অবশেষে দেশ আবারও স্বৈরাচারমুক্ত হলো। দেশবাসীকে বিজয়ের অভিনন্দন!
গতকালই স্বৈরাচার বিরোধী সমাবেশে আমার এক দুলাভাই, যিনি এরশাদের পতন দেখেছেন, তিনি বলেন, "দোয়া কর, যেন ২০ বছর পরে লোকে না বলে যে 'এরচেয়েতো খালেদা হাসিনাই ভাল ছিল।'"
কথাটার মর্মার্থ খুবই গভীর।
এরশাদের সময়ে আমরা ছিলাম একেবারেই শিশু, কিছুই মনে নেই। খালেদা-হাসিনা যুগে বেড়ে উঠেছি। এবং যা দেখেছি, তাতো চোখের সামনেই আছে।
আমার বৌ তাই মাঝ রাত থেকেই লাফাচ্ছে "আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি! আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি!"
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্বৈরাচারীরা বারবার ভুল যায়। "সহমত স্যার/ম্যাডাম/ভাই" ধরনের চাটুকারদের কারণেই ওদের ডুবতে হয়। সরকার যদি শুরু থেকেই গঠনমূলক সমালোচনা নিতে পারতো, দমন পীড়ন, স্বেচ্ছাচারিতা, বাক স্বাধীনতাহরণ ইত্যাদি বাদ দিত, কথায় কথায় জামাত-শিবির গেম প্লে না করে সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধান করতো, বিরোধীদের সাথে সাথে নিজের দলের চোরদেরও সামলাতো, তাহলে আজকে বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে এইভাবে মাথা নত করে চোখের পানি ফেলে হেলিকপ্টারে চেপে চোরের মতন দেশ ত্যাগ করতে হতো না।
উনারতো ভাগ্য ভাল যে উনি পালিয়ে যেতে পেরেছেন। উনার বিরুদ্ধে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ হত্যার মামলা হবে। তাঁর গ্রেফতার হওয়ার কথা। ফাঁসি বা জেলতো হবেই। এখন বিদেশে পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে আরামসে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন।
এখন কোথায় ওবায়দুল কাদের, আরাফাত, পলক বা "শেখ হাসিনার পাশে আছি" ভাই ব্রাদাররা? কারোরতো শুরুতেই বলা উচিত ছিল "ম্যাডাম, ছাত্ররা যা চাইছে, আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান করে নিন। ওদের দাবিটা মোটেই অন্যায্য নয়।"
আমি নিশ্চিত কেউ হয়তো বলেছিলো, কিন্তু দম্ভের কারনে তিনি ওদের পাত্তা দেননি।
অথবা কেউ বলারই সাহস করেনি। জানে, দম্ভের কারণেই তিনি শুনবেন না।
তিনি শুনেছেন ওবায়দুল কাদেরের কথা "রাজপথে ছাত্রলীগ ওদের দেখে নিবে।"
সাথে ঘেউ ঘেউ করেছে ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন "স্বঘোষিত রাজাকারদের ক্যাম্পাসছাড়া করবে ছাত্রলীগ।"
পুলিশ গুলি চালালো আবু সাঈদের বুকে।
বিস্মিত যুবকটা কি বুঝতে পেরেছিল এই গুলির মধ্য দিয়েই পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে একচেটিয়া স্বৈরাচারী সরকারের পতন শুরু হয়ে গেছে?
আহারে বেচারা! দেখে যেতে পারলো না। ওর মা বলেছিল, "আমার ছেলেকে চাকরি দিবা না ভাল কথা, মেরে ফেললে কেন?"
