সুন্দরবনের কটকা অঞ্চল

সুন্দরবনের কার্বনের পরিমাণ নিয়ে প্রথম সমীক্ষায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের গাছ, লতাগুল্ম ও জৈব উপাদানে পাঁচ কোটি ৬০ লাখ টন কার্বন রয়েছে। সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, গত ১৪ বছরে এখানে ২ শতাংশ বনজ সম্পদ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তথ্য আন্তর্জাতিক কার্বন বাজারে উপস্থাপন করে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে।
‘সুন্দরবন ফরেস্ট কার্বন ইনভেনটরি-২০০৯’ শীর্ষক সমীক্ষায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একাধিক সংস্থার সহায়তায় সরকারের বন বিভাগ এ সমীক্ষা করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের কার্বনের পরিমাণ নির্ধারণ এবং সেই কার্বন আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে এই সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেশি কার্বন মজুদ রয়েছে বাইন, পশুর ও কাঁকড়া গাছে। সুন্দরী গাছের কার্বনের ধারণক্ষমতা মাঝারি ধরনের। তুলনায় গেওয়া ও কেওড়ায় কার্বন অনেক কম।
পরিবেশ ও বনসচিব মিহির কান্তি মজুমদার এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক কার্বন বাজার ও তহবিল থেকে অর্থ পেতে বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিয়েছে। এই সমীক্ষা সেই প্রস্তুতিরই অংশ। আগামী বছর থেকে বিভিন্ন তহবিলে বাংলাদেশ সুন্দরবনের কার্বনের পরিমাণ উপস্থাপন করে অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করবে।
বন বিভাগ ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সূত্রগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি টন কার্বন ১০ থেকে ২০ ডলারে কেনা-বেচা হচ্ছে। সুন্দরবনের কার্বনের বিনিময়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কার্বন তহবিল থেকে কমপক্ষে ১৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল পেতে পারে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, শিকাগো কার্বন বাজারে প্রতি টন কার্বন ৫ থেকে ১০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের ক্লিন ডেভেলপমেন্ট ম্যাকানিজম (সিডিএম) তহবিল প্রতি টন কার্বনের জন্য ২৫ থেকে ৩০ ডলার দিচ্ছে। তিনি বলেন, সুন্দরবনের কার্বন কোন বাজারে বিক্রি করা হবে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কার্যকরী পরিষদের পরামর্শ নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক তৎপরতা: জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ (১৭ থেকে ১৯ শতাংশ) বন ধ্বংস হওয়া। বনায়ন ও পুনর্বনায়ন করার মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে আনতে জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে।
জাতিসংঘ এরই মধ্যে ‘বনায়নের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানো’ বা ‘রিডিউসিং এমিসন ফ্রম ডিফরেস্টেশন অ্যান্ড ফরেস্ট ডিগ্রেডেশন (রেড)’ তহবিল গঠন করেছে। ধ্বংস হওয়া থেকে বন রক্ষা করলে বা ধ্বংস হওয়া বনে বনায়ন করলে এই তহবিল থেকে অর্থ পাওয়া যাবে। জাতিসংঘের আরেকটি উদ্যোগ সিডিএম। বনায়ন করলে, বন রক্ষা করলে এই তহবিল থেকে অর্থ পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাংকেরও একটি তহবিল রয়েছে। অন্যদিকে নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ ইউরোপের আটটি দেশ মিলে ছয় বিলিয়ন ডলারের ‘ওসলো তহবিল’ গঠন করেছে। কারিগরি সহায়তা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা বৃদ্ধি—এসব খাতে এই তহবিল থেকে সহায়তা পাওয়া যাবে। ওসলো তহবিল থেকে ইন্দোনেশিয়া এরই মধ্যে এক বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। এর বাইরে ব্যবসায়ীরা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে কার্বন স্টক মার্কেট চালু করেছেন তাঁদের বহুজাতিক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল থেকে।
কার্বন বাণিজ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনাগুলোতে সরকারের প্রতিনিধি আনসারুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের সমীক্ষাটির মধ্য দিয়ে সরকারের কার্বন-বাণিজ্যের প্রাথমিক কাজ শুরু হলো। সরকারের উচিত সমীক্ষাটির ফলাফল নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা।
কীভাবে কার্বন বিক্রি হবে: জাতিসংঘের আওতায় ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত কিয়োটো চুক্তি অনুযায়ী কোনো উন্নয়নশীল দেশ যদি তার বনজ সম্পদ সংরক্ষণ এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়া বনাঞ্চলে পুনর্বনায়ন করে, তাহলে শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে আর্থিক সহায়তা পাবে। চুক্তি অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণের একটি সীমা ঠিক করে দেওয়া হয়। কোনো উন্নত দেশ সীমার অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ করলে তা ধরে রাখার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থ সহায়তা দেবে।
‘ম্যাকমিলান ডিকশনারি’ বলছে, একটি কোম্পানি বা দেশের যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করার কথা, কার্বন-বাণিজ্য তার অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ অনুমোদন করে।
একটি সূত্র বলছে, বিশ্বব্যাংকের ফরেস্ট কার্বন ফ্যাসিলিটি তহবিল এবং শিকাগো ও লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক কার্বন স্টক মার্কেটে সুন্দরবনের কার্বন বিক্রির চিন্তা করছে কেউ কেউ।
আনসারুল করিম বলেছেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের তৈরি কার্বন স্টক মার্কেটে বিক্রি করলে তারা সুন্দরবনের ওপর নানা ধরনের শর্ত দিতে পারে, যা ওই বনের জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উচিত হবে রেড বা ওসলো তহবিল থেকে অর্থ নেওয়া।
আন্তর্জাতিক বাজারে কার্বন বিক্রির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বনসেবা বিভাগ কারিগরি এবং ইউএসএআইডি আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। কার্বন নিয়ে সমীক্ষা ও তা বিক্রির প্রস্তাবনা তৈরির ব্যাপারেও সংস্থা দুটি সহায়তা দিচ্ছে। এসব বিষয় তত্ত্বাবধান করছে ইউএসএআইডির সহায়তায় পরিচালিত সমন্বিত সংরক্ষিত সহ-ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইপ্যাক)।
আইপ্যাকের চিফ অব পার্টি (সিওপি) রিড ম্যারিল প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বন সংরক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। আইপ্যাক সে লক্ষ্যে বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
গত বছর ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে ১০০ কোটি ডলারের জলবায়ু তহবিল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সেখানে রেড তহবিলের রূপরেখা ও প্রাথমিক কার্যক্রম শুরুর ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল।
আগামী ডিসেম্বরে মেক্সিকোর কানকুনের কপ-১৬ সম্মেলনে জলবায়ু তহবিলের বড় অংশ রেড তহবিলে দেওয়ার ব্যাপারে একটি সমঝোতা হতে পারে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ সুন্দরবনের কার্বন সুরক্ষার কথা বলে ওই তহবিল থেকে অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করবে বলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



