গতকালের পোস্টে বলছিলাম যে এদেশের প্রতিটা নাগরিক যেহেতু ট্যাক্স দেয়, সেহেতু সরকারের প্রতিটা কর্মকান্ডের উপর প্রশ্ন করার অধিকার তাঁর আছে। কথাটি কেবল আমাদের বাংলাদেশের জন্যই না, বিশ্বের প্রতিটা সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যই প্রযোজ্য। হ্যা, আমাদের দেশে গণতন্ত্রের চর্চা কতখানি হয়, সেটা নিয়ে তর্ক করতে পারেন। ফ্রীডম অফ স্পিচের অস্তিত্ব কতটুকু সেটা নিয়ে তর্ক করতে পারেন। আমার সাথে না। এই ব্যাপারে আমি আপনার সাথে বিন্দুমাত্র তর্ক করবো না। যারা এসবের অস্তিত্ব নিয়ে দাবি করে, তাঁদের সাথে আপনার তর্ক উৎসুক জনতা হিসেবে দেখবো।
তা সেইসব লেখায় কয়েকজনকেই দেখলাম প্রশ্ন করতে যে বাংলাদেশের কতজন মানুষই বা "ট্যাক্স" দেয়। একজন তথ্য উপাত্ত পেশ করলেন যে আঠারো বিশ কোটির মধ্যে বারো লক্ষও হবে না সেই সংখ্যা। কাউকে কাউকে সমর্থন করতেও দেখলাম।
তাই ভাবলাম ট্যাক্সের ব্যপারে কিছু বলি।
সবার আগে বলে নেই এই বিষয়ে লেখার অধিকারের ব্যাপারে আমার যোগ্যতা সম্পর্কে।
আমার পড়াশোনা একাউন্টিং এবং ফাইন্যান্স নিয়ে। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এট ডালাসের ডিগ্রি আছে এই বিষয়ের উপরেই। পেশাগতভাবেও আমি একজন সিনিয়র কর্পোরেট একাউন্ট্যান্ট। ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে কাজ না করলেও কিছুটা ধারণা যে আছে আশা করি সেটা বুঝতেই পারছেন। তাই যা বলবো, সেটা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়ার আগে ডিগ্রি এবং প্রফেশনটার একটু হলেও সম্মান করবেন প্লিজ। অনেক পরিশ্রম আর টাকা খরচ করে ডিগ্রীটা পেয়েছি, একটুতো দাম দিন।
"বাংলাদেশে মাত্র বারো লক্ষ মানুষ ট্যাক্স দেয়" - কথাটি কতটুকু সত্য?
উত্তর হচ্ছে, ১০০% ভুল। ট্যাক্স বলতে শুধু ইনকাম ট্যাক্স বুঝালে হয়তো পালে খানিকটা হাওয়া পাবে, কিন্তু ইনকাম ট্যাক্স ছাড়াও আরও অনেক রকমের ট্যাক্স আছে। যেমন ধরেন "ভ্যাট" বা ভ্যালু এডেড ট্যাক্স।
এই যে আমি আপনি কিছু কিনলেই পনেরো পার্সেন্ট ট্যাক্স দিয়ে (একশো টাকার জিনিস একশো পনেরো টাকায়) কিনছেন, এটা কি ট্যাক্স দেয়া নয়? এই টাকা কোথায় যাচ্ছে? দোকানদার নিজে মেরে দিচ্ছে? সেটা সে করতেই পারে, এবং সেটা হবে তার অবৈধ আয়। কিন্তু কাগজে কলমে সেটি সরকারের কাছে যায়। দোকানদার টাকা মেরে দিলে ওর জেল জরিমানা ও ব্যবসার লাইসেন্স ক্যানসেল হবার কথা। কোথাও কোথাও বিরাট অংকের জরিমানা হচ্ছে। এই কারণেই।
ধরে নিলাম দেশের সব দোকানে ভ্যাট কাটে না। আসলে ধরাধরির কিছু নেই। বাস্তবেই ছোট ছোট বেশিরভাগ দোকানেই ভ্যাট কাটে না। তারপরেও ব্যবসায়ীদের প্রতি বছর আয়কর দিতেই হয়। ইউনিলিভার, সিমেন্স, হোলসিম, আড়ং ইত্যাদি যাবতীয় কোম্পানি নিজেদের পণ্য বিক্রির সময়ে যখন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে, তখন পণ্যের যাবতীয় খরচের হিসাবের খাতায় ট্যাক্সকেও যোগ করে। ম্যানুফ্যাকচারিং কস্ট দুই টাকা, শিপিং এন্ড হ্যান্ডলিং এক টাকা, কর্মচারী বেতন ভাতা ২ টাকা - এইভাবে যাবতীয় হিসাব লিখতে লিখতে একটা পর্যায়ে দেখবেন "ট্যাক্স/কর পঞ্চাশ পয়সা" এইরকম কিছু। মোট খরচ সাত টাকা হলে মূল্য নির্ধারিত হয় একুশ-বাইশ টাকা। যদি ট্যাক্স না কাটতো, তাহলে হয়তো মূল্য নির্ধারিত হতো কুড়ি টাকা পঞ্চাশ পয়সা। মানে হচ্ছে, এই যে কোম্পানিগুলো সরকারকে ট্যাক্স প্রদান করে, সেটা আপনার আমার মতন কাস্টমারদের কাছ থেকেই আদায় করে, নিজের পকেট থেকে দেয় না।
