ডাকসু নির্বাচনে শিবির জিতেছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের একদম উড়িয়ে দিয়েছে বলা চলে।
দেশের লোকজন হায়হায় করছেন। শিবিরতো জামাতেরই ছোট ভাই। ডাকসুতে জিতেছে মানে ওরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জিতবে। জামাত ক্ষমতায় চলে আসবে। যে দলটা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে, ওরাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসবে!
আওয়ামীলীগ বা বিএনপি নিজেদের অপকর্ম নিয়ে চিন্তিত না হয়ে পুরো দোষ ভোটারদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। টিপিক্যাল বাংলাদেশী/সাউথ এশিয়ান কালচার! কেন ভোটাররা ওদেরকে ভোট দিল না সেই খোঁজ নিয়েছে?
ভোটারদের সাথে কথা বলেন। বা যে শিবির করে, ওর সাথে কথা বলেন, বুঝতে পারবেন মূল সমস্যাটা কোথায়।
আমি দূরে থাকি, দেশে যাই না প্রায় অর্ধযুগ হয়ে গেছে, তবুও কিছু মানুষের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম আমি সেটাই লিখছি।
১. ১৯৭১ কত বছর আগের ঘটনা? ৫৪ বছর আগের। সেই যুগে যারা তরুণ ছিলেন, তাঁদের মোটামুটি সিংহভাগই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। যারা শিশু ছিলেন, তাঁরাই আজকের যুগে প্রৌঢ়। আমার জন্মেরও এক দেড় যুগ আগের ঘটনা। সেটাও ব্যাপার হতো না। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, আমাদের গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে বিকৃতি এমনভাবে হয়েছে যা সত্যিই দুঃখজনক। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় যখন আসে, তখন এমনভাবে ইতিহাস বিকৃতি করেছে যেন মুক্তিযুদ্ধে শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ ও এর সমর্থকদের ছাড়া আর কারোরই কোন ভূমিকা ছিল না। ওরা জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের চর বানিয়েছে। ওরা এমএজি ওসমানী, একে খন্দকার, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে সাইডে ফেলে কেবলমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামীলীগ, ক্র্যাক প্লাটুন প্রমুখদের মধ্যেই সমস্ত ক্রেডিট বিতরণ করেছে। যেন মুক্তিযুদ্ধ একান্তভাবেই আওয়ামীলীগের সম্পত্তি।
অথচ মুক্তিযুদ্ধ ছিল গোটা দেশের জনতার যুদ্ধ, গোটা বাংলাদেশ তখন এক না হলে দুনিয়ার কারোর পক্ষেই সম্ভব হতো না সশস্ত্র পাক বাহিনীর হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করতে। হ্যা, এইটা সত্য যে তখন আওয়ামীলীগই বাংলাদেশের সবচেয়ে পপুলার দল ছিল, এবং দেশের সবাই ওদেরকেই সমর্থন করতো।
কিন্তু আওয়ামীলীগ যে মহাভুলটা করেছে সেটা হচ্ছে, ৭১ পরবর্তীযুগে যারা আওয়ামীলীগ ত্যাগ করেছে, বা এমন কিছু করেছে যা ওদের বিরুদ্ধে গেছে, মুক্তিযুদ্ধে ওদের ভূমিকাকে এডিট করতে গেছে। অতীতকে কি পাল্টানো সম্ভব? বেকুবগুলির মাথায় কি ভরা থাকে?
বিএনপি এসে যেটা করে তা হচ্ছে সেই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জামাতে ইসলামীর সাথেই হাত মেলায়, তারপরে জনতাকে ওদের ভার্সন শোনায়। সেখানে শেখ মুজিবের কোনই ভূমিকা নেই। থাকলেও ৭১ পরবর্তী মুজিবকে টেনে এনে মুক্তিযুদ্ধে ওর ভূমিকাকে খাটো করা হয়।
তা এইভাবে যে যার মতন ইতিহাস সাজাতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী জেনারেশনের মন বিষিয়ে দিয়েছে। আমার বানানো কথা না, এইটা ফ্যাক্ট। খোঁজ নেন, জানতে পারবেন আমি কতটা সত্যি বলছি।
২. দেশের সবাই ইতিহাস পড়ে সুশীল, শিক্ষিত, বিচক্ষণ নাগরিক হয়ে যাবে - এই ধারণা করাটাই গর্ধবের কাজ। ইতিহাস, ধর্ম, প্রেম, ভালবাসা, শ্রদ্ধা ইত্যাদি জোর করে গেলানোরও বিষয় না। বেশিরভাগ মানুষই প্র্যাকটিক্যাল জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে। তা আমাদের "মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে" প্র্যাকটিক্যাল লাইফে কি করতে দেখেছে? বরং প্রশ্ন করা উচিত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে কি অপকর্ম করতে দেখে নাই? সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে অর্থপাচার, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডারবাজি, ক্যাসিনো, জুয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নারীসঙ্গ ভোগ, আয়নাঘর, গুম, খুন, ভোটচুরি ইত্যাদি কিছুইতো বাকি রাখে নাই। একটা দেশের সরকার তার জনগনের কাছে কতটা ঘৃণার পাত্র হলে জনতার বিদ্রোহে এর সব নেতাকর্মী দেশ ছেড়েই পালিয়েছে? যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ওদের পছন্দ করতো, ওদের পক্ষে থাকতো, তাহলেতো এই দিন দেখতে হতো না।
মূল বিষয় হচ্ছে, এই যে আওয়ামীলীগ অগাস্টে গণহত্যা করলো - একবারের জন্যও ওরা অনুশোচনা করেনি। একবারের জন্যও অনুতপ্ত হয়নি।উল্টো নিহতদের নিয়ে টিটকারি করেছে, হাসিতামাশা করেছে। কি করে আশা করে সাধারণ পাবলিক এত সহজে এত কম সময়ে সব ভুলে যাবে?
