somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিরর ইমেজ—সায়েন্স ফিকশন গল্প

২৯ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পাইপে আগুন ধরাতে যাচ্ছিল এলিজা বেলি। এমন সময় খুলে গেল তার অফিসের দরজা। বিরক্ত হয়ে চোখ তুলে চাইল সে। পরক্ষণেই আগন্তুককে দেখে দূর হয়ে গেল সমস্ত বিরক্তি। তার জায়গা দখল করে নিল বিস্ময়।
‘আর. ড্যানিল না?’ উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠল বেলি।
‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন,’ জবাব দিল দীর্ঘদেহী ব্রোঞ্জের আগন্তুক। ভাবলেশহীন চেহারা তার। ‘না বলে এভাবে ঢুকে পড়ার জন্য দুঃখিত। কিন্তু পরিস্থিতি খুব খারাপ, তাই না এসে পারলাম না। ব্যাপারটা সম্পর্কে যত কম লোক আর রোবটকে জানানো যায়, ততই ভালো। তবে ব্যাপার যা-ই হোক, আপনার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ায় খুব ভালো লাগছে, বন্ধু এলিজা। ’
ডান হাত বাড়িয়ে ধরল রোবটটা করমর্দনের জন্য। বিমূঢ় ভঙ্গিতে তার সঙ্গে হাত মেলাল এলিজা। ‘কী যে বলো না ড্যানিল! আমার দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা। কিন্তু হঠাৎ এমন কী ঘটল যে পরিস্থিতি এত খারাপ হয়ে উঠেছে? নতুন কোনো সমস্যা? মানে, পৃথিবীর কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘না, বন্ধু, পৃথিবীর কোনো সমস্যা না। ঘটনাটা পৃথিবীর বাইরের। ব্যাপার অবশ্য খুব ছোট। ম্যাথমেটিশিয়ানদের মধ্যে একটু ঠোকাঠুকি লেগেছে, আর কিছু না। যাচ্ছিলাম পৃথিবীর খুব কাছ দিয়েই। তাই...’
‘ঝগড়াটা তাহলে কোনো স্টারশিপে হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। সমস্যাটা ছোট্ট, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মানুষ ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েছে। ’
বেলি হেসে বলল, ‘মানুষকে তোমার কাছে বিস্ময়কর মনে হবেই। কারণ ওরা তোমাদের জন্য বেঁধে দেওয়া নিয়ম তিনটে মেনে চলে না। ’
‘ওটাই তো আপনাদের সমস্যা,’ গম্ভীর গলায় বলল ড্যানিল। ‘আমার তো মনে হয় মানুষই মানুষকে ধাঁধায় ফেলে দেয়। তবে বাইরের জগতের চেয়ে পৃথিবীতে যেহেতু মানুষের সংখ্যা বেশি, তাই তারা এ রকম বিভ্রান্তিতে কম পড়ে। সে ক্ষেত্রে পৃথিবীর মানুষ হিসেবে আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন। যাকগে, মানুষের রীতিনীতি যদ্দূর শিখেছি, তাতে এখন আপনার বউ-বাচ্চার খবর না নিলে অভদ্রতা হয়ে যাবে। ’
‘ভালোই আছে ওরা। ছেলেটা কলেজে পড়ে। জেসি এখানকার রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে। এখন বলো, তুমি এখানে এলে কী করে?’
‘পৃথিবীর খুব কাছ দিয়েই যাচ্ছিলাম। তাই ক্যাপ্টেনকে বললাম, সমস্যাটার ব্যাপারে আপনার পরামর্শ নেওয়া যায়। ’
‘ক্যাপ্টেন রাজি হয়ে গেলেন?’ বেলি মানসচোখে দেখতে পেল একজন গর্বিত স্বৈরাচার ক্যাপ্টেন মহাশূন্য থেকে স্টারশিপ নিয়ে এসেছে তার মতো একজন পৃথিবীর মানুষের পরামর্শ নিতে।
‘এই মুহূর্তে তাঁর যা মানসিক অবস্থা, তাতে যেকোনো প্রস্তাবেই রাজি হয়ে যেতেন। তার ওপর আপনার প্রশংসা শুনেও প্রভাবিত হয়েছেন। শেষে রফা হলো, এখানে আলাপ-আলোচনা সব আমিই চালাব। তাই স্টারশিপের কোনো ক্রু বা যাত্রীদের পৃথিবীতে পা রাখার দরকার পড়বে না। ’
‘এবং পৃথিবীর কোনো মানুষের সঙ্গে কথাও বলতে হবে না। কিন্তু হয়েছেটা কী?’
‘আমাদের স্টারশিপ “এটা কারিনা”য় দুজন গণিতবিদ আছেন। তাঁরা যাচ্ছেন অরোরায়, আন্তনাক্ষত্রিক সম্মেলনে যোগ দিতে। সম্মেলনটা হবে নিউরোবায়োফিজিকসের ওপর। ঝগড়াটা বেধেছে দুই গণিতবিদের মধ্যে। একজনের নাম আলফ্রেড ব্যান হাম্বল্ড, আরেকজনের নাম জেনাও স্যাবাট। ’
‘ড্যানিল, আমি কিন্তু অঙ্কের অ-ও জানি না,’ নাক কুঁচকে বলল বেলি। ‘তুমি নিশ্চয়ই বলে বসোনি যে আমি অঙ্কের জাহাজ, কিংবা...’