মোবাইলে কথা বলবেন? সেখানেও যে রেট রাখা হয়, ট্যাক্স ধরেই সেই রেট নির্ধারণ করা হয়। বিড়ি ফুঁকবেন? এক শলাকা কিনলেন। সেখানেও ট্যাক্স ইনক্লুডেড। চাল ডাল প্যাকেজড পণ্য ইত্যাদি সবকিছুতেই ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এ কারণেই বছরের বাজেট ঘোষণার সাথে বাজারে পণ্যের দাম ওঠা নামা করে। দেশে শুধু নিঃশ্বাস নেয়া ছাড়া যাবতীয় কর্মকান্ডে ট্যাক্স জড়িত। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, টোল দিতে হচ্ছে। সেটাও ট্যাক্স। আপনি ভূমির মালিক, ভূমি কর দেন না? বাড়ি তৈরী করলেতো খাজনা দিতেই হয়। এগুলোও ট্যাক্স। পথের ভিখারি, যে অন্যের দয়ায় চলে, সেও বেঁচে থাকার জন্য কিছু না কিছু কিনে খায়। না চাইলেও তাঁকে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে।
যেকোন দেশের সরকারের প্রধানতম আয়ের উৎস "ট্যাক্স।" ট্যাক্স না পেলে সেই সরকার দেউলিয়া হয়ে যাবে। এবং এই কারণেই যেকোন সরকার তাঁর যাবতীয় কর্মকান্ডের জন্য জনগনের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। যে দেশের সরকার যত স্বচ্ছ, সেদেশ তত দুর্নীতিমুক্ত।
আমার ট্যাক্সের টাকায় সরকার কি করবে না করবে, সে ব্যাপারে কথা বলার অধিকার অবশ্যই আমার আছে। আমি শত কোটি টাকার মালিক হলেও সমান, আমি পথের ভিখিরি হলেও সমান। রাষ্ট্র কখনই তাঁর জনগনের মাঝে বিত্তের ভিত্তিতে পার্থক্য টানতে পারবে না।
যেমন আমেরিকান সরকার ইচ্ছা করলেই ইরানে হামলা করতে পারে। আমি হোয়াইট হাউজের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করবো "না! আমার ট্যাক্সের টাকায় সাধারণ মানুষ মারা আমি সমর্থন করি না।"
মার্কিন সরকার হেসে উড়িয়ে দিতে পারে। ওদের একেকটি বোমার মূল্য আমার বছরের আয়ের চেয়ে বেশি। ট্যাক্সে আমি কতটাকাই বা দেই? তারপরেও ওরা আমাদের এই ভাবনা, চেতনা, মতামতকে গুরুত্বের সাথেই নেয়। এটাকেই বলে "গণতন্ত্র।" এটাকেই বলে "নাগরিক অধিকার।"
আমি যেমন বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি করতেই পারি স্বাস্থখাতে বেশি বেশি করে বাজেট বাড়ানো হোক। চিকিত্সাক্ষেত্রকে আরও জনমুখী ও আধুনিক করা হোক।
আমার কথা, দাবিকে আমলে নেয়া না নেয়াটা সরকারের ব্যাপারে। সরকার যদি মনে করে স্বাস্থখাতের মতন অগুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে টাকা ব্যয় না করে আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে, যেমন আতশবাজিতে সে টাকা খরচ করা হোক, সেটা তাঁদের সিদ্ধান্ত।
আমাদের দেশের মন্ত্রী এমপিরা জ্বর হলেও বিদেশে ছুটেন চিকিৎসা করাতে। বিদেশে বিল কেমন আসে একটি উদাহরণ কেবল দেই। আমার ছোট ছেলের জন্মের সময়ে মেডিকেল বিল এসেছে আঠাশ হাজার ডলার। আমার বৌ একবার চারদিনের জন্য হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল। বিল এসেছিল চল্লিশ হাজার ডলার। আমার বড় ছেলে প্রচুর চকলেট, ললিপপ ইত্যাদি খেয়ে দাঁতের বারোটা বাজিয়েছে। দাঁতের ক্ষয় ঠিক করতে দশ হাজার ডলারের বেশি খরচ হচ্ছে। তাহলে বুঝে নিন বিদেশের এই সমস্ত চিকিৎসার বিল, তাঁদের থাকা খাওয়া, তাঁদের সাথে যাওয়া আত্মীয় স্বজনদের থাকা খাওয়ার খরচ রাষ্ট্র বহন করে। আমার আপনার টাকায়। আর আমরা আমাদের চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হই, আতঙ্কের সাথে লক্ষ্য করি বিছানার তোষকে, বালিশে তেলাপোকা গিজগিজ করছে।
আমি যেমন দাবি করি হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে খাওয়া দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি। কেন? কারন ওরা আমার কষ্টার্জিত টাকাই মেরে খাচ্ছে। আমি প্রবাসে থাকলেও বাপ দাদার সম্পত্তি দেশে পড়ে আছে, সেগুলোর জন্য প্রতিবছর খাজনা দিতে হচ্ছে। দেশে কাউকে টাকা পাঠালে, একটি অংশ সরকার পাচ্ছে। ফাজলামি করার জন্য সেগুলো দিচ্ছি না।
চুরি বিষয়টাকে কেবল বাংলাদেশেই খুব হালকাভাবে নেয়া হয়। জন্মের পর থেকেই আমরা চারদিকে এতবেশি চুরি হতে দেখি যে আমরা একদমই ইমিউন্ড হয়ে গিয়েছি। আমরা কেবল দুইশ টাকা চুরি করা ছিঁচকে চোরের উপরই বাহাদুরি দেখাই। দুই হাজার কোটি টাকা লোপাট করা বদমাইশকে এমপি মন্ত্রীর পদ দিয়ে দেই। অথচ ইসলামে এর শাস্তি হস্ত কর্তন! অন্যান্য দেশেও কঠিন শাস্তি। কেন?
