গাল বরাবর পেটাতে পারলে একটু প্রেশার কমতো।
"আপনার চা পানি খাওয়াতে গিয়েতো আমার বাড়ি ফেরার রিক্সা ভাড়া নাই।"
"বাসায় গিয়ে দিবেন।"
"বাসায় কেউ থাকেনা, আমি একা থাকি।"
লোকটা তাচ্ছিল্যের সাথে আমার দিকে দশটা টাকা ছুড়ে দিল যেন আমি ওর কাছে ভিক্ষা চাইছিলাম।
উবার পূর্বযুগের সিএনজিওয়ালাদের কথা কে না মনে রেখেছে? ভাড়া যেখানে একশো হবার কথা, সেখানে তিনশো চেয়ে বসেছে। কিছুই করার নেই। যেতেই হবে। যাত্রীদের বুকের উপর পা চেপে রেখে লকলকে জিভ বের করে আমাদের রক্ত চুষে খেয়েছে। উবার আসার পরে ওরা যখন আন্দোলন করেছিল, বিন্দুমাত্র দয়া আসেনি ওদের প্রতি। সুসময়ে ওরা আমাদের ঘাড় মটকেছে, এখন যখন চোরাবালিতে ফেঁসেছে, তখন আমি কেন দয়া দেখাবো?
সরকারি অফিসে দুর্নীতির কথা নাই বা বললাম। এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ফাইল যাবে, জনপ্রতি ঘুষ খাওয়াতে হয়। প্রাইভেট সেক্টরেও এখন ঘুষ চলছে। পিওন বড় সাহেবের কাছে কিছু নিয়ে যাবে, বখশিশ দিতে হবে। বাড়িতে ড্রাইভার রাখবেন, ভরসা করতে পারবেন না। তেল চুরি করবে। টায়ার বেঁচে দিবে। নাহলে আপনার অবর্তমানে, আপনাকে না জানিয়ে আপনার গাড়ি দিয়ে নিজেই ড্রাইভিং স্কুল খুলে বসবে। একবার আমাদের ড্রাইভারকে আমরা হাতে নাতে ধরে ফেলেছিলাম। সে নিজের ভাইকে ড্রাইভিং ট্রেনিং দিচ্ছিল। ভাগ্য খারাপ। একদম আমার আর আব্বুর সামনে পড়ে গেল।
বইমেলায় গেছি, যাব উত্তরা। সিএনজি খুঁজছি, পাচ্ছি না। এক ড্রাইভার এসে বললো সে তার গাড়িতে করে পৌঁছে দিবে, এত টাকা দিতে হবে। মালিক বইমেলায়, এক দুই ঘন্টার আগে বেরুবে না। এই চান্সে সে বাড়তি কিছু কামিয়ে নিবে।
সাধারণ বাড়ি ঘরে অনেকেই ইলেকট্রিক মিস্ত্রির সাথে কথা বলে পানির মোটরকে মিটারের আওতার বাইরে রাখতো। মানে সেই মোটরে বিল উঠতো না।
বাবুর্চি কন্ট্রাক্ট নিয়েছে এত জনের রান্না রেঁধে দিবে। ডিব্বা ডিব্বা ঘি, তেল, চাল নিজের সাগরেদের মাধ্যমে পাচার করে দিল। কোরবানির পশু জবাই হয়েছে। কসাই মাংস কাটছে। আপনি চোখ সরান। চোখের পলকে পাঁচ দশ কেজি মাংস গায়েব করে ফেলে।
দেশি মাছ কিনে এনেছি, ভিতরে লোহা ভরে ওজন বাড়ানো হয়েছে। এক বস্তা চাল কিনলে ভিতরে আরামসে এক কেজি কংকর পাওয়া যায়। ডালের মাঝেও তাই। গোয়ালা দুধে পানি না, পানিতে দুধ মেশায়। কেমিকেল, ফরমালিন, ভেজাল ইত্যাদির উদাহরণ নাই বা দিলাম।
এইসব নিজের অভিজ্ঞতার উদাহরণ। অতি সাধারণ বাংলাদেশিদের কারসাজি যার ভুক্তভোগী আমি নিজে। কেউ গুজব বলে উড়িয়ে দিতে চাইলে আমার সামনে চেষ্টা করুক।

তা পদ্মা সেতু ইস্যুতে এখন অনেকেই প্রসঙ্গ তুলছেন এই প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে।
প্রিয় ভাইয়েরা ও বোনেরা, বাংলাদেশে সামান্য চা বিস্কিট খাওয়ার "কন্ট্রাক্টে" দুর্নীতি হয়, সেখানে আস্ত একটা সেতু প্রকল্প, যেখানে হাজার কোটি টাকা জড়িত, সেখানে দুর্নীতি হবেনা এ কথা আশা করেন কিভাবে? উপরে যেসব জোচ্চোরগুলির উদাহরণ দিলাম, সবগুলিই আমার আপনার মতন সাধারণ মানুষ। এ থেকেই প্রমান হয় যে সুযোগ পেলেই আমরা দুর্নীতি করি। একের হক অন্যে মেরে খাই। আমরা শুধু শুধু পৃথিবীর অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ না। সরকারি বিরোধী যেকোন দলে যারা যায়, তারা আমাদের মধ্য থেকেই যায়। আমরা সবাই সাধু হলে ওরাও সাধুই হতো। আমরা বাটপার, আমাদের নেতারাও তাই বাটপার।