‘আরে না, বন্ধু এলিজা, ও রকম কিছু বলিনি,’ তাকে আশ্বস্ত করল ড্যানিল। ‘তবে অঙ্ক না জানলেও কোনো অসুবিধে নেই। কারণ সমস্যাটার সঙ্গে অঙ্কের কোনো সম্পর্ক নেই। ’
‘বেশ, এরপর কী হলো বলো। ’
‘প্রথমে ভদ্রলোক দুজনের সম্পর্কে একটু জানিয়ে রাখি। ড. হাম্বল্ডের বয়েস ২৭০ বছর। এখনো কাজেকর্মে খুব চটপটে। গ্যালাক্সির সেরা তিন গণিতবিদদের একজন তিনি। অন্যদিকে স্যাবাট এখনো নিতান্তই তরুণ। বয়স এখনো ৫০ হয়নি। তবে এরই মধ্যে অঙ্কের জটিল শাখাগুলোতে নবীন প্রতিভা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। ’
‘দুজনেই তো বড় মানুষ,’ মন্তব্য করল বেলি। ‘তা হয়েছে কী? খুন? এঁদের একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলেননি তো?’
‘সম্মানিত এই মানুষ দুজনের মধ্যে একজন আরেকজন ধ্বংস করে দিতে চাইছেন। মানবিক মূল্যবোধের দিক থেকে বিবেচনা করলে ব্যাপারটা আমার কাছে শারীরিকভাবে খুনের চেয়েও খারাপ। ’
‘মাঝেমধ্যে আমার তা-ই মনে হয়। তা কে কাকে ধ্বংস করতে চাইছেন?’
‘বন্ধু এলিজা, সেটাই আসল সমস্যা। কে?’
‘ড. হাম্বল্ড ঘটনাটা পরিষ্কার করে বলেছেন। স্টারশিপে ওঠার খানিক আগে দুর্দান্ত এক আইডিয়া আসে তাঁর মাথায়। সেরেব্রামের বাইরের স্তর, অর্থাৎ লোকাল কর্টিক্যাল এরিয়ায় মাইক্রোওয়েভ শোষণের প্যাটার্নগুলোর পরিবর্তনের মধ্য থেকে স্নায়বিক পথগুলো বিশ্লেষণের সম্ভাব্য একটা পদ্ধতি বের করে ফেলেন তিনি। আইডিয়াটি অসাধারণ এক গাণিতিক কৌশল। কৌশলটি আমাকে বিস্তারিত বলেছিলেন উনি, কিন্তু কিছু বুঝতে পারিনি। তবে সেটা না বুঝলেও চলবে। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রীতিমতো রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলেন ড. হাম্বল্ড। তাঁর বিশ্বাস, গণিতের জগতে বিপ্লব এনে দেবে এ আইডিয়া। এমন সময় ড. স্যাবাটকে শিপে উঠতে দেখলেন তিনি। ’
‘এবং ব্যাপারটা নিয়ে তরুণ স্যাবাটের সঙ্গে আলোচনা করলেন?’ জিজ্ঞেস করল বেলি।
‘ঠিক ধরেছেন। পেশাগত কারণে এর আগে বিভিন্ন মিটিংয়ে দেখা হয়েছে দুজনের। নিজের আইডিয়াটা নিয়ে স্যাবাটের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন হাম্বল্ড। তাঁর আবিষ্কারের ভূয়সী প্রশংসা করেন স্যাবাট। তাঁর প্রশংসায় উৎসাহ পেয়ে ধারণাটার ওপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে ফেলেন হাম্বল্ড। দুদিন পর সাব-ইথারের মাধ্যমে বিষয়টা অরোরা কনফারেন্সের কো-চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানোর জন্যে খসড়াও তৈরি করে ফেলেন। ধারণাটা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইলে সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই সম্ভাব্য আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখেন, স্যাবাটও ঠিক সেই বিষয় সাব-ইথারের মাধ্যমে অরোরায় পাঠানোর জন্য তৈরি হচ্ছেন। ’
‘হাম্বল্ড নিশ্চয়ই ভীষণ খেপে গিয়েছিলেন?’
‘সে আর বলতে!’
‘আর স্যাবাট? উনি কী বলছেন?’
‘হাম্বল্ড যা বলেছেন, উনি হুবহু তা-ই বলছেন। একটা অক্ষরও এদিক-ওদিক নেই। যেন আয়নায় একজন আরেকজনের প্রতিবিম্ব তাঁরা। স্যাবাটের ভাষ্যমতে, আইডিয়াটা আসলে তাঁর মাথায়ই প্রথম আসে। তিনিই নাকি ব্যাপারটা নিয়ে হাম্বল্ডের সঙ্গে আলাপ করেন, তাঁর মতামত নেন। হাম্বল্ড তাঁর বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত হন এবং তারিফ করেন। ’
‘তার মানে, এঁরা একজন আরেকজনে চোর বলে অভিযুক্ত করছেন। তবে সমস্যাটা তেমন গুরুতর মনে হচ্ছে না। দুজনের গবেষণার কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে তারিখ-টারিখ দেখলেই বোঝা যাবে, কে সত্যি বলছেন, কে মিথ্যে,’ বলল বেলি।
‘সাধারণ সমস্যা হলে তা-ই করা যেত, বন্ধু এলিজা,’ বলল ড্যানিল। কিন্তু এই কেসের ব্যাপারটা আলাদা ড. হাম্বল্ড বলছেন, বিষয়টা নিয়ে হিসাব-কিতাব সব নিজের মাথার মধ্যে করেছেন। অরোরা কনফারেন্সে বিস্তারিত জানানোর জন্যে কাগজ তৈরির আগপর্যন্ত কিছুই লিখে রাখেননি। ড. স্যাবাটও তা-ই বলছেন।
‘তাহলে দুজনের মনস্তত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখো কে মিথ্যে বলেছেন। ’
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল আর. ড্যানিল। ‘মানুষ দুজনকে এখনো ঠিক চিনতে পারেননি আপনি। দুজনেই অত্যন্ত নামী এবং উচ্চপর্যায়ের লোক। তা ছাড়া তাঁরা ইম্পেরিয়াল একাডেমির ফেলো। তাই প্রচলিত আইনের ধারায় তাঁদের বিচার সম্ভব নয়। হয় তাঁদের সমপর্যায়ের গণিতবিদদের নিয়ে জুরি গঠন করে বিচার করতে হবে, নয়তো তাঁদের একজনকে স্বেচ্ছায় আইডিয়াটার ওপর থেকে নিজের দাবি ছাড়তে হবে। ’
‘তাহলে তো প্রকৃত দোষী কখনো দাবি ছাড়বেন না। কারণ, তাঁকে তো মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে না। আর যিনি নির্দোষ, তিনি ঝামেলা এড়াতে অনায়াসে দাবি ছেড়ে দেবেন। সহজ ব্যাপার। ’
‘তাতেও কাজে হবে না, বন্ধু এলিজা। অমন স্বত্বত্যাগের বেলায় ব্যাপারটা তদন্ত করানো হয় পেশার বাইরের লোক দিয়ে। ব্যাপারটা তাঁদের মতো নামী গণিতবিদের জন্য বিরাট আঘাত হয়ে যাবে। দুই পণ্ডিতই বিশেষ বিচারের সামনে গিয়ে দাবি ছাড়ার ব্যাপারে তুমুল আপত্তি জানিয়েছেন। ’
‘তাহলে অরোরা পৌঁছা অব্দি ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না। একদম চুপ থাকো। কনফারেন্সে তাঁদের সমপর্যায়ের অনেক গণিতজ্ঞের দেখা পাবেন তাঁরা। তখন...’