প্রতিটা সাধারণ মানুষের বুকে এসে বিঁধেছে প্রশ্নটা।
এর আগে পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে অতি সহজেই সমাধান সম্ভব ছিল। ৯ দফা কেন, একশো দফা, হাজার দফা দাবিও সমাধান সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী চাইলেই মমতাময়ী জননী হতে পারতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই কঠিন থেকে কঠিন হৃদয় ব্যক্তিরও মন দ্রবীভূত হতে বাধ্য। মনে আছে, বহু আগে পুরান ঢাকায় বিয়ের অনুষ্ঠানে আগুনে ঝলসে মারা যায় বর ও কনে বাড়ির আত্মীয়স্বজন। বিয়ে পন্ড হয়। শেখ হাসিনা গণভবনে সেই দম্পতির বিয়ে দিয়েছিলেন। আমার অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, যিনি দুইচোখে আওয়ামীলীগকে দেখতে পারতেন না, যিনি বিশ্বাস করতেন ইবলিসকেও বিশ্বাস করা যায়, তবু আওয়ামীলীগকে নয়; যিনি আওয়ামীলীগের অপর নাম দিয়েছিলেন মুনাফেকলীগ, তিনি সেদিন নিজের অন্তর থেকে বলেছিলেন "এই কাজটা শেখ হাসিনা খুব ভাল করেছে।"
ক্ষমতাবানদের পক্ষে মানুষের মন জয় করা এতই সহজ।
কিন্তু যেই মুহূর্তে আপনি সাধারণ কোন মানুষকে গুলি করে হত্যা করবেন, এরপরে সেটা খুনের ঘটনা হয়ে যায়। তখন আর ফেরার কোন পথ থাকেনা। বুঝা গিয়েছিল, এই শেষ। এইবার আর শেখের বেটির নিস্তার নেই।
সরকার এরপরে আরও ব্যাপক গিট্টু পাকালো। একের পর এক ছাত্র, গৃহিনী, শিশু হত্যা শুরু করলো। কোন দুঃখপ্রকাশ নয়, উল্টো ওদেরকে জামাত শিবিরের সন্ত্রাসী, দুষ্কৃতিকারী ইত্যাদি ট্যাগ দিতে শুরু করে। এমনকি যে পুলিশ ওদেরই নির্দেশে আবু সাঈদকে হত্যা করে, সেও নাকি এক্স শিবির! এইটা কোন কথা?
মেট্রোরেলের জন্য যে কান্না কেঁদেছেন, সেই কান্নাটা যদি দেশের মানুষ জন্য কাঁদতেন, তাহলেও হয়তো লোকে সহ্য করতো। বলতে পারতো, "ম্যাডাম দেখেন, আপনার লোকেরা আমাদের উপর কি অনাচার করছে! আপনি বিচার করেন!"
কিন্তু ম্যাডাম নিশ্চুপ থাকায় লোকে বুঝে নিল ম্যাডাম নিজেই জড়িত। যিনি বিচার করবেন কি? ইনি ১৬ বছরের নিষ্পাপ বালককে খুনের আসামি বানাচ্ছেন। বাড়ি থেকে যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। পিটিয়ে মুচলেকায় সই আদায় করছেন।
যে লোকটা মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রশংসায় মুখে ফ্যানা তুলতো, সেও এরপরে বলল "খুনি হাসিনার বিচার চাই! স্বৈরাচার নিপাত যাক!" কারন সে জানে, হয়তো তাঁর ছেলেকেও রাস্তায় গুলি খেয়ে মরতে হবে।
শুরু থেকেই আমাদের বাক স্বাধীনতা ছিল না, কথায় কথায় অমুক তমুককে গ্রেফতার করা হতো। প্রথম আলো পত্রিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল শিশিরের ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন, সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বহু বছর। মানুষ মন খুলে কথা বলতে ভয় পেত। ফোনে আড়িপাতা হয়। যখন তখন যার তার ফোনালাপ ফাঁস হয়। গুমের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল বহুগুন। ডিবির লোকেরা সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যেত, তারপরে আর খোঁজ নেই। আজও বহু পরিবার ওদের স্বজনদের খোঁজ জানেনা। কুখ্যাত ডিজিটাল আইনের কারনে নানান ফেসবুক গ্রূপের এডমিনদের পর্যন্ত জেল খাটতে হয়েছে। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় যখনই কিছু লিখতাম, বহু শুভাকাংখীর ফোন আসতো, "তোমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করো। বাচ্চাদের কথা চিন্তা করো। এতটা স্পষ্ট ভাষায় কিছু লিখো না। তোমার লেখারই বা দরকার কি? লিখে কি হবে?"
"কিন্তু আমিতো সরকারের বিরুদ্ধে লিখি না, সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখি।"
"সেটা কি ওরা বুঝবে? এত বুদ্ধি থাকলেতো অন্যায়ই করতো না। তুমি দেশে যেও না।"
"আমার নিজের দেশ, আমি যাব না?"