আর বিএনপি প্রথম সুযোগেই চাঁদাবাজিতে নেমে গেছে। বাস স্ট্যান্ড, টেম্পোস্ট্যান্ড, ফুটপাথ ইত্যাদি দখলে নিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। পনেরো বছর পেটে খাবার জোটেনি। খাবার সামনে পেতেই তাই হাভাইত্যার মতন ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
এদিক দিয়ে শিবিরের ইমেজটা বলি।
এই জেনারেশন শিবিরকে রগ কাটতে দেখেনি, ব্রাশফায়ার ইত্যাদি করতে দেখেনি। ওগুলো আমাদের জেনারেশনের কথা। এই জেনারেশন দেখেছে এমন একটা দল, যাদেরকে ছাত্রলীগ দমিয়ে রাখে। আবরার শিবির করতো এই অভিযোগে ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। কিন্তু মার খেয়েও ওরা সাধারণ ছাত্রদের উপকার করে। কি উপকার করে? গ্রাম থেকে কোন ছাত্র শহরে আসলে স্বাভাবিক কারণেই ওরা জানেনা কোথা থেকে ফর্ম কিনতে হবে, কোথায় জমা দিতে হবে, কিভাবে পূরণ করতে হবে। অনেকেরই থাকার সমস্যা। সে ব্যাপারেও সাহায্য করছে শিবির। খাওয়া দাওয়া, পড়াশোনা ইত্যাদিতো আছেই - একই সাথে ওরা দেখছে এই সংগঠনের সদস্যরা খুবই ধার্মিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছে। মেয়েদের দিকে চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না। লেখাপড়ায়ও সিজিপিএ অনেক উপরে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতা ও চামচারা একেকজন আদু ভাই। বছরের পর বছর যায়, বয়স বাড়ে, তবু এরা ছাত্রনেতা থেকে যায়। মদ খায়। হলে বেশ্যা আনে। ধর্ষণেও ওদের অনেক নেতাকর্মীর নাম শোনা যায়।
ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলও কিন্তু মানুষের উপকার করে। ওরা কাঙালি ভোজ করায়। একটা কাঙালকে ধরে এনে এক মুঠো ভোজের প্যাকেট চৌদ্দ পনেরোজন মিলে ধরে সেই কাঙালকে খাওয়াবার ফটো সেশন করে। ছবি ও ক্যামেরা চলে গেলে সেই ভোজ আসল কাঙ্গাল, মানে দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে চলে যায়।
শিবিরের এই যে ভলান্টিয়ার কর্মগুলি কারোর ক্যামেরায় ধরা হয়না। আজাইরা লোকদেখানো এক্টিং ওরা করছে না। কিন্তু যে ছেলে/মেয়েটার উপকার করছে, সে ঠিকই ওদের মনে ধরে রাখছে। ওরা মানুষের ব্রেনে রেকর্ডেড হয়। ওরা বুদ্ধিমান, ওরা জানে ঠিক কোথায় ইনভেস্ট করতে হয়। সেটাই ওরা করে গেছে।
এখন বলেন, এমন কোন সাধারণ ছেলে, যার মাথায় আপনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তিতা বানিয়ে ফেলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি (বিএনপি আওয়ামীলীগ দুইটাই) হয়েও ইচ্ছামতন দেশকে লুটপাট করেছেন।
আর অন্যদিকে সে দেখছে একদল ধার্মিক, ঈমানদার, লেখাপড়ায় ভাল ছেলেপিলে মার খেয়েও ওদের উপকারই করছে - সে কাকে ভোট দিবে?
আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে রাজনীতি করেছেন, অন্যদিকে ওরা ঠিক জায়গা মতন ইনভেস্ট করে বাজি জিতে নিয়েছে।
এখন ওরা ক্ষমতায়, আপনারা বসে বসে আঙ্গুল চুষেন।
ঘটনা এতটাই সহজ সরল।
ভোটারদের গালাগালি না করে বরং অতীতের নির্বাচিত নেতারা কেন নিজেদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেনি সেটা নিয়ে সমালোচনা করেন। সেটা কিভাবে সংশোধন করতে পারবে সেটা নিয়ে ভাবেন। পরের নির্বাচনে হয়তো কিছুটা হলেও উপকার হবে।
আর যদি মনে হয় আমার রিসার্চ ভুল - তাহলে কমেন্টে বলতে পারেন। আমার স্যাম্পল সাইজ খুবই ছোট ছিল। আপনারা দেশে থাকেন, আপনারা ভাল জানার কথা।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