‘তখন তো বিজ্ঞানের জগতে ওলটপালট হয়ে যাবে, বন্ধু এলিজা। ভয়াবহ কেলেঙ্কারিতে পড়ে যাবেন দুজনেই। নির্দোষ ব্যক্তিও রেহাই পাবেন না নিন্দা থেকে। ব্যাপারটা যেভাবেই হোক আদালতের বাইরে চুপচাপ সুরাহা করতে হবে। ’
‘বেশ। আমি মহাকাশচারী নই, তবে দেখি দুই ভদ্রলোকের আচরণের কূল-কিনারা করতে পারি কি না। তা মানুষ দুজন কী বলছেন?’
‘হাম্বল্ড বলেছেন, স্যাবাট চুরির দায় স্বীকার করে তাঁকে আইডিয়াটার কাগজপত্র কনফারেন্সে জমা দিতে দিলে তিনি কোনো অভিযোগ আনবেন না। ব্যাপারটা কাউকে জানাবেনও না। ’
‘কিন্তু স্যাবাট রাজি হচ্ছেন না, তা-ই তো?’
‘উনিও একই কথা বলছেন। কেবল নিজের জায়গায় হাম্বল্ডের নাম বসিয়ে দিচ্ছেন। একদম মিরর ইমেজ। ’
‘তার মানে দুজনে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন?’
‘আমার ধারণা, তাঁরা একে অপরের দোষ স্বীকারের অপেক্ষায় বসে রয়েছেন। ’
‘বেশ তো, তা-ই করুন না। অসুবিধে কী?’
‘ক্যাপ্টেন তা চাইছেন না। এতে দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। এক, এভাবে গ্যাঁট মেরে বসে থাকলে স্টারশিপ অরোরায় ল্যান্ড করামাত্রই দুজনের এই কীর্তির কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এ ঝগড়া মেটাতে না পারার জন্যে দুর্নাম ছড়াবে ক্যাপ্টেনেরও। দুই, একসময় যেকোনো একজন দোষ স্বীকার করতে পারেন; কিন্তু তাই বলে তিনিই যে আসল অপরাধী, ব্যাপারটা তা না-ও হতে পারে। কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচতে এই উদারতা দেখাতে পারেন আইডিয়ার প্রকৃত উদ্ভাবক। সে ক্ষেত্রে তাঁকে এই বিরাট কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করা মোটেও উচিত কাজ হবে না। আর প্রকৃত দোষী যদি শেষ পর্যন্ত এমন ভান ধরে দোষটা স্বীকার করেন, যেন বিজ্ঞানের কল্যাণেই নির্দোষ হয়েও দায়টা নিজের ঘাড়ে তুলে নিচ্ছেন, তাহলে নিজের অপকর্মের দায় থেকে তিনি মুক্তি পেয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত স্টারশিপে কেবল ক্যাপ্টেনই দুই গণিতবিদের ঝগড়া সম্পর্কে জানেন। এমন একটা সমস্যায় ন্যায়বিচার প্রদানের ব্যর্থতার দায় বয়ে বেড়াতে চান না তিনি বাকি জীবন। ’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল বেলি। ‘অরোরা যত কাছে আসবে, উত্তেজনাও তত বাড়বে। কে আগে ভাঙবে? এ-ই তাহলে পুরো ঘটনা, ড্যানিল?’
‘আরেকটু আছে। সাক্ষীদের কথা বলা হয়নি। ’
‘বাপ রে! সাক্ষী আবার কে?’
‘ড. হাম্বল্ডের ব্যক্তিগত চাকর। ’
‘নিশ্চয়ই একটা রোবট?’
‘হ্যাঁ। তার নাম আর. প্রেস্টন। দুই গণিতবিদের আলোচনার পুরোটা সময় সে উপস্থিত ছিল। ড. হাম্বল্ডের প্রতিটা তথ্য সে জানে। ’
‘তার মানে, প্রেস্টনের ভাষ্যমতে, ড. হাম্বল্ডই তাঁর আইডিয়া শোনান ড. স্যাবাটকে। ’
‘হ্যাঁ। ’
‘কিন্তু এতে তো সব সমস্যার সমাধান হলো না। ’
‘ঠিক। এতে সমস্যার সমাধান হবে না। কেননা আরও একজন সাক্ষী আছে। ড. স্যাবাটেরও ব্যক্তিগত চাকর আছে, নাম আর. ইডা। ঘটনাচক্রে সে আর প্রেস্টন একই মডেলের রোবট। এবং আমার বিশ্বাস, একই বছর একই কারখানায় তৈরি হয়েছে ওরা। কাজে যোগও দিয়েছে একই সময়ে। ’
‘অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার তো!’