আমাদের ধরেই নিতে হবে এসব প্রকল্পে প্রচুর চুরি চামারি ডাকাতি হবে। বালিশের দাম, পর্দার দাম ইত্যাদি নিয়ে নির্লজ্জের মতন দুর্নীতি হয়। সরকারি দলের আতি পাতি নেতারাও কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ে। আমরা সেসব নিয়ে ট্রল করি। আমাদের মেনে নিতেই হয়। তাই কেউ যদি গলা কেটেও বলে যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিন্দুমাত্র দুর্নীতি হয়নি, তাহলে আমি নিজেই হেসেই উড়িয়ে দিব।
এতকিছুর পরেও আমি পজিটিভ দিকটাই তুলে ধরবো।
ইচ্ছা করলেই সরকার সেতুর মূলা ঝুলিয়ে আরও হাজার কোটি টাকা মারতে পারতো। আস্ত ব্রিজের টাকা মেরে দিয়ে দুইটা বাঁশ ফেলে সাঁকো বানিয়ে চালিয়ে দেয়ার ঘটনা আমাদের দেশে বহু ঘটেছে। একটি জোক প্রচলিত ছিল আমাদের ছোটবেলায়। তিন দেশের তিন মন্ত্রী নিজ নিজ বাড়ির ছবি দেখাচ্ছিল। প্রথমজনের বাড়ি বিলাসবহুল। বাকি দুই দেশের মন্ত্রী জানতে চাইলেন, কিভাবে বানালে? সে একটি ব্রিজের ছবি দেখিয়ে বললো, ব্রিজটা দেখছো?
হু।
এর ২৫% মেরে দিয়েছি। হাহাহা।
হাহাহা। এই দেখো বন্ধু আমার বাড়ি!
এই বাড়ি আগের মন্ত্রীর বাড়ির চাইতেও সুন্দর।
কিভাবে করলে?
দ্বিতীয় মন্ত্রী পকেট থেকে আরেকটি ব্রিজের ছবি বের করলো।
কত মারলে?
৫০%!
বাপরে বাপ! তুমি দেখি আমারও বাপ! বলেই প্রথম মন্ত্রী হাহা করে হাসতে লাগলো।
তৃতীয় মন্ত্রী ছিলেন বাংলাদেশী। তিনি মুচকি হেসে নিজের বাড়ি বের করলেন। এ যেন রাজপ্রাসাদ। এর বাড়ির তুলনায় আগের দুই বাড়ি বস্তি। দুই মন্ত্রী চোখ কপালে তুলে বললেন, "কিভাবে?"
বাংলাদেশী নিজের পকেট থেকে একটি ছবি বের করলেন। নদীর ছবি।
"ব্রিজ কই?" বাকি দুই মন্ত্রীর বিস্ফোরিত প্রশ্ন।
"পুরোটাই মেরে দিয়েছি।" বাংলাদেশী মন্ত্রীর গর্বিত জবাব।

তা এইবার আমাদের ব্রিজ মার যায়নি। আমরা আস্ত ব্রিজই পেয়েছি। গর্বের ব্রিজ। আত্মবিশ্বাসের ব্রিজ। এই ব্রিজ স্বপ্ন দেখায় আমরা ইচ্ছা করলেই পারবো এমন আরও অনেক ব্রিজ বানাতে। দুর্নীতি বন্ধ করলেই এমন বহু ব্রিজ দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের দেশটাও রাতারাতি পাল্টে যাবে।
আর দুর্নীতি তখনই বন্ধ হবে যখন আমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে ঠিক হবো। যেদিন আমরা নিজেরা নিজেদের যে কাজের জন্য বেতন দেয়া হচ্ছে, সেই কাজ করার জন্য অন্যকে জিম্মি করে পয়সা আদায় করবো না। হয়তো দুই টাকা আয় করবো, কিন্তু নিজেদের সৎ আয় নিয়ে গর্বিত হতে শিখবো। আলগা ফুটানি দেখাতে অন্যের গলায় ছুরি চালাবো না। কেবল তখনই "দুর্নীতিবাজ সরকারকে" গালাগালি করা আমাদের মানাবে। নাহলে ব্যাপারটা কেমন যেন লাগে। এক চোর আরেক চোরকে জোর গলায় ধমক দেয় কোন সাহসে?
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:১২
৮টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×