"না। ওটা এখন আওয়ামীলীগের, সহমত ভাইদের দেশ।"
চাটার দল এসবের নিন্দাপ্রকাশের পরিবর্তে জঙ্গি, বিএনপির এজেন্ট, শিবির ইত্যাদি ট্যাগ দিতে শুরু করে। জনতার ক্ষোভ বাড়তেই থাকে, এবং চাপের একটা পর্যায়ে আগ্নেয়গিরিও বিস্ফোরিত হয়।
গত রাত থেকেই ঘুম আসছিল না। জানতাম এসপার, ওস্পার কিছু একটা হবেই। হয়েছেও তাই। আমার ভয় ছিল দেশ না সিরিয়ার মতন হয়ে যায়। এখানকার মসজিদে বহু সিরিয়ান রিফিউজির গল্প শুনেছি। ওদের স্থানে আমার দেশের কাউকে কল্পনাও করতে পারিনা। আল্লাহর অশেষ রহমত, শেখ হাসিনা নিজের জেদ থেকে সরে এসে পদত্যাগ করেছেন।
কিন্তু বিজয়ের আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে পাল্টে গেল যখন দেখলাম গণভবন, সংসদ ভবনে অবাধে লুটতরাজ, ভাংচুর ইত্যাদি ঘটেছে। এতটা অসভ্য বর্বর আচরণ? এগুলোতো আমাদেরই সম্পদ। আমাদেরই টাকায় কেনা, এবং আমাদেরই টাকায় আবার কিনতে হবে। লোকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আগুন দিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার বাড়িতে, প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে। বুঝতে পারছি জনতার ক্ষোভ আছে। জানি অনেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে বেদখল করেছে সম্পত্তি। কিন্তু সবকিছুরতো একটা সিস্টেম থাকে। আমার নিজেরও জমি বেদখল হয়ে আছে আওয়ামী নেতার হাতে। এর অর্থ কি এই যে আমি সেখানে গিয়ে ওর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিব?
অনেকেই বলছেন "ওরা এত কষ্ট করেছে, একটু আনন্দ করুক। একটু ভোগ করুক। কি যায় আসে?"
ঠিক এই যুক্তিটাই প্রতিটা সরকার দেয়। ক্ষমতায় এসেই ছাত্র সংগঠন, মন্ত্রী এমপিরা দেশ লুটে খায়। সরকার যুক্তি দেখায় "ওরা পরিশ্রম করেছে, একটু ভোগ করুক। সেলিব্রেট করুক।"
যে লুটেরারা এক বয়স্ক মহিলার ব্রা, পেন্টি পর্যন্ত লুটে নেয়, ওরা কোটি টাকার প্রজেক্ট পেলে কি করতো? তাহলে এত আন্দোলনের ফল কি দাঁড়ালো?
সবচেয়ে বড় কথা, সংখ্যালঘুদের উপর নাকি আক্রমন শুরু হয়েছে। কেন সেটা হবে? ওদের কেন সংখ্যালঘু হিসেবে ধরা হবে? ওরাতো বাংলাদেশী, আমার দেশে আমার যা অধিকার, ওরও তাই। আজকে ওদের উপর আমি আক্রমন করলে আমার আর ছাত্রলীগের মাঝে পার্থক্য কি থাকলো?
তরুণ যুবাদের নিয়ে আমার অনেক আশা। যারা মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে একটা স্বৈরাচারী সরকারকে মুখ থুবড়ে ভূপাতিত করতে পারে, ওরা চাইলেই সেই একই দেশকে বহুদূর সামনে নিয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র একটা বিষয় মাথায় রাখলেই হবে, ডিসিপ্লিন। আমার সামনে খাবারের থালা আছে, কিন্তু আমি রোজা রেখেছি বলে খাচ্ছি না, এইটাই ডিসিপ্লিন। আমরা যদি সেটাই ধরে রাখতে পারি, দুনিয়ার কেউ আঠারো কোটি "বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবে না।"
নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। অনেক কাজ সামনে। যাত্রা শুরু হোক!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২৪ রাত ৯:৫৬