‘এই দুই চাকরের কথার ওপর ভরসা করে নিরেট সিদ্ধান্তে যাওয়া মুশকিল। দুজনের বর্ণনার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বের করাও অত্যন্ত দুরূহ। সে-ও নাম পাল্টে একই গল্প বলছে। ’
‘দুই রোবটের একজন তাহলে মিথ্যা বলছে,’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল বেলি।
‘তা-ই তো মনে হচ্ছে। ’
‘এদের মধ্যে কে মিথ্যা বলছে, তা তো অনায়াসে বের করে ফেলা উচিত। ভালো একজন রোবট বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করালেই তো...’
‘এই কেসে স্রেফ একজন রোবট বিশেষজ্ঞ দিয়ে চলবে না, বন্ধু এলিজা। কেবল একজন যোগ্য রোবোসাইকোলজিস্টই পারবে এ কেস সামলাতে। আমাদের শিপে তেমন দক্ষ রোবোসাইকোলজিস্ট একজনও নেই। তাই এ পরীক্ষা করা সম্ভব কেবল অরোরায় পৌঁছার পরই। ’
‘ওখানে পৌঁছালেই তো সব গোলমাল হয়ে যাবে। ঠিক আছে, একজন রোবোসাইকোলজিস্টের ব্যবস্থা করব আমরা। আর খবরটা কখনো বাইরে ছড়াবে না। ’
‘কিন্তু ড. হাম্বল্ড বা ড. স্যাবাট কেউই তাঁদের চাকরকে পৃথিবীর কোনো রোবোসাইকোলজিস্টের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ছেড়ে দিতে রাজি নন। ’
এলিজা বেলি দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘রোবট দুটোকে রোবোসাইকোলজিস্টের সংস্পর্শে আসতে তো হবেই। ’
‘ওরা তাঁদের অনেক দিনের পুরোনো চাকর। ’
‘এবং পৃথিবীর মানুষের সংস্পর্শে এলে অচ্ছুত হয়ে যাবে। তাহলে আর আমি কী করব বলো?’ গম্ভীর গলায় বলল বেলি। ‘দুঃখিত, আর. ড্যানিল, এ ব্যাপারে আর জড়াতে চাই না আমি। ’
‘আমি স্টারশিপে যাচ্ছিলাম অন্য এক মিশন নিয়ে। মাঝখানে এই ঝামেলায় ফেঁসে গেলাম। ক্যাপ্টেন নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আমার কাছে সাহায্য চেয়েছেন। পৃথিবীর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম বলে এখানেই নেমে পড়লাম। বন্ধু, এই জটিল কেসটার সুরাহা করতে পারলে হু-হু ওপরে উঠে যাবে আপনার ক্যারিয়ার। পৃথিবীও উপকৃত হবে। ব্যাপারটা বাইরের লোকজন না জানলেও ক্যাপ্টেন কিন্তু তাঁর জগতে খুব প্রভাবশালী মানুষ। সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন উনি। ’
‘তুমি তো আমাকে চাপে ফেলে দিয়েছ। ’
‘আমার বিশ্বাস,’ জোর দিয়ে বলল আর. ড্যানিল। ‘আপনি ইতিমধ্যে একটা না একটা বুদ্ধি বের করে ফেলেছেন। ’
‘তা-ই নাকি? আমার মনে হয়, দুই গণিতবিদের ইন্টারভিউ নেওয়া ছাড়া চোর ধরার উপায় নেই। ’
‘কিন্তু ওঁরা কেউ বোধ হয় এখানে আসতে চাইবেন না, কিংবা আপনাকেও তাঁদের কাছে যেতে দেবেন না। ’
‘হ্যাঁ, তা আমি জানি, ড্যানিল। ভাবছি ইন্টারভিউটা ক্লোজড-সার্কিট টেলিভিশনের মাধ্যমে নেব কি না। ’
‘তা-ও সম্ভব নয়। কোনো পৃথিবীবাসীর জেরা সহ্য করবেন না তাঁরা। ’
‘তাহলে আর কী করতে পারি? রোবট দুটোর সঙ্গে কথা বলব। ’
‘ওদেরকে এখানে আসতে দেওয়া হবে না। ’
‘তাহলে আমার কাছে এসেছ কেন? তুমি নিজেই যাও,’ রাগী গলায় বলে উঠল বেলি।
‘রাগ করবেন না, বন্ধু এলিজা। দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন। ’
‘রোবট দুটোর সঙ্গে অন্তত টেলিভিশনের মাধ্যমে কথা বলা যাবে তো?’ সুর নরম করে বলল বেলি।
‘হ্যাঁ, সে ব্যবস্থা করা যাবে বোধ হয়। ’
‘যাক, কিছু একটা ব্যবস্থা অন্তত করা গেল। আমি তাহলে রোবোসাইকোলজিস্টের কাজ করছি। ’
‘কিন্তু আপনি তো গোয়েন্দা, বন্ধু এলিজা, রোবোসাইকোলজিস্ট নন। ’
‘ও কথা বাদ দাও। ওদের সঙ্গে কথা বলার আগে একটু ভেবে নিই। আচ্ছা, বলো তো, দুটো রোবটের পক্ষেই কি সত্যি কথা বলা সম্ভব? দুই গণিতবিদের কথাবার্তা হয়তো বিভ্রান্তিকর ছিল। হয়তো তাঁদের দুজনের বক্তব্যের ধাঁচটাই এমন ছিল যে দুটো রোবটই যার যার মনিবের কথা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। কিংবা এক রোবট আলাপের নির্দিষ্ট একটা অংশ সম্পর্কে জানে, দ্বিতীয় রোবট জানে পরের অংশ সম্পর্কে। ফলে দুজনেই যার যার মালিককে আইডিয়াটার উদ্ভাবক বলে ভাবছে। ’
‘সেটা সম্ভব নয়, বন্ধু এলিজা। দুটো রোবটের বক্তব্যই ছিল হুবহু এক। আর দুটো বর্ণনার শুরুতেই খানিকটা অসংগতির আভাস ছিল। ’
‘তাহলে দুই রোবটের যেকোনো একটি যে মিথ্যে বলেছে, তা নিশ্চিত?’