"চুরি" কেমন জঘন্য অপরাধ সেটার উদাহরণ আগেও কয়েকটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। আবারও করি। তাহলে বুঝতে পারবেন।
ধরুন আমার খুব শখ একটি আইফোন লেটেস্ট মডেলের সেট কেনার। আমি গরিব মানুষ। আয় রোজগার কম। কিন্তু সেটটি আমি আমার বৌকে উপহার দিতে চাই। সারাজীবনে বেচারিকে কিছু দিতে পারিনাই। এই একটাই দামি জিনিস দিয়ে তাঁকে খুশি করার চেষ্টা।
আমি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর টাকা জমাতে শুরু করলাম। প্রতি বছরই একটি করে মডেল আসতে শুরু করলো। আমিও আমার নির্দিষ্ট বাজেটের দিকে ক্রমশ এগুতে লাগলাম। এক পর্যায়ে পাঁচ ছয় বছরের কঠোর পরিশ্রমে বাজেটের টাকা জমে গেল। আমি লক্ষ টাকা ব্যয় করে আইফোন কিনলাম। আমার বৌ খুব খুশি হলো। এবং মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় কেউ সেই ফোন চুরি করে ফেলল।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে লাখ টাকাইতো চুরি করেছে, এ আর এমনকি? ছয় মাসের জেল দিলেও সেটা অনেক বেশি কঠোর শাস্তি হয়ে যাবে।
কিন্তু কেউ এই বিষয়টা বিবেচনাতেই নিচ্ছে না যে এই চোর শুধু লাখ টাকাই চুরি করেনি, আমার চার পাঁচ বছরের "সময়টা" কেড়ে নিয়েছে। আমি যদি ষাট বছর বাঁচি, এই লোকটা সেই সীমিত সময়ের থেকে চার পাঁচ বছর কেড়ে নিয়েছে। এখন বিবেচনায় নিন লোকজনের পেনশনের টাকা যারা ঘুষ ছাড়া দিতে চায়না এমন লোকজনের কি শাস্তি হওয়া উচিৎ? বা যারা মানুষের জীবনের সমস্ত সঞ্চয়, পুঁজি ইত্যাদি লুটে খায়, ওদের কি শাস্তি হওয়া উচিৎ? "স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের গাড়ি চালক আব্দুল মালেক শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক" বিষয়টা মোটেও হাসি তামাশার না। বালিশের মূল্য এত হাজার টাকা বা পর্দার দাম এত লাখ টাকা দেখিয়ে জনতার পয়সা মেরে খাওয়া লোকগুলোর অপরাধ মোটেও ট্রলিংয়ের বিষয় না। যে টাকাগুলো ওরা মেরেছিল, মারছে এবং মারবে, সেগুলো আমার আপনারই পরিশ্রমের টাকা। ঐ টাকায় আমার বাচ্চার অনেক শখ আমার বাবা মা বৌয়ের অনেক স্বপ্ন পূরণ হতো। সহজ হতো নিজের জীবন। চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সম্ভব হতো লাখো মুমূর্ষের। একবার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখেন কত শিশু কেবলমাত্র টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। তাঁদের বাবা মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারলে আপনাকে স্যালুট! সেই টাকা মেরে দেয়া লোকজনকে হাসিমুখে মাফ করে দেয়ার কলিজা আমার নাই।
যাই হোক, মূল বিষয় ছিল "দেশে সবাই ট্যাক্স দেয়না" - বিষয়টি বুঝিয়ে বলা।
আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
এখনও না বুঝে থাকলে যেকোন স্বনামধন্য লেখকের অর্থনীতির উপর লেখা বই কিনে ট্যাক্স চ্যাপ্টারটি পড়ে নিন।
ভাল থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ২:৩৮