‘হ্যাঁ। ’
‘আচ্ছা, দুই গণিতবিদের যেসব কাগজপত্র ক্যাপ্টেনের কাছে জমা আছে, দরকারে সেসব দেখতে পারব তো আমি?’
‘পারবেন। আমার কাছেই আছে ওগুলো। ’
‘আরেকটা প্রশ্ন। রোবট দুটোকে কি জেরা করা হয়েছিল? করা হয়ে থাকলে তার কোনো কাগজপত্র আছে?’
‘রোবটগুলো স্রেফ নিজেদের বক্তব্য বলেছে। জেরা করতে পারেন শুধু রোবোসাইকোলজিস্টরা। ’
‘কিংবা আমি?’
‘আপনি তো গোয়েন্দা, বন্ধু এলিজা, রোবোসাইকোলজিস্ট নন...’
‘ঠিক আছে, আর. ড্যানিল। আমি স্পেসার সাইকোলজিটা সোজাসাপ্টা বোঝার চেষ্টা করব। একজন গোয়েন্দা তা করতে পারবে, কারণ সে রোবোসাইকোলজিস্ট নয়। আরেকটু ভাবা যাক। সাধারণত রোবট কখনো মিথ্যা বলে না। অবশ্য রোবটিকসের তিন সূত্র রক্ষার প্রয়োজন পড়লে বলে। তৃতীয় সূত্র অনুসারে, নিজের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে মিথ্যা বলতে পারে সে। দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে, কোনো মানুষের আদেশ পালন করতে গিয়ে মিথ্যা বলার সম্ভাবনা আরও বেশি। কোনো মানুষের প্রাণ বাঁচাতে গিয়েও মিথ্যা বলতে পারে রোবট। কিংবা কোনো মানুষের ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রথম সূত্র অনুযায়ী মিথ্যা বলতে পারে সে। ’
‘হ্যাঁ। ’
‘আর এই কেসের ক্ষেত্রে, দুটো রোবটই নিজের মনিবের সুনাম রক্ষার জন্য প্রাণপণে লড়ছে। এ কাজ করতে গিয়ে দরকার হলে মিথ্যাও বলবে। প্রথম সূত্র রক্ষার জন্য মিথ্যা বলা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য। ’
‘কিন্তু মিথ্যা বলে তো দুটো রোবটই অপরজনের মনিবের পেশাগত সুনামের হানি করছে, বন্ধু এলিজা। ’
‘তা করছে বটে। কিন্তু প্রতিটা রোবটেরই তার নিজের মনিবের পেশাগত সম্মানের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে। সবকিছু বিবেচনা করে যখন দেখেছে, সত্যি বলার চেয়ে মিথ্যা বললে তার মনিবের তুলনামূলক কম ক্ষতি হবে, তখনই মিথ্যা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ’ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল এলিজা বেলি। তারপর বলল, ‘তাহলে দুই রোবটের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করো। আর. ইডার সঙ্গেই না হয় প্রথম কথা বলি। ’
সঙ্গে করে নিয়ে আসা প্রজেক্টর, মাইক্রো-রিসিভার বসানোর কাজে লেগে গেল আর. ড্যানিল। এই ফাঁকে দুই ডাক্তারের আইডিয়ার কাগজপত্রের ওপর চোখ বোলাতে লাগল এলিজা বেলি।
খানিক বাদে আর. ইডার ছবি ফুটে উঠল দেয়ালের দ্বিমাত্রিক প্রজেকশনে। ইডার ধাতব শরীরটা লম্বা, বিশেষত্বহীন গঠন।
কুশল বিনিময়ের পর বেলি বলল, ‘তুমি তো জেনাও স্যাবাটের ব্যক্তিগত চাকর, তা–ই না?’
‘হ্যাঁ, স্যার। ’
‘কত দিন ধরে আছ তার সঙ্গে?’
‘২২ বছর, স্যার। ’
‘মনিবের সুনাম নিশ্চয়ই তোমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান?’
‘জি, স্যার। ’
‘মনিবের সুনাম রক্ষার ব্যাপারটা কি তোমার কাছে তাঁর প্রাণ বাঁচানোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ?’
‘না, স্যার। ’
‘তাহলে নিশ্চয়ই মনিবের সুনাম রক্ষার ব্যাপারটা অন্যের সুনামের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তোমার কাছে। ’
ইতস্তত করতে লাগল আর. ইডা। এই স্পেসার রোবটগুলো পৃথিবীর রোবটদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান এবং চটপটে।
বেলি বলল, ‘ধরো, তোমার মনে হলো, মনিবের সুনামের ব্যাপারটা অন্য যে কারও সুনামের চেয়ে জরুরি। ধরো, আলফ্রেড হাম্বল্ডের চেয়েই জরুরি তোমার কাছে। তাহলে কি মনিবের সুনাম রক্ষার জন্য তুমি মিথ্যা বলবে?’
‘হ্যাঁ, স্যার, বলব। ’
‘হাম্বল্ডের সঙ্গে তোমার মনিবের এখন যে বিরোধ চলছে, সে ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে কি কোনো মিথ্যা বলেছ তুমি?’
‘না, স্যার। ’
‘কিন্তু যদি মিথ্যা বলে থাকো, তাহলে সেটাকে ঢাকার জন্য মিথ্যা বলার ব্যাপারটা অস্বীকার করবে, তা–ই না?’
‘হ্যাঁ, স্যার। ’
‘বেশ, তাহলে আরেকটা ব্যাপার বিবেচনা করা যাক,’ বলল বেলি। ‘তোমার মনিব, জেনাও স্যাবাট তো বিরাট গণিতবিদ। কিন্তু বয়স একেবারেই কম। তিনি যদি খ্যাতির মোহে পড়ে অনৈতিক কাজটা করে থাকেন, তাহলে একদিন তা জানাজানি হবেই। তবে তাঁর বয়স যেহেতু কম, তাই এ দুর্নামের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার সময় পাবেন। সময়ের চক্রে মানুষ তাঁর এই অল্প বয়সের ভুলের কথা ভুলে যাবে। ভবিষ্যৎটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে এখনো তার সামনে।
‘অন্যদিকে ড. হাম্বল্ড যদি লোভে পড়ে অমন অপরাধ করে বসেন, সেটা তাঁর জন্য আরও গুরুতর বিপদ হয়ে দেখা দেবে। ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে নিজের নাম-যশ বজায় রেখে কাজ করছেন তিনি। দীর্ঘ এ সময়ে একফোঁটা কলঙ্কও তাঁকে ছুঁতে পারেনি। এখন যদি এমন কেলেঙ্কারি করে বসেন, তাহলে নিমেষে ধসে যাবে তাঁর সব সুনাম। এ ধাক্কা কাটানোর সুযোগও পাবেন না বয়সের কারণে। অতএব, দেখা যাচ্ছে, কাজটা যে-ই করে থাকুন না কেন, তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন ড. স্যাবাট। ব্যাপারটা বিশেষভাবে ভেবে দেখা উচিত। কী বলো তুমি?’
অনেকক্ষণ চুপ করে রইল আর. ইডা। তারপর ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, ‘আমার সাক্ষ্যটা মিথ্যা ছিল। আসলে আইডিয়াটা ড. হাম্বল্ডের। আমার মনিব অনৈতিকভাবে পুরো কৃতিত্ব হজম করার চেষ্টা করেছেন। ’
বেলি বলল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ। শিপের ক্যাপ্টেনের অনুমতি ছাড়া এ ব্যাপারে কারও সঙ্গে একটা কথাও বলবে না, কেমন? এবার তুমি যেতে পারো। ’
আর. ইডার ছবি মুছে গেল পর্দা থেকে। বেলি বলল, ‘ক্যাপ্টেন ওর কথা শুনেছেন, ড্যানিল?’
‘নিশ্চয়ই শুনেছেন। আমরা দুজন ছাড়া একমাত্র উনিই এ ঘটনার সাক্ষী। ’
‘ভালো। এবার অন্যজনকে ডাকো। ’
‘কিন্তু আর. ইডা তো দোষ স্বীকার করলই। তাহলে অন্যজনকে কি ডাকার দরকার আছে?’
‘আলবত আছে। আর. ইডার স্বীকারোক্তির আসলে কোনো মানে নেই। ’
‘মানে নেই?’
‘নাহ। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি। দুজনের তুলনামূলকভাবে বেকায়দায় আছেন ড. হাম্বল্ড। আর. ইডা যদি ড. স্যাবাটকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলে, তাহলে সে সত্যের অপলাপ করেছে। সত্যি বলতে কী, ইতিমধ্যে সে তা করেছে বলে দাবিও করেছে। অপরদিকে সত্যি বললে, ড. হাম্বল্ডকে বাঁচানোর জন্য ফের মিথ্যা বলে থাকতে পারে। এখানেও সেই আয়নার প্রতিবিম্বের ব্যাপার। ’
‘কিন্তু তাহলে আর. প্রেস্টনকে জেরা করেই–বা কী লাভ?’
‘মিরর ইমেজটা নিখুঁত হয়ে থাকলে কোনো লাভই নেই। তবে এ ক্ষেত্রে তা হওয়ার কথা না। এই রোবট দুটোর একজন প্রথমে সত্যি কথা বলছে, অন্যজন বলছে মিথ্যে। অতএব, একজনের কথায় অসামঞ্জস্যতা পাওয়া যাবেই। যাক, এবার আর. প্রেস্টনের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করো। আর. ইডার ইন্টারভিউয়ের ট্রান্সক্রিপশন যদি হয়ে থাকে, কাগজগুলো দাও আমাকে। ’
আবার চালু হলো প্রজেক্টর। পর্দায় ভেসে উঠল আর. প্রেস্টনের চেহারা। বুকের ডিজাইনের সামান্য কটা পার্থক্য ছাড়া দেখতে অবিকল আর. ইডার মতো।
আর. ইডার ইন্টারভিউয়ের রেকর্ড সামনে রেখে কথা শুরু করল বেলি।
‘তুমি তো আলফ্রেড ব্যান হাম্বল্ডের খাস চাকর, তা–ই না?’
‘জি, স্যার,’ হুবহু আর. ইডার মতো কণ্ঠস্বরে জবাব দিল আর. প্রেস্টন।
‘কত দিন ধরে চাকরি করছ?’
‘২২ বছর, স্যার। ’
‘তোমার মনিবের সম্মান নিশ্চয়ই তোমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। ’
‘হ্যাঁ, স্যার। ’
‘তোমার কাছে মনিবের সম্মান রক্ষার ব্যাপারটা কি তাঁর প্রাণ বাঁচানোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ?’
‘না, স্যার। ’
‘তাহলে মনিবের সুনাম রক্ষার ব্যাপারটা অন্যের সুনামের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তোমার কাছে?’
ইতস্তত করতে লাগল আর. প্রেস্টন। তারপর বলল, ‘এ ধরনের কেসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটা যার যার মেধার ওপর নির্ভর করে, স্যার। সাধারণ কোনো নিয়ম প্রতিষ্ঠার উপায় নেই। ’
বেলি বলল, ‘ধরো, তোমার মনে হলো, মনিবের সুনামের ব্যাপারটা অন্য যে কারও সুনামের চেয়ে জরুরি। ধরো, জেনাও স্যাবাটের চেয়েই জরুরি তোমার কাছে। তাহলে কি মনিবের সুনাম রক্ষার জন্য তুমি মিথ্যা বলবে?’
‘হ্যাঁ, স্যার, বলব। ’
‘স্যাবাটের সঙ্গে তোমার মনিবের এখন যে বিরোধ চলছে, সে ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে কি কোনো মিথ্যে বলেছ তুমি?’
‘না, স্যার। ’
‘কিন্তু যদি বলে যদি থাকো, তাহলে সেটাকে ঢাকার জন্য মিথ্যা বলার ব্যাপারটা অস্বীকার করবে, তা–ই না?’
‘হ্যাঁ, স্যার। ’
‘বেশ, তাহলে আরেকটা ব্যাপার বিবেচনা করা যাক,’ বলল বেলি। ‘তোমার মনিব, আলফ্রেড হাম্বল্ড তো বিরাট গণিতবিদ। কিন্তু বয়সে অত্যন্ত প্রবীণ। তিনি যদি খ্যাতির মোহে পড়ে অনৈতিক কাজটা করে থাকেন, তাহলে একদিন তা জানাজানি হবেই। কিন্তু এ দুর্নামের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই না। দীর্ঘদিন ধরে সুপ্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তির সামনে সামান্য এই কলঙ্কের দাগ পাত্তাই পাবে না। লোকেও কাজটাকে বুড়ো বয়সের ভীমরতি ভেবে দুদিন পর সব ভুলে যাবে। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো।
‘অন্যদিকে ড. স্যাবাট যদি লোভে পড়ে অমন অপরাধ করে বসেন, সেটা তাঁর জন্য আরও গুরুতর বিপদ হয়ে দেখা দেবে। বয়স তাঁর কম, খ্যাতিও তুলনামূলক কম। তেমন খ্যাতি কুড়াতে হলে আরও কয়েক শতাব্দী পাড়ি দিতে হবে তাঁকে। কাজেই এখন যদি এমন একটা কেলেঙ্কারি করে বসেন, সেটা তাঁকে মূল লক্ষ্য থেকে ছিটকে দিতে পারে। তোমার মনিবের চেয়ে ড. স্যাবাটের ভবিষ্যতের পথটা যেহেতু অনেক দীর্ঘ, তাই ভুল শুধরে আগের অবস্থানে ফিরে আসতেও খুব কষ্ট হবে তাঁর। ব্যাপারটা বিশেষভাবে ভেবে দেখা উচিত। কী বলো তুমি?’
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল আর. প্রেস্টন। তারপর বলল, ‘আমার সাক্ষ্যটা...’
এ পর্যন্ত বলে চুপ মেরে গেল সে।
‘প্লিজ, কথা শেষ করো, আর. প্রেস্টন,’ তাগাদা দিল বেলি।
কিন্তু কোনো জবাব নেই।
আর. ড্যানিল বলল, ‘আর. প্রেস্টন বোধ হয় বিকল হয়ে গেছে, বন্ধু এলিজা। ’
‘শেষমেশ একটা অসামঞ্জস্য ধরতে পারলাম,’ হাঁফ ছেড়ে বলল বেলি। ‘এ থেকেই আসল অপরাধী ধরতে পারব। ’
‘কীভাবে, বন্ধু এলিজা?’
‘একটু ভাবো। ধরো, তুমি একজন নির্দোষ ব্যক্তি। তোমার সাক্ষী হিসেবে আছে তোমার ব্যক্তিগত রোবট। সে ক্ষেত্রে তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমাকে কোনো কষ্টও করতে হবে না। রোবটই সাক্ষ্য দেবে তোমার হয়ে। কিন্তু তুমি যদি আসলেই অপরাধ করে থাকো, তাহলে রোবটের মিথ্যা সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করবে তোমার জীবন। অমন পরিস্থিতি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, দরকার পড়লে রোবটটা হয়তো বলবে, এমন ভরসা থাকলেও সত্য বলার ঝুঁকিটা থেকেই যায়। ঝুঁকিটা এড়ানোর জন্যে দোষী ব্যক্তি রোবটটাকে মিথ্যা বলার আদেশ দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোবটিকসের দ্বিতীয় সূত্রের মাধ্যমে প্রথম সূত্রটি জোরালো হয়ে উঠবে। ’
‘হ্যাঁ, আপনার কথায় যুক্তি আছে,’ সায় দিল আর. ড্যানিল।
‘ধরো, আমাদের কাছে দুই ধরনের রোবটই আছে একটা করে,’ বলল বেলি। ‘একটাকে সত্য বলা থেকে বিরত করে মিথ্যে বলতে বলা হলো। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে, কোনো সমস্যা ছাড়াই, মিথ্যা বলল সে। অপর রোবটটাকে মিথ্যা থেকে বিরত রেখে জোর দিয়ে আদেশ দেওয়া হলো সত্যি কথা বলতে। কিন্তু কাজটা করতে গিয়ে প্রচণ্ড চাপে তার ব্রেনের পজিট্রনিক ট্র্যাক-ওয়ে গেল পুড়ে। ফলে বিকল হয়ে গেল সে। ’
‘আচ্ছা, এ কারণেই তাহলে বিকল হয়ে গেছে আর. প্রেস্টন। ’
‘আমাদের আইডিয়া চোর হচ্ছেন আর. প্রেস্টনের মনিব ড. হাম্বল্ড। এখন ক্যাপ্টেন ড. হাম্বল্ডকে চেপে ধরলে তিনি হয়তো দোষ স্বীকার করবেন। খবরটা দাও ক্যাপ্টেনকে। জলদি জানিয়ো কী হয়। ’
ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একান্তে কথা বলার জন্য বেলির কনফারেন্স রুমে চলে গেল আর. ড্যানিল। ফিরল আধঘণ্টা পর।
‘কী খবর, আর. ড্যানিল?’ উৎকণ্ঠিত সুরে জানতে চাইল বেলি।
‘আপনার আন্দাজই ঠিক, বন্ধু এলিজা। দোষ স্বীকার করেছেন ড. হাম্বল্ড। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন। ’
‘ভালো,’ ক্লান্ত কণ্ঠে বলল বেলি।
আর. ড্যানিল বলল, ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে। ’
‘হ্যাঁ, বলো?’
‘সত্যের পথ থেকে মিথ্যার পথে যাওয়া যদি কঠিন হয়, তাহলে তো মিথ্যার পথ থেকে সত্যের পথে যাওয়া সহজ হবে, তা–ই না? সে ক্ষেত্রে আর. প্রেস্টন প্রথম যখন তার মনিবের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়, তখন সে বহাল তবিয়তেই ছিল। কিন্তু এখন নিশ্চল হয়ে গেল। তার মানে, প্রথমবার সে সত্যি কথা বলেছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করে তো বলা যায়, ড. হাম্বল্ড নির্দোষ এবং ড. স্যাবাটই দোষী, তা–ই না?’
‘হ্যাঁ, এ পথেও তর্ক করা সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরেকটা যুক্তি ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ডা. হাম্বল্ড নিজেই তো তাঁর দোষ স্বীকার করেছেন, তা–ই না?’
‘হ্যাঁ, তা করেছেন। কিন্তু এ যুক্তিতর্ক তো দুদিকেই আঙুল তোলে। সেখান থেকে এত জলদি সঠিক উত্তর বেছে নিলেন কেমন করে, বন্ধু এলিজা?’
মুহূর্তের জন্য ঠোঁট কুঁচকে বসে রইল বেলি। তারপর হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, ‘আমি এখানে মানুষের প্রতিক্রিয়া হিসাবের মধ্যে রেখেছি, রোবটের নয়। কারণ, আমি রোবটের চেয়ে মানুষ সম্পর্কে বেশি জানি। একটু ঘুরিয়ে বললে, রোবট দুটোর ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় আন্দাজ করে ফেলেছিলাম দোষী কে হতে পারেন। তবে মানবচরিত্র নিয়ে আমার নিজস্ব বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে প্রকৃত দোষীর বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। ’
‘মানবচরিত্র নিয়ে আপনার বিশ্লেষণটা কী, বন্ধু?’
‘একটু ভাবো, আর. ড্যানিল। মিরর ইমেজ ছাড়াও আরেকটা অসামঞ্জস্য আছে এ কাহিনিতে। সমস্যাটা দুই গণিতবিদের বয়সের ব্যবধানে। একজন থুত্থুড়ে বুড়ো, আরেকজন একেবারেই তরুণ।
‘নতুন বৈপ্লবিক আইডিয়া নিয়ে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করতে যান কারা? তরুণেরাই সাধারণত এ কাজ করেন। তরুণ ডা. স্যাবাটের মাথায় হঠাৎ যদি কোনো বৈপ্লবিক আইডিয়া এসে থাকে, তাহলে সেটা নিয়ে ডা. হাম্বল্ডের সঙ্গে আলোচনা করতে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ ডা. হাম্বল্ডই তরুণদের আদর্শ। এমন নামী একজন লোক কোনো তরুণের আইডিয়া চুরি করবেন, এ তো একেবারেই অকল্পনীয় ব্যাপার।
‘অন্যদিকে হাম্বল্ডের মাথায় অমন আইডিয়া এলে কারও সঙ্গে পরামর্শ করার কথা নয়। বিশেষ করে হাঁটুর বয়সী একজনের সঙ্গে তো কথা বলবেনই না। দুই দিনের এক ছোকরা হুট করে এভাবে খ্যাতিমান হয়ে যাবে, তা তাঁর মতো বুড়োর সহ্য হওয়ার কথা না। তাই প্রথম সুযোগেই আইডিয়াটা চুরি করে ফেললেন। মোদ্দাকথা, স্যাবাট যে হাম্বল্ডের আইডিয়া চুরি করবেন, এ কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেকোনো দিক থেকে বিচার করতে গেলে হাম্বল্ডই দোষী। ’
অনেকক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল আর. ড্যানিল। তারপর বেলির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ‘আমাকে এখন যেতে হবে, বন্ধু এলিজা। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভালো লাগল। হয়তো শিগগিরই আবার দেখা হবে। ’
আন্তরিক করমর্দন করল বেলি রোবটের সঙ্গে। তারপর বলল, ‘কিছু মনে কোরো না, আর. ড্যানিল। শিগগির আমাদের দেখা না হলেই ভালো। ’

মূল: আইজ্যাক আসিমভ
রূপান্তর: মারুফ হোসেন
[গল্পটি মাসিক 'কিশোর আলো'-র জানুয়ারি, ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত।]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:৫৯
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×